শূন্যস্থানে আমি এখন
- নাসীমুল বারী
- ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আমাকে পছন্দ হয় না ওর। একদম পছন্দ হয় না। তাই আমার চলাচলে দোষ খোঁজে। আমার কথায় দোষ খোঁজে। আমার ঘরোয়া কিংবা বন্ধু-বান্ধবের সাথে আলাপচারিতায়ও দোষ খোঁজে।
সেবার গ্রামের বাড়ি গেলাম। গ্রাম মানে গাছ-গাছালির গ্রাম। পাখির ডাক, বনফুলের গান, খালি বিলে মাছ ধরার আনন্দ। বরাবরই আমার পছন্দের একটি অংশ গ্রাম।
আরে! একি!
আমাকে ধরে নিয়ে গেল উনার লোকেরা। আমি নাকি গোপন ষড়যন্ত্র করতে এসেছি। বিনা পয়সায় খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। খাওয়া-দাওয়ার জন্য পয়সা লাগেনি- সত্য! কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতাকে আটকে দিলো চার দেয়ালে। তার চেয়েও কষ্ট ছিল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করার ব্যাপারটা। প্রথমে আমাকে ক' ঘা চাবুক মেরে জিজ্ঞেস করে, কেন এসেছিস এইখানে এই জঙ্গলে?
আমি ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক মনে করে সহজভাবে বললাম, প্রকৃতি আমার ভালো লাগে তাই ঘুরতে এসেছি।
-উহ!
লাফ দিয়ে উঠলাম। আরেকজন এসে পেছনে আচমকা কয়টা চাবুক মারলো। মারতে মারতে বলে, মিথ্যে কথা।
কাঁপা স্বরে আমি বললাম, সত্যিই তবে কোনটা?
-বল তুই উনার ঘর-বাড়ি ভেঙে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করতে এসেছিস।
-না বললে?
-ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ঘোড়া চালিয়ে দেবো।
-ও মাগো! আমি তো মরেই যাব!
-হাঁ মরে যাবি। আর আমরা বলে দেবো পালানোর সময় ঘোড়া থেকে পড়ে ঘোড়ার পায়ের লাথি খেয়ে মরেছিস। ব্যাস, ল্যাটা চুকে যাবে। কেউ কিছু বলবে না।
-উহ....
আবারো চাবুক। মেজাজটা চড়ে গেল। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই, চাবুক মেরেই চলছে ওরা।
একসময় আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেলাম। ওরা চ্যাংদোলা করে তুলে একটা রুমে মেঝেতেই শুইয়ে দিল। মুখে পানির ছিটা দিল। বাতাস করল। কিছুক্ষণ পর একটু চোখ খুলে তাকালাম। অমনি ভারী গলায় বলে, কী স্বীকার যাচ্ছিস তাহলে?
আবার চোখ মুদলাম।
কিছুক্ষণ পর বাঁশির আওয়াজ পেলাম। বড় কেউ এসেছে মনে হয়। চোখ মুদেই কান সচেতন করে বুঝতে চেষ্টা করলাম কী হচ্ছে। কথা ভেসে আসছে আমার কানে, হুজুর এটা তো স্বীকার করছে না।
-আরো চাবুক।
-এখন মারলে তো মরেই যাবে। একদিন পরে মারি।
-কিছু খাইয়ে দাইয়ে ঠিক করে নে, তারপর আবার। দু-চার দিনে স্বীকার না গেলে আগেরটার মতো ঘোড়ার পেছনে বেঁধে দে। শেষ হয়ে যাবে এটা। এভাবে ওদের সব কটাকে শেষ করে দিতে হবে।
আমি বুঝলাম হাসির ভাব নিয়ে কথাগুলো বলছে ঐ কর্তা। কিন্তু আমার প্রতি এতো রাগ কেন? আমার পরিবারের প্রতি এতো রাগ কেন? আমার পাড়াপড়শি, প্রতিবেশীর প্রতি এতো রাগ কেন? আমি বা আমরা তো কখনোই তার ঘর-বাড়ি ভাঙতে যাইনি। শুধু বলেছি আমরা যা চাষাবাদ করব আমরাই খাব। কিন্তু না ওরা লুটেপুটে সব নিয়ে যায়। তার আত্মীয়স্বজনরা নিয়ে যায়। তার বাড়ির লোকজন নিয়ে যায়। তাদের যা ইচ্ছে, তা-ই করে। হাটে, মাঠে, বাজারে, নগরে কোথাও এসব বলতে গেলে চাবুকের ঘা খেতে হয়। গরম পানিতে হাত-পা চুবিয়ে রাখতে হয়। গরম সিদ্ধ ডিমের উপর বসিয়ে রাখা হয়। কী সব যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা! শহরে পাড়ায় গ্রামের সব জায়গায় ওরা আমাদের তাড়া করছে। এখনকার কথায় বুঝলাম আগে ঘোড়ায় বেঁধে অনেককেই মেরে ফেলছে। কতজনকে মেরেছে, তা কে জানে?
মনটা ভীষণ খারাপ।
মিথ্যে স্বীকার যাব? হয়তো বেঁচে যাবে জীবন। সত্য স্বীকার যাব? ঘোড়ার পেছনে বেঁধে মেরে ফেলবে। কোনটা উত্তম, ভাবছি। নিজের দেহ নিয়ে ভাবছি। জীবন বাঁচাবো- কাপুরুষতা। মৃত্যু অনিবার্য- বীরগাথা জীবন বংশপরম্পরায় বয়ে চলবে।
উহ! আহ!....
আবার অনবরত চাবুক মেরেই যাচ্ছে। এবার ওদের কথার বিষয় বদলে গেছে। চাবুকটা থামিয়ে বলে, আচ্ছা তুই কিছু করিসনি ভালো কথা। তোর সাঙ্গপাঙ্গ কে কে উনার ঘর-বাড়ি ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছিল, বলে দে নাম।
-আমি জানি না।
উহ! আহ!.... আবারো চাবুক।
গোঙ্গানো স্বরে বললাম, উনার ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে আমার লাভ? আমি করিনি, আমি জানি না ওসব।
-আহারে...! উনার ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে তোরা নতুন ঘর-বাড়ি তুলবি। আমরা কিছু বুঝি না?
কতদিন হয়ে গেল, এখন ওই ঘরে আটকে আমি। আজ হঠাৎ পাশের রুম থেকে একটা ছেলের চিৎকার শুনলাম। আরে চিৎকারটা যে আমার ছেলের মতোই মনে হচ্ছে! আমার শরীরও ব্যথা। হাঁটতে কষ্ট হয়, তারপরও কুড়িয়ে কুড়িয়ে হেঁটে হেঁটে ছোট্ট জানালা দিয়ে ওই রুমে উঁকি দিলাম।
তাই তো! আমার ছেলেকে ওরা চাবুক মারছে। আমি চিৎকার করে বললাম, ওকে মারছো কেন?
ইয়া মোচওয়ালা চাবুকধারী লোকটি বলে, তুই যখন স্বীকার যাবি না, তোর পোলাকে দিয়ে স্বীকার করাব। তারপর ঘোড়ায় বেঁধে দেবো।
আমাকে দেখে আমার ছেলে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, বাবা, ও বাবা!
-কী হয়েছে বাপ?
-ওরা বাজারে তোমার দোকানটা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে ধরে এনে বলছে আমি নাকি উনার ঘর-বাড়ি ভাঙ্গার জন্য আমার বন্ধুদের জড়ো করেছি। বলো বাবা এটা মিথ্যা না? আমি কি এমন করেছি? তুমি কি এমন করেছ?
আমি ছেলের সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে আনমনে বললাম, এ মিথ্যাটাকে ওরা সত্য বানিয়েই ছাড়বে। ওদের কাজই সত্যকে মিথ্যা বানানো আর মিথ্যাকে সত্য বানানো।
-উহ্, আহ্! বাবা বাবা আহ্!
ছেলেটার পিঠে অনবরত চাবুক পড়ছে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছি। ও রুমে যে আমার যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মনে মনে ভাবছি, ওকে কেন, আমাকে না হয় মারো।
ঠাস করে জানালা আটকে দিল। আমি রুমের এক কোণে মাটিতে বসে পড়লাম। ডান পাশের রুম থেকেও শুনি আরেকটা চিৎকার। জানলাটা একটু ভেজানো। উঠে গিয়ে উঁকি দিলাম। আরে এ যে আমার ওই পাড়ার সেই যুবক ছেলেটি। এ ছেলেই তো সবাইকে সার বীজ সব কিছু সংগ্রহ করে দিতো। ইস ওকে ধরে আনলো কেন? কী চাবুকই না মারছে।
অনেক দিন হয়ে গেল।
আমি ছাড়া পাইনি। আমার ছেলে ছাড়া পায়নি। পাড়ার কেউ ছাড়া পায়নি। চাবুকের কষ্ট। খাবারের কষ্ট। নোংরা দুর্গন্ধের কষ্ট। গাদাগাদি করে অনেকে থাকার কষ্ট। আমাকে মিথ্যা বলার জন্য বারবার চাপ দিচ্ছে। একজন তো এত কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মিছামিছিই বলেছিল সে নাকি ঘর-বাড়ি ভাঙ্গার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে। তারপর ওকে নিয়ে গেল রুম থেকে। মনে হয় ছেড়ে দিয়েছে। আমিও কি এভাবে ছাড়া নিয়ে চলে যাব? কিংবা আমার ছেলে?
সকালে আমাদের সবাইকে বেঁধে রুম থেকে বের করে নিয়ে যায় একটা মাঠে। সবাই বসে আছে। মোছওয়ালা লোকটা আসে। সাথে আরো কয়েকজন। তাদের সাথে ঢাক-ঢোল আছে। দাঁড়ায়। তারপর ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেয় মোচওয়ালা লোকটি, ‘গতকাল তোদের সাথের একজনকে নিয়ে আমরা বের হয়েছিলাম ষড়যন্ত্র কারা কারা করে তা বের করতে। রুম থেকে বের হয়েই ও আচমকা আমাদের একজনের ঘোড়ায় চড়ে বসে। তারপর পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ঘোড়া থেকে পড়ে ঘোড়ার লাত্থি খেয়ে মরে যায়। সাবধান কেউ পালাতে চেষ্টা করবি না, সাবধান।’
ঘোষণা দিয়ে চলে যায় লোকটা। আমাদের আবার আটকে রাখে। তাখনই আরেক গাঁয়ের আরেকজনকে নিয়ে আসে এখানে। চাবুক মারতে মারতে এনেছে। রক্ত আর বালিতে পা আটকে যায় যেন। রেখে চলে যায় ওরা। আমি কাছে গিয়ে মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করি, ভাই কী হয়েছে?
এদিক ওদিক তাকিয়ে ভীত কণ্ঠে কাঁপা স্বরে বলে, আমার ধান সব নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি দেইনি। প্রথমে আমার দোকানটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারপর ঘর-বাড়ি। তারপর আমাকে ধরে নিয়ে এসে বলে, আমি নাকি উনার ঘর-বাড়ি ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করছি। ইস্ কী চাবুকই না মারলো। আমার ঘর! আমার ছেলেপুলে!
শহর বন্দর গ্রাম- সব জায়গায় শুধু একই কথা, একই রব- সাধারণ সব মানুষেরা তার ঘর-বাড়ি ভাঙ্গার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। চাবুকওয়ালারা সবাইকে ধরে ধরে এনে আটকে রাখছে।
না, মানুষেরা এভাবে বসে থাকতে পারে না। আমাদের সন্তানেরা জেগেছে। ওরা সবাইকে একসাথে করলো। তারপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল সবাই একসাথে উনার ঘর-বাড়ি সত্যি সত্যিই এবার ভাঙবে। উনাকে আর থাকতে দেয়া হবে না। যতই চাবুকওয়ালা আসুক, ভয় পাবে না। ক’জনকে আর চাবুক মারবে।
সত্যি সত্যি ওরা বিশাল লোকবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চাবুকওয়ালারা মারতে আসে, কেউ সরে না। নড়ে না। এক চাবুকওয়ালা তো ভয়ে বলেই ফেলে, একটারে মারি। একটাই মরে। বাকিরা সরে না।
এ খবর যায় উনার কাছে। তার মনে পড়ে গেল বকতিয়ার আর লক্ষণ সেনের কথা। মনে মনে ভাবছে আমার কি তাই হবে? ভাবতে ভাবতে তার লোকেরা এসে বলে, আপনি তাড়াতাড়ি পালান, ওরা আপনার ঘর-বাড়ি ভাঙতে আসছে। রেহাই নাই আপনার। তাড়াতাড়ি
একটা দ্রুতগামী ঘোড়া এনে দিল উনাকে। উনি চড়লেন আর দ্রুত পালালেন। উনার বাড়ির কারো খোঁজ নিলেন না। একদম পালিয়ে ওপাড়ের রাজ্যে চলে গেলেন।
সবাই মুক্ত বাতাসে বড়ো একটা নিঃশ্বাসে নিলো।
একি...!
তিনদিন পরে উনি জানালেন, আমি চুপি চুপি আসবো। আজ তিন মাস পরে জানালেন, হে আমার বাড়ির লোকেরা, আমার আত্মীয়রা, আমি নগরের কেন্দ্রস্থলের সেই মাঠটায় আসব। তোমরা সবাই আসো। যারা আমার ঘর ভেঙেছে, তাদের উৎখাত করব।
হ্যাঁ, আমরাও কিন্তু আসব। আমাদের সন্তানরাও আসবে। তাকে ঠেকাতে আসব। তাকে আটকে দিতে আসব। দলে দলে আসব। তাকে আর ঘরের ত্রিসীমানাও ঘেঁষতে দেবো না। অনেক মেরেছে, অনেক জ্বালিয়েছে। আর না।
পাখি ডাকা স্নিগ্ধ সকালে আমি এলাম সেই কেন্দ্রস্থলের মাঠে। আরো মানুষ এলো দলে দলে। কিন্তু,
কিন্তু উনি তো এলেন না। উনার কোনো চাবুকওয়ালা এলো না। আত্মীয়রা এলো না। বাড়ির কেউ এলো না। সাঙ্গ-পাঙ্গ কেউ না।
উনিবিহীন শূন্যস্থানে আমি এখন দাঁড়িয়ে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা