১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অনন্য কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ। জন্ম : ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮, মৃত্যু : জুলাই ২০১২ -

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের একজন অনন্য সাধারণ কথাশিল্পী। তিনি নিজের মতো একটি গদ্যভাষা তৈরি করেছেন। যা আমাদের তরুণ তরুণীকে স্পর্শ করেছে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার আনন্দময় রূপকার। ছোট ছোট বাক্যে, সহজ ও সাবলীল ভাষায় তিনি সাজিয়েছেন তার কথামালা। জীবনকে একটু হেয়ালি একটু সহজ করে উপস্থাপনের ভঙ্গিটি তার একান্ত নিজস্ব। তার একটি উপন্যাস নিয়ে কথা বলা যাক-
একটি মাত্র সাল। তার মধ্যে অসামান্য গৌরব ও অন্তহীন বেদনার ইতিহাস লিখিত। রক্তে রঙিন লিপি। অহঙ্কারে শৌর্যে বীর্যে অত্যুজ্জ্বল। নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাসের নাম ‘১৯৭১’। কলেবর অতি সংক্ষিপ্ত। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের কথা আমরা জানি। ঔপনিবেশিক, স্বৈরাচারী, পাক হানাদার বাহিনী একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ওপর। জাতিতাত্ত্বিক বিলোপ সাধনের হিংস্র পাশবিক মনোবৃত্তি নিয়ে তারা তাদের বিকৃত লালসা চরিতার্থ করতে প্রয়াসী হয়েছিল। কিন্তু সক্ষম হতে পারেনি। বাঙালি মৃত্যুপণ জনযুদ্ধে জয়ী হয়। ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। সেই ক্যানভাসের বিস্তৃতি ও তাৎপর্য অনেক। নানা মাত্রিক। এর একটি অংশকে বিষয় করা হয়েছে এই উপন্যাসে।
ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামের নাম নীলগঞ্জ। একাত্তরের মে মাসে ঘটছে ঘটনা। নিস্তরঙ্গ জনজীবন এই জনপদে। পাক মিলিটারি হঠাৎই ঢুকে পড়ে এখানে। থানা গাড়ে স্থানীয় স্কুলঘরে। তাদের অপকর্মে হাত মেলায় এ দেশীয় দোসরেরা। হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ করে হানাদার বাহিনী তাদের স্যাডিস্ট নৃশংসতায় লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু। বীভৎস ঘটনা ঘটাতে থাকে একের পর এক। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে একাত্তর সালে এমন চিত্রই স্বাভাবিক ছিল নানা জায়গায়। কুশলী কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ নিপুণভাবে সেই চিত্র এঁকেছেন তার দরদি কলমে। স্বচ্ছন্দ্যে তিনি গল্প বলে যান। নির্বিকার, নির্মোহ সেই বয়ান। ঘটনা তার অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। শ্বাসরুদ্ধকর উৎকণ্ঠা নিয়ে পাঠক এগিয়ে যেতে থাকেন। সে আকর্ষণ চুম্বকের মতো। এখানেই ঔপন্যাসিকের সার্থকতা। গৌণ কিছু খুঁত যে একেবারেই নেই, তা নয়। তবে তা ধর্তব্যের মধ্যে নেয়া সমীচীন হবে না। ছিদ্র অন্বেষণের চাইতে এই উপন্যাসের বিষয়, মর্ম, শিল্পবুনট, সাহসী ও বিশ্বস্ত চিত্রায়নের ব্যাপারটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি।
বন্দী, অসহায় মানুষগুলোর মনের ভেতরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, ঘৃণা একসময় ফুটে বেরোয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তারা সেই ঘৃণার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। পাকিস্তানি মেজর এজাজের সহযোগী বাঙালিটির নাম রফিক। প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার আজিজুর রহমান মল্লিককে ধরে আনা হয়। মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। মসজিদের ইমামকে ধরে এনেও নির্যাতন চালানো হয়। আজিজ মাস্টারকে নিয়ে পৈশাচিক হাসি তামাশা করে পাক মেজর। কেমন সে নৃশংসতার নমুনা? নগ্ন করে ফেলা হয় তাকে। নির্দেশ দেয়া হয় তার পুরুষাঙ্গে ইটের টুকরো ঝুলিয়ে সমস্ত গ্রাম ঘোরাতে। পাক মেজরের বাঙালি সহচর রফিক বিপজ্জনক জেনেও এই নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করে।
...‘রফিক থেমে থেমে বলল মানুষকে এভাবে লজ্জা দেয়ার কোনো অর্থ হয় না।
মেজর সাহেবের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হতে থাকল। তিনি তাকিয়ে আছেন রফিকের দিকে। রফিক বলল আপনি যদি একে অপরাধী মনে করেন, তাহলে মেরে ফেলেন। লজ্জা দেয়ার দরকার কি?
-তুমি একে অপরাধী মনে করো না?
-না। আমার মনে হয় সে কিছু জানে না।
-সে এই গ্রামে থাকে, আর এত বড় একটি ব্যাপার জানবে না?
-জানলে বলত। কিছু জানে না, তাই বলছে না।
-বলবে সে ঠিকই। ইট বেঁধে তাকে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাও দেখবে তার মুখে কথা ফুটেছে। তখন সে প্রচুর কথা বলবে।
-রফিক ঠাণ্ডা স্বরে বলল স্যার, ওকে এ-রকম লজ্জা দেয়াটা ঠিক না।
-কেন ঠিক না?
-আপনি শুধু ওকে লজ্জা দিচ্ছেন না, আপনি আমাকেও লজ্জা দিচ্ছেন। আমিও ওর মতো বাঙালি।...’
গুলি করে মেরে ফেলা হয় হিন্দু নীলু সেনকে। পুড়িয়ে দেয়া হয় কৈবর্তপাড়া। নগ্ন আজিজ মাস্টারকে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জয়নাল মিয়ার মুখোমুখি করা হয়। আজিজ মাস্টার জয়নাল মিয়ার বাড়িতে থাকে। জয়নালের কিশোরী মেয়েকে মনে মনে ভালোবাসে, তাকে নিয়ে কবিতা লেখে। পাক মেজর জয়নালকে জানায় যে, এই নেংটো মাস্টার তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। জয়নাল শুনে হতভম্ব। নিপীড়নের একপর্যায়ে আজিজ মাস্টার দৃঢ় হয়ে ওঠে। মেজরকে বলে, আমি মরার জন্য প্রস্তুত আছি। আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচান। রাজাকাররা তাকে নিয়ে যায় বিলের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলঘরের পেছনে কয়েকটি গুলির শব্দ হলো। জয়নাল মিয়া থরথর করে কাঁপতে লাগল।
উপন্যাসের শেষাংশে সেই রফিককেও বিলে নামানো হয়। চাইনিজ রাইফেল হাতে দুই জওয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। বিলে রফিকের হাতে ঠেকে গুলিতে নিহত কৈবর্তপাড়ার বিরুর লাশ। বুক-পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা রফিককে মেজর এজাজ বলেন, রফিক তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও?
‘রফিক শান্ত স্বরে বলল চাই মেজর সাহেব। সবাই বেঁচে থাকতে চায়। আপনি নিজেও চান। চান না?
মেজর সাহেব চুপ করে রইলেন। রফিক তীক্ষ্ম স্বরে বলল মেজর সাহেব, আমার কিন্তু মনে হয় না আপনি জীবিত ফিরে যাবেন এদেশ থেকে।
মেজর এজাজ আহমেদ সিগারেট ধরালেন, কৈবর্তপাড়ার আগুনের দিকে তাকালেন। পশতু ভাষায় সাথে জওয়ান দু’টিকে কি যেন বললেন। গুলির নির্দেশ হয়তো। রফিক বুঝতে পারল না। সে পশতু জানে না।
হ্যাঁ, গুলির নির্দেশই হবে। সৈন্য দু’টি বন্দুক তুলছে। রফিক অপেক্ষা করতে লাগল।
বুক পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে লালচে আগুনের আঁচে যে রফিক দাঁড়িয়ে আছে, মেজর এজাজ আহমেদ তাকে চিনতে পারলেন না। এ অন্য রফিক। মেজর এজাজের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।’
একাত্তরের পটভূমিতে সুন্দর একটি উপন্যাস আমরা পেলাম হমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি নিজেও হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তার বেঁচে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের কথাশিল্প অনেক অনেক ঋদ্ধ হয়েছে। নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো সম্পর্কে তার নিজের ভাষ্য এ রকম : ‘লেখা হলো ১৯৭১, আগুনের পরশমণি, সূর্যের দিন। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতা এসব লেখায় ধরা পড়েছে এমন দাবি আমার নেই। দাবি এইটুকু আমি গভীর ভালোবাসায় সেই সময়ের কিছু ছবি ধরতে চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি তার বিচারের ভার আজকের এবং আগামী দিনের পাঠকদের ওপর।’
এভাবে তিনি তার নিজের দেখা চিত্র এবং দৃশ্যে ভাষা দিয়েছেন। তাকে স্মরণ করি আজ। তিনি বেঁচে থাকুন পাঠকের হৃদয়ে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল