রক্তাক্ত ১৯ জুলাই
- সাজেদা সুলতানা কলি
- ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
দরজায় জোরে জোরে করাঘাত হচ্ছে। রাস্তার জনস্রোত আর হইচইয়ের সাথে শব্দটা মিশে বোঝা যাচ্ছিল না কার দরজা। একটু পর বুঝতে পেরে মিলি দৌড়ে আসে। ভাবছে এত জোরে দরজা পেটাচ্ছে কে? মনে হচ্ছে বাইরে যে দাঁড়িয়ে তার খুব তাড়া। ছিটকিনিটা আলগা করতেই হুড়মুড়িয়ে কেউ একজন মিলির গায়ের উপর এসে পড়ল। মিলি সু রেকটা ধরে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে সামলায়।
তাকিয়ে দেখে বিশ বাইশ বছরের একটা ছেলে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় জানাচ্ছে কোনো কথা না বলতে। ততক্ষণে পরিবারের সবাই দরজার কাছে চলে এসেছে। কী কথা বলবে মিলির তো ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ছেলেটার চোখ দুটো রক্ত জবার মতো লাল। মাথার উসকোখুসকো ঘন চুলগুলোতে অনায়াসে ছোট ছোট অনেক জিনিস লুকিয়ে রাখা যাবে। আর চেহারায় মিনতি ঝরে পড়ছে। এই ফাঁকে ছেলেটা দ্রুত হাতে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডাইনিং রুম পার হয়ে ডানের রুমটাতে ঢুকে পড়ে। তার পেছনে পেছনে মিলির পুরো পরিবারও। রাজীব চিৎকার করে ওঠে!
- এই ছেলে! কে তুমি? হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ে একদম আমার বেডরুম পর্যন্ত চলে এসেছো!
- আংকেল! আমি রাজু! আমাকে বাঁচান! আমি পরে সব কিছু বলব। আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। আশ্রয় চাইতে এসেছি।
শুক্রবার দুপুরের পর রাস্তায় শোরগোল শুনে মিলি বারান্দায় যায়। একটু পর বিছানা ছেড়ে বাকিরাও আসে বাইরে কী হয়েছে দেখতে। বাসার সামনে শত শত মানুষের ভিড়। কেউ পায়ে হাঁটছে। কেউ বাইকে। কারো হাতে লাঠিসোটা, কারো হাতে রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র। এদের পেছন পেছন কিছু মাইক্রো বাসও আছে। সেখান থেকেও হ্যালমেট পরা কয়েকজন নামল হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প নিয়ে। এলাকার বাসাবাড়ির বারান্দায়, জানালায় শত শত উৎসুক মুখ। বোঝা যাচ্ছে এটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের চিত্র। এই আন্দোলনে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে পড়ে রাজু নামের ছেলেটা আত্মরক্ষার জন্য মিলিদের বাড়ির খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে এবং সোজা তিনতলায় উঠে আসে। মিলি রাজীবের একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার এনে দিয়ে ছেলেটাকে। পোশাক পাল্টে ঝটপট বিছানায় শুয়ে যেতে বলে। কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় আঘাত। এবার দরজা খুলে রাজীব। রাজুর বয়সী দুটো ছেলে বাইরে তাদের একজন জানতে চায়, আপনাদের বাসায় একটা ছেলে ঢুকেছে? রাজীব বলে, ‘না কোনো ছেলে তো ঢোকেনি!’ মিলির ছেলেমেয়ে দুইজনও বুঝে গেছে সেই ছেলেটাকে খুঁজতে এসেছে এরা। তারা বুঝতে পেরেছে বাবা-মা ও ছেলেটাকে এদের থেকে বাঁচাতে চাইছেন। তাই তারাও চুপ করে আছে।
অন্য ছেলেটা গোঁয়ারের মতো বলে ওঠে, এতো জিজ্ঞেস করার কী আছে? চল ঘরে ঢুকে খুঁজে দেখি। শালা! আজকে বাঁচতে পারবে না। রাজীব প্রতিবাদ করে উঠল। ঘরে ঢুকবে মানে কী? তোমরা চাইলেই কি কারো ঘরে ঢুকে পড়তে পারো?
এবার ছেলেটা হালকা অনুরোধের সুরে বলে, আঙ্কেল আমরা ঘরে ঢুকে একটু দেখি! আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমরা দেখেই চলে যাবো। পেছন থেকে মিলি বলে, ‘ঠিক আছে তোমাদের বিশ্বাস না হলে ঘরে এসে দেখো’ বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। ওরা দু’জন বাথরুম, রান্নাঘর, বারান্দা সব খুঁজল। শেষে বেডরুমে ঢুকল। মাস্টার বেডরুমটা ফাঁকা। সেখানে কেউ নেই। ডাইনিং রুমের বাম পাশের রুমটা দেখে ডানেরটাতে ঢুকে অন্ধকার রুমে মোবাইলের আলো জ্বেলে বিছানার দিকে তাকায়। দু’জন একসাথে বলে ওঠে, এটি কে? মিলির ঝটপট উত্তর... আমার বড় ছেলে। দ্বিতীয় ছেলেটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, আপনার বড় ছেলে এত হট্টগোলের মধ্যে ঘুমাচ্ছে কিভাবে? মিলিও উত্তর রেডি করে রেখেছে। আমার বড় ছেলে তোমাদের আমাদের মতো নয়। ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। ওষুধ খাইয়ে ওকে ঘুম পাড়াতে হয়। তা ছাড়া ওর মাইগ্রেন আছে। ব্যথা উঠলে আলো আর চিৎকার চেঁচামেচি একদম সহ্য করতে পারে না। তাই রুম অন্ধকার করে ওকে এখানে ঘুম পাড়িয়েছি। ওরা কিছুটা বিস্ময় কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে মিলির দিকে তাকায়। তার পর চাদরটা সরিয়ে দেখে আবার টেনে দেয়। দু’জন বলাবলি করে- ওই বেটার পরনে তো ছিল লাল টিশার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট! তাহলে তো মনে হয় এরা সত্যি বলছে।
- হ্যাঁ তাই তো দেখছি! বলে দু’জন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ইতিমধ্যে মূল দরজার সামনে আরো দু-তিনজন এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরের দু’জন বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘না এখানে কেউ নেই আমরা দেখেছি।’
ভাগ্য ভালো মিলিদের বাড়িওয়ালা আজকে কোনো কারণে নিচের গেট এবং ছাদের দরজা খোলা রেখেছিলেন। কারণ রাজুকে খুঁজতে আসা ছেলেগুলো ছাদে গিয়ে দেখেছে পাশের বাড়ির ছাদটা একদম লাগোয়া। তাদের ধারণা রাজু সেখান দিয়ে পালিয়ে গেছে। মিলিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে রাস্তায় ছেলেগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। তবে কে জানে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। মিলি রাজুর রুমের আলো জ্বালিয়ে দিলো। ছেলেটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে! দেখে মনে হচ্ছে সারাদিনে নাওয়া খাওয়া হয়নি। খুঁজতে আসা ছেলেগুলো বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে মিলি ছেলেটাকে ডেকে তুলে।
- এখন তোমার আর কোনো ভয় নেই। ফ্রেশ হয়ে এসো। কিছু খেয়ে নাও। তার পর তোমার কথা শুনব।
- আন্টি আপনাদেরকে ঝামেলার মধ্যে ফেলে দিয়েছি। আসলে আমার কোনো উপায় ছিল না। মরণে আমার ভয় নেই। কিন্তু মায়ের জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। আপনার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।
রাজুকে ঘিরে বসেছে সবাই। অল্প সময়ের মধ্যে সে এই পরিবারেরই একজন। সে বলতে শুরু করেছে... আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তার জন্য আমার বিশেষ কোনো সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বিষয়টি আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। বাবা মারা গেছেন দশ বছর আগে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবার পরিচয় ছিল কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর তিন বছর পর আমাদের পরিবারে ভয়ঙ্কর দুর্দশা নেমে আসে। আমরা দুই ভাই। ভাইয়ার সাত বছরের ছোট আমি। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভাইয়ার একটা চাকরি হওয়ার কথা ছিল। লিখিত পরীক্ষায় পাশও করেছিল। কিন্তু গ্রামের অর্ধশিক্ষিত এক লোক নাম- খলিলুর রহমান কিভাবে যেন এক রাজনৈতিক বড় নেতার ছত্রছায়ায় এসে হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছা হয়ে ওঠে। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা করে বিদেশ চলে যাওয়া এই লোক দেশে ফিরে এসে ওই নেতার নেক নজরে পড়ে। সে সমাজে নিজের পজিশন পাকাপোক্ত করার জন্য সুযোগের প্রথম ধাপ হিসেবে বেছে নেয় বাবার নামে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। সেই স্বপ্ন সফল করার জন্য তুরুপের তাস হিসেবে বেছে নেয় আমার বাবা ও দাদার নাম। তার ও আমার দাদার নাম বজলুর রহমান। আমার বাবার নাম হাবিবুর রহমান আর সেই অর্ধ শিক্ষিত লোকের বাবার নাম মহিবুর রহমান। এই মহিবুর রহমান নামটাকে সে খয়ের খাঁ রাজনৈতিক নেতার মাধ্যমে হাবিবুর রহমান করে নেয়। যেহেতু দাদার নাম, গ্রামের নাম একই এবং বাবার নামেও মিল আছে সেহেতু এটাকে নামের বানান ভুল হয়েছে বলে খুব সহজে ঠিক করে মহিবুর করে নেয়। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমাদের গ্রামের শুধু একজনের কথা উল্লেখ থাকায় সংশোধনের পর স্বাভাবিকভাবেই মহিবুর রহমানের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এনআইডি কার্ডে তখনো মায়ের নাম সংযোজনের প্রচলন না থাকায় এই নাম সংশোধনের বিষয়টি তাদের জন্য আরো সহজ হয়ে যায়। এবং এসব কাজ করে আমার আপন জেঠাতো ভাইয়ের সহযোগিতায়। তারা আমার ভাইয়া যে মন্ত্রণালয়ে চাকরির আবেদন করেছে সেখানে গিয়ে বলে আসে বানান ভুলের জন্য মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় আমার বাবার নাম আসে। আসল মুক্তিযোদ্ধা যিনি তার নাম মহিবুর রহমান। ভাইয়া ভাইবার চিঠি পেয়ে নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে শোনে এই কাহিনী। উল্টো প্রতারণার অভিযোগে ভাইয়াকে অভিযুক্ত করা হয়। এ ঘটনায় ভাইয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। চাকরি না হওয়ার থেকেও বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তার পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে ভেঙে যায় বলে। মেয়েপক্ষের কথা ছিল চাকরি হলে তারা মেয়ে বিয়ে দেবে। পরপর দুটো ধাক্কা ভাইয়া সামলাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যা করে। মা আর আমি ভাসতে থাকি অকুল সাগরে। আমি তখন মাত্র এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর জেঠাতো ভাইয়েরা আমাদেরকে টিকতে দেয়নি। তার পর এক দিন আমরা ঢাকায় চলে আসি। খিলগাঁও তালতলার দিকে সাবলেট বাসা নেই। এখনো সেখানেই আছি। আমার মা অন্য এলাকায় এক বৃদ্ধ দম্পতির রান্নার কাজ করে।
সবাই মনোযোগ দিয়ে রাজুর জীবনের গল্প শুনছিল। মিলি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে তোমার মা অন্য এলাকায় কেন কাজ করেন ?
এলাকায় আমার বন্ধুবান্ধবরা জানবে তাই। আমার স্টুডেন্টরা জানে আমি শিক্ষিত মায়ের সন্তান। রাঁধুনির কাজ করে জানলে আমার টিউশনগুলো নাও থাকতে পারে। একটা চাকরি হলে মাকে আর কাজ করতে দেবো না।
মিলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছেলেটার কথাগুলো শোনে। এত অল্প বয়সী একটা ছেলে কতটা মেধাবী হলে এমন তীক্ষè বোধবুদ্ধিসম্পন্ন ও দূরদর্শী হতে পারে! সংগ্রামী জীবন ছেলেটাকে মায়ের প্রতি দায়িত্বশীলও করে তুলেছে। আজকাল যেখানে ঘরে ঘরে নেশার টাকা জোগাড় করতে মা-বাবার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করে না, সেখানে এই ছেলে তো হীরার টুকরা। ছেলেটাকে বিপদে আশ্রয় দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছে মিলি। এমন ছেলে সব মায়ের বুকজুড়ে বেঁচে থাকুক।
মমতাজ বানু আজকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছেন। ছেলে এখনো ফেরেনি দেখে ফোন করে। কিন্তু ছেলে ফোন বাসায় রেখে গেছে। দেশের অবস্থা ভালো না। খুব চিন্তা হচ্ছে। ছেলেটা কোথায় গেল? ছেলের ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে অনেকগুলো মিসড কল দেখে কল ব্যাক করেন। বুকটা হালকা লাগছে। ছেলে জরুরি কাজে আটকে পড়েছে। চিন্তা করতে নিষেধ করল। তবে বাসা ছেড়ে আপাতত কাজের বাড়িতে যেতে বলেছে। ছেলের ওপর মমতাজ বানুর পূর্ণ আস্থা আছে। তাই কোনো প্রশ্ন না করে তখনই বেরিয়ে পড়েন।
কাক ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে মিলি তার অব্যবহৃত বেডপ লম্বা বোরকাটা বের করে রাজুকে পরতে দেয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুখে মাস্ক আর মাথায় হিজাব পেঁচিয়ে রাজু বাইরে অপেক্ষমাণ সিএনজিতে উঠে পড়ে। যেতে যেতে মমতাজ বানু ছেলের মুখে সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন। বৃদ্ধ মুনিম সাহেব আর তার স্ত্রী, মা ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রাজু ঘরে ঢুকতেই বলে ওঠেন, ইয়াং ম্যান! যে মহীয়সী তোমাকে আশ্রয় দিয়েছে তার সাথে আমাকে এক দিন পরিচয় করিয়ে দেবে। আমি তাকে প্রাণ ভরে দোয়া করে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। রাজু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালে মমতাজ বানু সব খুলে বলেন। রাজুর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন শুনে মুনিম সাহেব পুরনো অ্যালবাম থেকে একটা ছবি খুঁজে বের করেন। মমতাজ বানু ছবিটা দেখেই স্বামীকে চিহ্নিত করেন। মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান যে গ্রুপে ছিলেন মুনিম সাহেব ছিলেন সেই গ্রুপের কমান্ডার। প্রশিক্ষণের ফাঁকে তোলা গ্রুপ ছবিটা যুদ্ধের পর এক ফটোসাংবাদিকের কাছ থেকে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। মুনিম সাহেব রাজুকে আশ্বাস দিলেন দেশের চলমান পরিস্থিতি শান্ত হলে তিনি এই বিতর্কের সমাধান করার সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন।
মমতাজ বানু পাঁচ বছর হলো মুনিম দম্পতির রাঁধুনির কাজ করছে। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। একই বাড়িতে তারা আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। মুনিম সাহেব যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেটার একটা রুম রাজুদের মা-ছেলের জন্য ছেড়ে দিলেন। পড়াশোনা শেষ করে রাজুর একটা চাকরি পাওয়া পর্যন্ত তারা এখানেই থাকবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশ উত্তাল। খোদ মুক্তিযোদ্ধারাও বলছেন মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে কোটা প্রথা বাতিল করা উচিত। যে হারে আরব্য রজনীর গল্পের দৈত্যের মতো (একটা দৈত্যের এক ফোঁটা রক্ত থেকে হাজারটার জন্ম) মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে তাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানই হচ্ছে। কারণ একাত্তরের যুদ্ধোত্তর বিবাহিত দম্পতির সন্তানও যদি মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায় তাহলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যে সমাজে হাসির পাত্র হতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্ষমতাসীন সরকারের মজবুত ভিতটা নাড়িয়ে দিয়ে সরকারের পতন ত্বরান্বিত করেছে।
রাজনীতির পটপরিবর্তন হয়েছে। সরকারেরও পতন হয়েছে এবং নতুন সরকার গঠিত হয়েছে।
বর্তমান সরকার উদ্যোগ নিয়েছেন তৃণমূল পর্যায় থেকে মৃত জীবিত সব মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করা হবে। এবারের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আর কোনো ফাঁকফোকর থাকবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বাছাইয়ের কাজ শুরু হবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। পরিষদের চেয়ারম্যান তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে উপজেলা পরিষদে জমা দিবেন। তথ্যে গরমিল বা সন্দেহজনক কিছু দেখলে সেটিকেও চিহ্নিত করে উপজেলা পর্যায়ে উপস্থাপন করবেন। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যানও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি গিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ লোকজনের কাছ থেকে তথ্য জেনে সত্যতা যাচাই করবেন এবং সব তথ্য নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করে জেলা প্রশাসকের কাছে পেশ করবেন। যদিও কাজটি শেষ করতে সময় লাগবে তবুও সরকারের এ উদ্যোগে অনেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। রাজুরা মা ছেলেও একটা আশার আলো দেখল। সরকারের এ উদ্যোগ সফল হলে অন্তত তারা তাদের হারানো সম্মানটা ফিরে পাবে।
নব গ্রামের খলিলুর রহমানের কাছে রেজিস্ট্রি করা একটা চিঠি এসেছে। খাম দেখে বোঝা যাচ্ছে চিঠিটা সরকারি এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খলিলুর রহমান চিন্তায় পড়ে যায়। এ চিঠি তাকে কে দিলো! দুরু দুরু বুকে সে খামটা খোলে। পড়া শেষ করে দৌড়ে যায় পশ্চিমপাড়ার ফজলুর কাছে। চিঠি পড়ে ফজলুর অভয় দিয়ে বলল...
- খলিল ভাই চিন্তার কিছু নেই। সরকার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করছে। আর আপনার তো সব কাগজপত্র, সনদ ঠিকঠাক আছে। ভয়ের কিচ্ছু নেই। সময়মতো সব কিছু নিয়ে যাবেন। প্রয়োজন হলে আমিও যাবো আপনার সাথে।
- শুনেছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাগজপত্র দেখছেন। তাহলে আমাকে কেন ঢাকা যেতে বলেছে? আমার বাড়িতে এসেই তো দেখতে পারতেন।
- আরে খলিল ভাই! আপনাকে পুরস্কার আনতে চিঠি দিয়েছে। এটি তো খুশির খবর! আর আপনি চিন্তা করছেন! পুরস্কারের কথা শুনে আবার একা একা চলে যাবেন না। আমিও কিন্তু আপনার সাথে যাবো।
খলিলুর রহমান রহমান আর ফজলুর রহমান অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে মইন হায়াত খানের কক্ষে। উনার আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। পিয়ন ছেলেটা অবশ্য চা বিস্কুট দিয়ে গেছে। ফজলু খলিলুরকে বোঝাচ্ছে, তোমার মতো আরো অনেকে পুরস্কার পেয়েছে। উনারা ব্যস্ত মানুষ। এত লোকজন সামলানো কি চাট্টিখানি কথা? একটু তো সময় লাগবে। একটু পর হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক। ইনিই জারিফ হায়াত খান। যিনি খলিলুর রহমানকে চিঠি পাঠিয়েছেন।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে জারিফ বললেন...
- দুঃখিত আপনাদেরকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি বলে।
- না, স্যার অসুবিধা নেই। আপনারা ব্যস্ত মানুষ। আপনাদের সময়ের তো মূল্য আছে। কণ্ঠে বিনয় ঝরিয়ে বলল ফজলু।
- আপনিই কি খলিলুর রহমান?
- না স্যার! আমার নাম ফজলুর রহমান। পাশে দেখিয়ে বলে ইনি খলিলুর রহমান। পাশ থেকে খলিলুর রহমান বলে, উনি আমার গ্রামের বন্ধু, বড় ভাই।
মনে মনে হাসলেন জারিফ খান। এ যে দেখছি মেঘ না চাইতে জল!
- দাঁড়ান আপনাদেরকে একটা ছবি দেখাচ্ছি বলে, জারিফ খান হলদেটে হয়ে যাওয়া একটা পুরনো সাদাকালো ছবি তাদের সামনে মেলে ধরে বললেন, এটা সাত নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজনের ছবি। সামনে ক্যাপ পরা ভদ্রলোক উনি আমার বাবা। তিনি কমান্ডার ছিলেন। বাকিদের মধ্যে কাউকে আপনারা চেনেন? একজনের ছবিতে আঙুল রেখে তারা দুজনেই বলে, এই যে উনাকে চিনি। ফজলু তাড়াতাড়ি বলে উঠে, উনিই তো খলিলের বাবা! খলিল তুমি চিনতে পারছ না?
- উনি নিজের বাবাকে চিনতে পারছেন না অথচ আপনি কত সহজে চিনতে পেরে গেছেন। একেই বলে বন্ধুত্ব! জারিফ খানের গলায় টিপ্পনি কাটার সুর। ফজলু সেটা ধরতে পারেনি। কিন্তু খলিলুরের ভেতরটা খুব খচ খচ করছে।
- জি চাচা ডাকতাম ওনাকে। আমাদেরকে খুব আদর করতেন। উনাকে চিনতে আমার কখনো ভুল হবে না।
- খলিল সাহেব আপনার পুরস্কারটা তিন নম্বর রুমে এন রহমানের কাছে আছে। পিয়ন ছেলেটাকে ডেকে দিচ্ছি আপনারা তার সাথে যান।
তিন নম্বর রুমে ঢুকে তাদের দু’জনকে দেখে মনে হলো তারা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। তবে দু’জনই মুহূর্তে নিজেদেরকে সামলে নেয়। খলিলুর রহমান হাত বাড়িয়ে এন রহমান মানে নাঈমুর রহমানের হাত থেকে খামটা নেয়। দু’জন বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে শুনতে পায় নাঈমুর রহমান বলছে, ফজলু সাহেব! আপনার জন্যও একটা পুরস্কার আছে। সেটিও নিয়ে যান। বলে এন রহমান ফজলুর হাতেও একটা খাম তুলে দেয়। ফজলু রুমে ঢুকে যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি অবাক হলো তার জন্যও পুরস্কার আছে শুনে। বাইরে এসে দু’জন খাম খুলে দেখে সরকারের সাথে প্রতারণার অভিযোগে এবং প্রতারণায় সহযোগিতা করার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। অভিযোগ স্বীকার করে নিলে শাস্তি কিছুটা কম হবে। খলিলুর রহমানকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে এত বছর যে টাকা আত্মসাৎ করেছে সেগুলো সব লাভসমেত ফেরত দিতে হবে এই মর্মে নোটিশ দেয়া আছে!
নাঈমুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের ছোট ছেলে রাজু । কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যাকে মিলি নামের এক গৃহবধূ আশ্রয় দিয়েছিল।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা