২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বুকার জয়ী সামান্থা হার্ভে ও তার উপন্যাস

বুকার জয়ী সামান্থা হার্ভে ও তার উপন্যাস -

নোবেলের পর সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্রিটিশ সাহিত্য পুরস্কার বুকারের ৫৫ বছরের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা পেয়েছিলেন। মনোনীত ৬ জন লেখকের মধ্যে ৫ জনই ছিলেন নারী। তাদেরই একজন এ বছর জিতে নিয়েছেন এই পুরস্কার। সম্প্রতি লন্ডনে বিজয়ী লেখকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ভাগ্যবতী লেখিকার নাম সামান্থা হার্ভে। আর উপন্যাসটি হচ্ছে ‘অরবিটাল’। তিনি ৫০ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৬৪ হাজার ডলার) অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন আর পেয়েছেন আইরিস নামে একটি ট্রফি। আইরিশ-ব্রিটিশ উপন্যাসিক আইরিস মারডকের সম্মানে এই ট্রফির নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৬৯ সাল থেকে বুকার প্রাইজ দেয়া হচ্ছে। বিশিষ্ট লেখকরা এই পুরস্কার পেয়েছেন।
সামান্থা হার্ভের জন্ম ১৯৭৫ সালে ব্রিটেনের কেন্ট এ। তিনি ভাঙা সংসারের বাবা মায়ের সন্তান। ১০ বছর বয়সে তার বাবা-মার ডিভোর্স হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি কেন্টেই ছিলেন। সেপারেশনের পর তার মা আয়ারল্যান্ডে চলে যান। কিশোরী বয়সটা হার্ভে ইয়র্ক, শেফিল্ডে ও জাপানে কাটান। তিনি ইয়র্ক ও শেফিল্ড ভার্সিটি থেকে দর্শনে বি এ পাস করার পর ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে এম এ এবং পরে পিএইচডি করেন। এসব কোর্সে চাকরির বাজার মূল্য না থাকলেও লেখালেখির নতুন জগৎ খুঁজে পেতে সহায়ক হয়। সামান্থার ব্যাপারেও সেটা হয়েছে আর তিনি মাত্র ৫টি উপন্যাস লিখেই বুকারের মতো বড় পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। ্আরো যাদের বই ছিল শর্ট লিস্টে তারা হলেন ১. পার্সিভাল এভারেট- উপন্যাস জেমস, ২. র্যা চেল কুশনার - ক্রিয়েশন লেক ৩. অ্যান মাইকেলস - হেল্ড, ৪. ইয়ায়েল ভ্যান ডের উডেন- দ্য সেফকিপ ৫. শার্লট উড- স্টোন ইয়ার্ড ডিভোশনাল।
অরবিটাল এমন একটি উপন্যাস, যা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, সাহিত্যিক কল্পকাহিনী এবং দার্শনিক নাটকের উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা যুক্তরাজ্যের জোনাথন কেপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রোভ আটলান্টিক দ্বারা প্রকাশিত। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছয়জন কাল্পনিক মহাকাশচারীকে নিয়ে লেখা। যেখানে একটি এলিয়েন, একটি রোবট এবং একটি প্রাগৈতিহাসিক মানব সমন্বিত অনুমানমূলক ইন্টারলুড আছে। এটাকে সায়েন্স ফিকশন বলা যায়, সাহিত্যিক কল্পকাহিনীও বলা যায়। প্রকাশিত হওয়ার পর উপন্যাসটি সমালোচকদের দ্বারা সমাদৃত হয়েছিল।
এই উপন্যাসের পটভূমি বা পূর্বকথন রয়েছে। আর তা হচ্ছে, হার্ভে উপন্যাসটি লেখার সময় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীর একটি অবিচ্ছিন্ন লাইভ স্ট্রিম দেখেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি প্রাথমিকভাবে ২০১০-এর দশকে উপন্যাসে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি প্রায় ৫,০০০ শব্দ লেখার পর লেখা বন্ধ করে দেন এটা ভেবে যে মহাকাশ ভ্রমণের জটিল বিষয় সম্পর্কে তার সীমিত জ্ঞান রয়েছে। হার্ভে বিবিসিকে বলেছিলেন যে তিনি লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ তিনি ভেবেছিলেন, আমি কখনোই মহাকাশে যাইনি। আমি কখনোই মহাকাশে যেতে পারিনি.... আমি এটা করার কে? এমন একটা প্রশ্ন ভেতর থেকে এসেছিল। কিন্তু মানুষ কল্পনায় তো অনেকদূর দেখতে পারে। সেই বিবেচনায় হার্ভে আবার লেখা শুরু করেন এবং ২০২০ সালে কোভিড মহামারী চলাকালীন উপন্যাসটি সম্পন্ন করেন। তিনি তখন ব্রিটেনে ছিলেন। কোভিড-১৯ মহামারির লকডাউনের সময় ঘরে আটকে পড়েছিল পৃথিবী। মানুষ দীর্ঘ সময় বাসায় বসে ভেবেছে, কীভাবে সময় কাটানো যায়। ঠিক এ সময় ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেন।
উপন্যাসটির কাহিনী ব্যাপ্তি ২৪ ঘণ্টার। ইউলিসিসের মতো চেতনাপ্রবাহী উপন্যাসের ব্যাপ্তিও অনুরূপ, যদিও সেটার আকার অনেক বড়। কিন্তু অরবিটালের আকার ছোট মাত্র ১৩৬ পৃষ্ঠার। এটাকে বলা হয়েছে পুরস্কার পাওয়া দ্বিতীয় ছোট বই। উপন্যাসটি জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালি এবং রাশিয়ার ছয়জন কাল্পনিক মহাকাশচারীকে নিয়ে কাহিনী আবর্তিত। এর মধ্যে চার পুরুষ এবং দুই মহিলা, তারা পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন দিনে অসংখ্যবার। কারণ তারা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বসবাসরত নভোচারী। মহাকাশযানে থাকা মহাকাশচারীদের অফিসিয়াল দায়িত্ব এবং কাজগুলো বিস্তারিত করার পাশাপাশি, উপন্যাসটিতে মানবতা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা প্রকৃতি, জীবনের অর্থ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অস্তিত্বের হুমকিসহ মানবতা এবং বিষয় সম্পর্কে তাদের প্রতিচ্ছবিও রয়েছে। উপন্যাসটি একটি এলিয়েন, একটি রোবট এবং সমুদ্রে প্রাগৈতিহাসিক মানব যাত্রার বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংক্ষিপ্তভাবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায় পৃথিবীর চারপাশে একক ৯০-মিনিটের কক্ষপথ কভার করে, ২৪ ঘণ্টায় ১৬টি কক্ষপথ পরিভ্রমণ করে।
মহাকাশ স্টেশন প্রতিনিয়ত ঘুরছে পৃথিবীকে ঘিরে। ফলে এ স্টেশনে থাকা নভোচারীরা প্রতিদিন ১৬টি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখেন। এই নভোচারীরা বাধ্য হয়ে পরস্পরের সাথে সময় কাটান। তাদের সামনে থাকে নীল পৃথিবী। এই পৃথিবী একদিকে সুন্দর, আরেক দিকে ভঙ্গুর।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে দেখা পৃথিবীর সৌন্দর্য ও ভঙ্গুরতা নিয়ে ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে লিখেছেন উপন্যাসক অরবিটাল। এই স্টেশনে অন্তত ৬ থেকে ৮ জন নভোচারী বসবাস করেন এবং নানা পরীক্ষা চালান। নিয়মিত ইন্টারভেলে তারা সেখানে যান, ফিরেও আসেন। বর্তমানে দুজন নভোচারী সেখানে আটকা পড়ে আছেন, তাদের ফেরার কথা ছিল যে সময়ে তারা তা পারেননি। তাদের এখন আগামী ফেব্রুয়ারিতে ফিরিয়ে আনা হবে। এটা একবারে হাল আমলের ঘটনা, এটা নিয়েও হয়তো কাহিনি লেখা হতে পারে আগামীতে। যাই হোক মানুষ এসব বিষয়ে আগহী, আর সে বিষয়টাই বেছে নিয়েছেন সামান্থা। তাকে প্রশংসা করতেই হয়। এটি নিয়ে তার নিজের কথাও নতুন মাত্রা যোগ করে। হার্ভে বলেছেন, ‘মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখা একটা শিশুর আয়নায় তাকানোর মতো। যে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে আয়নায় থাকা মানুষটা সে নিজেই।’ বইটি লেখার জন্য হার্ভে মহাকাশচারীদের লেখা বই পড়তেন। নিয়মিত দেখতেন মহাকাশ স্টেশনের লাইভ ক্যামেরা। এভাবেই অরবিটাল উপন্যাসের প্লট তৈরি হয়েছে। ছোট আকারের বলে অনেকে এটাকে নভেলা বা উপন্যাসিকা বলতে চান। সে যাই হোক, এই উপন্যাসের সাথে পৃথিবীর মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। তিনি বলেছেন, উপন্যাসটি ঠিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নয়, তবে পৃথিবীকে দেখলে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সত্যটুকু বোঝা যায়। হার্ভে এই পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন পৃথিবীর পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, অন্য মানুষের মর্যাদার বিরুদ্ধে, অন্য জীবনের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেন না, তাদের। যারা শান্তির পক্ষে কথা বলেন, আহ্বান জানান এবং কাজ করেন, তাদের।
এর আগে চারটি উপন্যাস ও স্মৃতিকথা লিখেছেন হার্ভে। ২০২০ সালের পর তিনিই প্রথম ব্রিটিশ লেখক, যিনি বুকার জিতলেন। এ পুরস্কার যেকোনো দেশের ইংরেজি ভাষার লেখকদের জন্য উন্মুক্ত। বিখ্যাত অনেক লেখকই এর আগে বুকার জিতেছেন। ইয়ান ম্যাকইওয়ান, মার্গারেট অ্যাটউড, সালমান রুশদি ও হিলারি ম্যানটেল এই পুরস্কার পেয়েছেন। হার্ভের ১৩৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসিকাটি ম্যানবুকারজয়ী অন্যতম সংক্ষিপ্ত বই। ১৯৬৯ সালে প্রথম বুকার পুরস্কার দেয়া শুরু হয়। গত বছর এ পুরস্কার পেয়েছিলেন আইরিশ লেখক পল লিঞ্চ ‘প্রফেট সং’-এর জন্য।
বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী গ্যাবি উড পৃথিবীর ভঙ্গুরতার উদাহরণ হিসেবে বলেছেন, ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কটের এই বছর (২০২৪) সম্ভবত রেকর্ডকৃত ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে। লেখক ও শিল্পী এডমন্ড ডি ওয়াল ছিলেন বুকারের পাঁচ সদস্যের বিচারক প্যানেলের সভাপতি। তিনি বলেছেন, ‘অরবিটাল একটি বিস্ময়কর উপন্যাস। এ বই বিশ্বকে আমাদের সামনে অদ্ভুত ও নতুন ধাঁচে তুলে ধরেছে।’ পুরস্কারের জন্য জমা পড়েছিল ১৫৬টি উপন্যাস। এর মধ্য থেকে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে বেছে নেয়া হয়েছিল যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডসের পাঁচ চূড়ান্ত প্রতিযোগীকে। সবাইকে পেছনে ফেলে বুকার ২০২৪ জিতলেন ব্রিটিশ লেখক হার্ভে। ২০১৯ সালের পর তিনি প্রথম বুকারজয়ী নারী।
বুকারের আগে সামান্থা আরো অনেকগুলো সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বেইলিজ ওমেন প্রাইজ ফর ফিকশান, জেমস টেইট ব্লাক মেমোরিয়াল প্রাইজ, ওয়াল্টার স্কট প্রাইজ এবং অরেঞ্জ প্রাইজ। দি কালচার শো সংস্থা ২০১০ সালে তাকে সেরা ১২ জন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক হিসেবে বর্ণনা করে। তার লেখা বই ওয়েস্টার্ন উইন্ড ২০১৯ সালে স্টাঞ্চ বুক প্রাইজ লাভ করে। তার প্রথম উপন্যাস ‘দি ওয়াইল্ডারনেস’ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটা ছিল আরেজেইমার রোগে আক্রান্ত একটি চরিত্র নিয়ে। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অল ইজ সং’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এটাও একটি সামাজিক প্রথা নিয়ে উপন্যাস। তার তৃতীয় উপন্যাস ‘ডিয়ার থিফ’ ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। এটি এক নারীর তার প্রেমিকের কাছে পাঠানো দীর্ঘ চিঠি। যে প্রেমিক ত্রিভুজ প্রেমের শিকার হয়ে তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। সামান্থা হার্ভের চতুর্থ উপন্যাস ‘দি ওয়েস্টার্ন উইন্ড’ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। এটি পঞ্চদশ শতকের একজন যাজকের কাহিনী নিয়ে লেখা। তার একমাত্র নন ফিকশন বই দিশেপলেস আনইজ। ইনসমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা নিয়ে লেখা বইটি।
তার উপন্যাসের কাহিনিভঙ্গি অভিনব, চরিত্রগুলোও স্বাভাবিক নয়, সমাজের বিভিন্ন অংশের সমস্যা সঙ্কুুল মানুষ। তার ভাষা বৈশিষ্ট্যও ব্যতিক্রমী, ফলে বিচারকমণ্ডলী তার লেখার এক দিকে প্রশংসা যেমন করেছেন, তাকে পুরস্কার থেকে নিরাশ করেননি। তার ভাষাভঙ্গীর কারণে তাকে বিশিষ্ট লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফের সাথে তুলনা করা হয়। এই পুরস্কারপ্রাপ্তি সামান্থাকে বিশ^ অঙ্গনেও পরিচিত করে তুলবে।


আরো সংবাদ



premium cement