২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কবি গোলাম মোস্তফার সাহিত্যচিন্তা ও দর্শন

কবি গোলাম মোস্তফার সাহিত্যচিন্তা ও দর্শন -

সাহিত্যের ইতিহাসে কবি গোলাম মোস্তফা একটি অপরিহার্য নাম, এক বিরল দৃষ্টান্ত। সাহিত্যের অঙ্গনে তার অবদান এমনভাবে স্বীকৃত যে, অনেক পটপরিবর্তনের পরও তিনি নিজের সাহিত্য কীর্তিতে অম্লান। মৌলিক সত্তা এবং ইসলামী স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এক মানসভূমি কবি গোলাম মোস্তফা স্বভাবতই ছিলেন সহজ, সরল এবং ইসলামের রঙে রঞ্জিত। তৎকালীন মুসলিম সমাজের বাস্তবতা তাকে সহজবোধ্য এবং সরল ভাষায় কাব্যরচনা করতে উৎসাহিত করে। তার ভাষার সরলতা, অলঙ্কারের সৌন্দর্যের কারণে তার সাহিত্য সহজপাঠ্য এবং সহজবোধ্য। প্রস্তুতি, অনুশীলন এবং অধ্যবসায় ছাড়া কোনো কাজই সুসম্পন্ন হয় না। এই প্রস্তুতি, অনুশীলন, এবং অধ্যবসায়ের সাথে যোগ হয় ব্যক্তির প্রাণপ্রাচুর্য, প্রতিভা, ধারণক্ষমতা বা মেধা। এই মেধাবী প্রতিভাবান, শক্তিমান মানুষদের পক্ষেই সম্ভব মৌলিক কিছু সৃষ্টি করা। কবি গোলাম মোস্তফা, যিনি কোনো রকম সংকোচ বা দ্বিধা না করেই, ইসলামী বিষয় নিয়ে আবেগঘন কবিতা, গান ও প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগাতে চেয়েছেন। তিনি যে বিষয়েই লেখেন না কেন , তাতে আদর্শিক বিবেচনাকে কখনোই উপেক্ষা করেন না। তার লেখা এবং বক্তব্য যেমন গভীর, তেমনি উপস্থাপনায় প্রীতিপদ। তিনি তার রচনায় ব্যাপকভাবে আরবি, ফারসি ও উর্দু শব্দের ব্যবহার করেছেন যা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তিনি ছিলেন পেশায় শিক্ষক। কিন্তু তার রচনা ও বক্তব্যে কোনো শিক্ষকতা নেই। যা আছে তা হলো আগ্রহ, অনুসন্ধান। দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের পথিকৃৎ এমন শাশ্বত ও চিরন্তন বাণী সিঞ্চিত লেখা যার কলমের ডগায় বেরিয়ে আসে, তিনিই ইসলামী রেনেসাঁর এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর কবি গোলাম মোস্তফা।
সাহিত্যের সব শাখায় কবি গোলাম মোস্তফার অবাধ বিচরণ ছিল সহজাত। এই সহজাত বিচরণ, ইসলামী মূল্যবোধ এবং সমকালীন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তাঁর সাহিত্যের প্রতিটি শাখা ইসলামী ঐতিহ্যে সমুজ্জ্বল। মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন মূলত: কবি। তাঁর সাহিত্য জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সাহিত্যের প্রতিটি অক্ষরে প্রবাহিত ছিল ইসলামী প্রেরণার উষ্ণতা, স্বাজাত্যবোধ, প্রেম, দর্শন, চিন্তা এবং মানবতা। তার লেখা বিশ্বনবী (জীবনী : ১৯৪২ খৃ.), বনি আদম (মহাকাব্য : ১৯৫৮ খৃ.), আমার চিন্তাধারা (প্রবন্ধ : ১৯৬২ খ্রি.) রক্তরাগ (১৯২৪ খ্রি.), খোশরোজ (১৯২৯ খ্রি.), হাস্নাহেনা (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ), কাব্যকাহিনী (১৯৩৮ খৃ.), তারানা-ই পাকিস্তান (১৯৫৬ খৃ.), রূপের নেশা (উপন্যাস, ১৩২৬ খৃ.), ২. ভাঙ্গা বুক (উপন্যাস, ১৯২১ খৃ.) এবং তার জ্ঞানগর্ভ-অনূদিত কাব্যগ্রšগুলোই তা প্রমাণ করে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’ এর ২৯টি কবিতার মধ্যে ১০টি; খোশরোজ এর ১৯টি কবিতার মধ্যে ১৭টি; কাব্যকাহিনী এর ১৮টি কবিতাই ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কিত। এ কথা অনস্বীকার্যভাবে সত্য যে, তাঁর বনি আদম ইসলামী চিন্তাদর্শন ভিত্তিক। কবি গোলাম মোস্তফা পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে ৩৯টি গ্রন্থ রচনা করেন।
প্রকরণের দিক থেকে তাঁর গ্রন্থগুলোকে ৮টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. কাব্যগ্রন্থ ২. উপন্যাস ৩. জীবনীগ্রন্থ ৪. প্রবন্ধগ্রন্থ ৫.পাঠ্যপুস্তক ৬. কিশোর কবিতা ৭. গান ও ৮. অনুবাদ সাহিত্য
১. কাব্যগ্রন্থ : রক্ত রাগ (কবিতা, ১৯২৪ খৃ.), ২. খোশরোজ (কবিতা, ১৯২৯ খৃ.), ৩. সাহারা (কবিতা, ১৯৩৫ খৃ.), ৪. হাস্না হেনা (কবিতা, ১৯২৮খৃ.), ৫. কাব্যকাহিনী (কবিতা, ১৯৩৮ খৃ.), ৬. তারানা-ই-পাকিস্তান (কবিতা, ১৯৫৬ খৃ.), ৭. বনি আদম, প্রথম খণ্ড (কবিতা, ১৯৫৮ খৃ.), ৩টি কাব্য সংকলন: ১.বুলবুলিস্তান (কাব্য সংকলন, ১৯৪৯ খৃ.), ২. কাব্য গ্রন্থাবলি, ১ম খণ্ড (কবিতা-আবদুল কাদির সম্পাদিত, ১৯৭১ খৃ.), ৩. কাব্য সংকলন (কবিতা-সৈয়দ আলী আশরাফ সম্পাদিত, ১৯৬০ খৃ.)।
২. উপন্যাস : ১. রূপের নেশা (উপন্যাস, ১৩২৬ খৃ.), ২. ভাঙ্গা বুক (উপন্যাস, ১৯২১ খৃ.)।
৩. জীবনীগ্রন্থ : ১.বিশ্বনবী (জীবনী, ১৯৪২ খৃ.), ২. মরু দুলাল (জীবনী, ১৯৪৮ খৃ.), ৩. বিশ্ব নবীর বৈশিষ্ট্য (জীবনী, ১৯৬০ খৃ.), ৪. হযরত আবুবকর (জীবনী, ১৯৬৫ খৃ.)।
৪. প্রবন্ধগ্রন্থ : আমার চিন্তাধারা (প্রবন্ধ সংকলন, ১৯৬২ খৃ.),
৫. পাঠ্য পুস্তক: আলোক মঞ্জরী, (১৯৫৩ খৃ.),পথের আলো (১৯৫৩ খৃ.), নতুন আলো (১৯৫৪ খৃ.), ইসলামী নীতিকথা (১৯৫৩ খৃ.), মনিমুকুর, ইতিহাস পরিচয় (১৯৪৭ খৃ.), ইতিকাহিনী, নতুন বাংলা ব্যাকরণ, নতুন ব্যাকরণ, মঞ্জু লেখা ইত্যাদি। ৬. কিশোর কবিতা : আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি (কিশোর কবিতা, ১৯৮০ খৃ.)। ৭. গান : ৭. গীতি সঞ্চয়ন (গান, ফিরোজা খাতুন সম্পাদিত: ১৯৬৫ খৃ., ১৯৬৮ খৃ.) এবং ৮. অনুবাদ সাহিত্য: ১. মোসাদ্দাস-ই-হালী (অনুবাদ কবিতা, ১৯৪১ খৃ.), ২. কালাম-ই-ইকবাল (কবিতা, ইকবাল কাব্যের অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), ৩. শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৪. জবাব ই-শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৫. আল-কুরআন (বাংলা কাব্য অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), জয় পরাজয় (গল্প, ‘রাসাইলু ইখওয়ানুস্ সাফা ১৯৬৯ খৃ. ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ)।
বিষয়বস্তুর আলোকে গ্রন্থগুলোকে ৬টি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. সাহিত্য ২. ইসলামী সাহিত্য ৩. জীবনী সাহিত্য ৪. রাজনীতি ও ইতিহাস ৫. ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা ৬. চিন্তাাধারা
কবি তাঁর দীর্ঘ সাহিত্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি তাঁর স্বজাতির চিন্তাচেতনার কথা, হৃদয়ের কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন যাদের হৃদয়ে ছিল অজ্ঞানতার অন্ধকার, তারাই ইসলামের অমীয় বাণী শ্রবণ করে স্বর্গ হতে আলোক নামিয়ে আনলো। তারা নতুন জীবন লাভ করে জীবনের সাথে দিকে দিকে নতুন তত্ত্ব জড়িয়ে নিলো। দর্শন-বীজগণিত-রসায়ন থেকে শুরু করে পৃথিবীর আদি জ্ঞানের আধুনিক চেতনায় কবি লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’-এর প্রথম কবিতার নাম ‘পরিচয়’। এই কবিতাটি ১৯১৬ সালে মাসিক ‘মোহাম্মদী’তে ছাপা হয়েছিল। এর প্রথম স্তবকটিতে কবি লিখেছেন :
‘জগতের মাঝে আমরা সবাই বিপুল একটি জাতি,
লুকায়ে রয়েছে আমাদের মাঝে অসীম বীর্য-ভাতি,
আমরা জগতে মরিব না কভু, চিরকাল বেঁচে রব
যুগে যুগে লভি নূতন শক্তি বিশ্ব-বিজয়ী হবো!
এক তারে সবে বেঁধে দিব প্রাণ-এক সুরে গাব গান,
মহা-মানবতা গড়িয়া তুলিব-আমরা মুসলমান।
কবিতা এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি দর্শন ও চিন্তাধারার সাথে ইসলাম ও সঙ্গীতকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁর রচিত শ্রেষ্ঠ না’তটি কিংবদন্তীর মর্যাদা অর্জন করেছে। কবির বিখ্যাত কিয়াম ও মিলাদ বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন।
‘ইয়া নবী সালাম আলাইকা
ইয়া রসূল সালাম আলাইকা
ইয়া হাবীব সালাম আলাইকা
সালাওয়া তুল্লাহ আলাইকা।
তুমি যে নূরের রবি
নিখিলের ধ্যানের ছবি
তুমি না এলে দুনিয়ায়
আঁধারে ডুবিত সবি।
ইসলাম সম্পর্কে তার অপরিসীম আবেগ ছিল। ইসলামী মিথ, জীবন-দর্শন, আদর্শ ইত্যাদি সম্পর্কে তার যে অবদান তা বাংলা সাহিত্যে অনস্বীকার্য। মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিশ্বাস, পিছিয়ে পড়া মুসলিম জাতির উত্থান ও পুনরায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠাই তাঁর কবিতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাথে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সপ্রতিভ বিচরণই তাঁর প্রখর মেধা ও মননের স্বাক্ষর বহন করে। কিন্তু তাঁর যোগ্যতা অনুসারে তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। কোন কোন মহল তাঁকে শুধু ‘বিশ্বনবী’ র প্রণেতা হিসেবেই পরিমাপ করেন। কিন্তু সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর বিশাল আয়োজন সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। তাঁর সম্পর্কে এই অহেতুক নীরব ভূমিকা পালন সত্যিই দুঃখজনক। কবি গোলাম মোস্তফার গ্রন্থগুলোকে সরকারিভাবে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ার সাথে সাথে শিক্ষায়তনের প্রতিটি শ্রেণীর শিক্ষাক্রমে তাঁর সাহিত্যকে পুনরায় পাঠ্যভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন গবেষণা ও ব্যাপক পঠনের মাধ্যমে তার চিন্তাধারা এবং দর্শন উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি।


আরো সংবাদ



premium cement
ফার্মগেটে ৭ তলা ভবনে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে ইউক্রেনের ডনেটস্ক অঞ্চলের গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে রাশিয়া পর্ণো তারকাকে অর্থ দেয়ার মামলা খারিজের আবেদনের অনুমতি পেলেন ট্রাম্প দোহারে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর নামে ছাত্রলীগ নেতার মামলা ‘কোরআন-সুন্নাহর আদর্শ ছাড়া আলেমদের জন্য রাজনীতি জায়েজ নেই’ চীনা দূতাবাসের আউটস্ট্যান্ডিং পার্টনার অ্যাওয়ার্ড অর্জন অ্যাবকার ঢাবির রাজনীতিবিষয়ক বিশেষ কমিটির কার্যক্রম শুরু রোববার রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিকদের বিক্ষোভ রেহানার সুরের মূর্ছনায় হেমন্তের এক মুগ্ধ সন্ধ্যা একুশে বইমেলায় স্টলভাড়া কমানোর দাবি ২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সপ্তাহ পার করল স্বর্ণের বাজার

সকল