হেমন্ত নেই হেমন্ত আছে
- আলাউদ্দিন কবির
- ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০৫
‘মরুর দেশ’ বললেই যেমন মনে পড়ে যায় আরব দেশের কথা, তেমনি ‘ষড়ঋতুর দেশ’ শব্দবন্ধটি শুনতেই মনের মুকুরে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের ছবি। বাঙালি মননে যেসব শব্দবন্ধে স্বদেশের পরিচিতি বিধৃত, ‘ষড়ঋতুর দেশ’ তার একটি। পৃথিবীর আর কোনো দেশের এমনসব পরিচিত-নাম রয়েছে কিনা আমার জানা নেই। নদীমাতৃক দেশ, আউল-বাউলের দেশ, পীর-আউলিয়ার দেশ, ধান ও গানের দেশ, লাল-সবুজের দেশ। আরো কত-কত শব্দবন্ধের বাঁধনে ধরার প্রয়াস, ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত প্রিয় স্বদেশের চারিত্র্য-বিভূতি।
এদেশে ঋতুকেন্দ্রিক হিসাবটাও বেশ মজার বটে! প্রতি ঋতুর ভাগে দুই-দুই মাস। সে হিসেবে হেমন্তের ভাগে পড়ে কুয়াশার কার্তিক আর পাকা ধানের অঘ্রাণ। হেমন্তের একরৈখিক আলোচনার আগে কার্তিক আর অঘ্রাণের দ্বিরৈখিক অথচ প্রায় অভিন্ন চারিত্র্য তুলে ধরার চেষ্টা করা যাক।
এ কথা এখন শতসিদ্ধ আর সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের প্রকৃতির প্রকৃততর আর শিল্পোত্তম চিত্র তুলে ধরতে সর্বপ্লাবী সামর্থ্যরে স্বাক্ষর রাখতে সফলভাবে উতরে গেছেন, বাংলা ভাষার আধুনিকতম অথচ প্রচারবিমুখ আর জীবৎকালে প্রায়-উপেক্ষিত শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ মানুষের হলাহলের চেয়ে প্রকৃতির কোলাহল বেশি ভালোবাসতেন। তাই তিনি পিরিতির চেয়ে প্রকৃতিতেই প্রভূত প্রশান্তি পেতেন। আমাদের আলোচ্য হেমন্তের দু’ মাস- কার্তিক আর অঘ্রাণের ভিন্ন ভিন্ন চিত্র যেমন তিনি এঁকেছেন, তেমনি তিনি একান্ত নিজস্ব কাব্যশৈলীতে তুলে ধরেছেন হেমন্ত ঋতুর একক চিত্রের চারিত্র্য। তাই হেমন্ত চেনার জন্য, হেমন্ত আত্মস্থ করার জন্য বিরূপ প্রকৃতির এই সময়ে জীবনানন্দের সৃষ্টি সমাহার আর কাব্যবাহারের দ্বারস্থ হওয়াই হতে পারে সঠিক ও সহজ উপায়।
কার্তিকের কী অসাধারণ ছবিই না এঁকেছেন জীবনানন্দ তার কবিতার অনিন্দ্য ছবিতায়-
‘কার্তিকের ভোর বেলা কবে
চোখে মুখে চুলের ওপরে
যে শিশির ঝরল তা
শালিক ঝরাল বলে ঝরে...’
[অপ্রকাশিত কবিতা, কার্তিক ভোরে : ১৩৪০]
শুধু কি কার্তিক? অঘ্রাণ তথা অগ্রহায়ণের বর্ণনাও কি কম দিয়েছেন রূপসী বাংলার জীবনানন্দ? অঘ্রাণের আঘ্রাণে বিমোহিত হয়ে তিনি লেখেন-
‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রঙ-রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালুমাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি-
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে-কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,
ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে-জীবনেরে জেনেছে সে-কুয়াশায় খালি
তাই তার ঘুম পায়-ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনই সে- ক্ষেতের ভিতর
এখনই সে নেই যেন-ঝরে পড়ে অঘ্রাণে এই শেষ বিষণœ সোনালি...’
[অপ্রকাশিতকবিতা, আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি]
তবে জলবায়ুর অস্বাভাবিক আচরণে ইদানীং ছয় ঋতুর কয় ঋতু যে সত্যি সত্যি ধরা যায়, তা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ। হালফিল সমীক্ষায় কোনো বেরসিক বাঙালি যদি বলেই ফেলেন, ‘ত্রিঋতুর দেশ বাংলাদেশ।’ তাকে খুব একটা দোষী করা যায়? যাবে? আজকাল গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ছাড়া বাকি তিন ঋতুর যে লুকোচুরি চলমান, সে নিরিখে ষড়ঋতু না ত্রিঋতু- প্রশ্নটি যেন কোটি টাকার! হ্যাঁ, ধরা যাক আর না যাক। আগের সেই হেমন্ত-ফ্লেভার মিলুক বা না মিলুক। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাঠ্যপুস্তকে তখনো এবং এখনো বাঙালি মাত্রই নতমস্তকে জেনেছে ও জেনে যাচ্ছে, আমাদের বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ!
প্রকৃতির মন খারাপের কারণে হয়তো আর আগের মতো শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত আমাদের চোখে ধরা দেয় না। তাই বলে কি মন খারাপ করে বসে থাকা যায়? আবহমানকাল থেকেই তো এ ভূখণ্ডের মানুষ, আমাদের তামাটে পূর্বপুরুষরা গ্রীষ্মের খরতাপ, বর্ষার বারিধারা, শরতের সাদা মেঘ, হেমন্তের পাকা ধান, শীতের রুক্ষভাব আর বসন্তের পুষ্পাল আবাহণে অভ্যস্ত। আচ্ছা, হেমন্ত যে একটা সময়ে এসে এহেন লুকোচুরি খেলবে, তা কি শুদ্ধতম কবির বীক্ষণযন্ত্রে সেই ষাট-সত্তর বসন্ত আগেই ধরা পড়েছিল? না হলে তিনি কেনো বহু বছর আগেই লিখে গেলেন-
‘শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন!
হেমন্ত আসেনি মাঠে-হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!’
[ধূসর পাণ্ডুুলিপি, জীবন]
যাই হোক, যেমনই হোক। হেমন্ত মানেই মাঠে মাঠে পাকা ধান, ধান কাটার ধুম। সমর্থ কৃষক পরিবারে পিঠা-পুলি তৈরির ত্রস্ততা। নতুন ধানের চালে বাড়ি বাড়ি পায়েস আর মধুভাতের অঘোষিত উৎসব। গ্রামের হাটখোলায়, বয়েসী বটের ছায়ায় হেমন্তকালীন মেলা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনপদে বৌ-ঝিদের নাইয়র আনা-নেয়ার পালা এবং হৈমন্ত কবিতায় ভরে-ওঠা কবিদের পাণ্ডুলিপি [পড়–ন, ফেসবুকীয় টাইমলাইন]!
প্রকৃতির বরপুত্র জীবনানন্দ হেমন্তকে বরণ করে লেখেন-
‘...হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে
হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে
দু-একটি সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝাড়ে উড়ে চুপ সন্ধ্যার বাতাসে
লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে...’
[বনলতা সেন, অঘ্রাণ প্রান্তরে]
দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, কলকারখানামুখী অর্থনৈতিক প্রবণতার প্রাবল্যের কারণে আজ বাংলাদেশে কৃষকের সংখ্যা ও ধানি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে বৈ কি! অথচ একসময় পল্লীবন্ধু এরশাদের স্লোগান ছিল- ‘৮৬ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’। এখন এরশাদ যেমন অতীত, তেমনি তার স্বপ্নের ৮৬ হাজার গ্রামের সংখ্যাও কয় হাজারে ঠেকেছে বলা মুশকিল। কিন্তু এটুক অবশ্য নিঃশঙ্কচিত্তে বলা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যতা, অন্ন-অভাব তথৈবচ হলেও গ্রামের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, আশঙ্কাজনক হারে কমছে। সমান তালে কমছে কৃষক পরিবার। কমছে ধানি জমির পরিধি ও আকারও!
গ্রাম কমে যাওয়ায় গ্রামীণ মেলাও এখন আর সেভাবে চোখে পড়ে না। তবু এখনো এদেশে হেমন্ত আসে। এখনো মন কাড়ে মাঠে মাঠে পাকা ধানের সোনালি হাসি। জৌলুশ হারালেও আজো কৃষকরা মেতে ওঠেন নবান্ন উৎসবে। প্রায় গ্রাম মফস্বল শহর এবং প্রায় শহর উপশহর আর নগরী-মহানগরীতেও আয়োজন করা হয়, হেমন্তকালীন পিঠা উৎসবের। আজো আমরা মোহিত ও বিমোহিত হই অঘ্রাণের আঘ্রাণে!
তাই বলাই যায়, হেমন্ত আছে যেমন সত্যি, হেমন্ত নেইও তেমন মিথ্যে নয়! হেমন্ত নেই আগের মতো-পাকা ধানের প্রাচুর্যে, জৌলুশি নবান্ন উৎসবে এবং বিপুল উদ্দীপনাময় গ্রামীণ মেলায়। হেমন্ত আছে-ক্যালেন্ডারে-পঞ্জিকায়, ছড়ায়-কবিতায় এবং হারাতে হারাতে না-হারানো হেমন্তের বৈকালিক হিমেল হাওয়ায়!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা