০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

শিল্প ও সাহিত্যের উপজীব্য

শিল্প ও সাহিত্যের উপজীব্য -

‘গ্রাহক প্রায়ই পণ্য কিনে তারা সেটা চায় সেজন্য নয়, বরং তাদের কাছে সেই পণ্য কিভাবে উপস্থাপন করা হয় তার জন্য।’ জেমস ক্লিয়ার তার `Atomic Habit’ বইয়ে গ্রাহকের মনস্তাত্ত্বিকতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কথা উল্লেখ করেছেন । একই ধরনের কথা অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসও বলেছিলেন পণ্যের মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে। জবসের কথার ভাবার্থটা এমন, ‘ক্রেতা নিজেই জানে না তার কী প্রয়োজন। পণ্যকে তার প্রয়োজন উপযোগী করে উপস্থাপন করতে পারলে তার কাছে তা প্রয়োজনীয় মনে হয় ।’
জেমস ক্লিয়ার এবং স্টিভ জবসের এই কথা যদি আমরা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চিন্তা করি তাহলে কী দেখতে পাই? আসলে পাঠক বা দর্শক নিজেই জানে না সে আসলে কী চায়। লেখক, সাহিত্যিক, নির্মাতা ও সংস্কৃতিমনা মানুষ যখন সচেতনতার সাথে কোনো সাহিত্য ও শিল্পকর্মকে তাদের সামনে প্রয়োজন উপযোগী করে উপস্থাপন করেন তখন সেই সাহিত্যকর্ম, নাটক, সিনেমা, গান তথা সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ তাদের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে ।
তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমন সরল পাঠক ও দর্শক যারা আদতে জানেই না তাদের কী প্রয়োজন, তাদের সামনে সাহিত্যিক, লেখক, নির্মাতা ও শিল্পীদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? এমন সরল পাঠক ও দর্শকের জন্য সৃষ্ট তাদের শিল্প ও সাহিত্যকর্মের উপজীব্যই বা কী হওয়া উচিত? তা কি শুধু ‘Art for art sake’ হবে? না কি তা হতে হবে ‘Art for Humanity sake’?
এক্ষেত্রে লেখক, সাহিত্যিক, নির্মাতা ও শিল্পীদের হতে হবে অনেক বেশি সচেতন। সরল, সহজ পাঠকদেরকে শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে এমনভাবে আকৃষ্ট করতে হবে, যেন সৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্প তাদের মনো-দৈহিক বিনোদনের চাহিদা শুধু মেটাবে তা না; বরং তা তাদের জীবনগঠনে ভূমিকা রাখবে । দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে এরকম সাহিত্য ও শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে হবে লেখকদের; নির্মাতাদের এমন নাটক ও সিনেমা বানাতে হবে যেন তা দর্শকদের ধর্মীয় মূল্যবোধ গঠনে, তাদের বিবেককে জাগ্রত করতে, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা রাখে সবচেয়ে বেশি। সামগ্রিকভাবে পাঠক ও দর্শককে সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে অনুপ্রাণিত করবে এমন কিছু সৃষ্টি করতে হবে। দেশ ও জাতির জীবন ও ভবিষ্যৎ গঠনে লেখক ও শিল্পীদের সমাজের জন্য যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে তাদের শিল্পের সঠিক বিষয়বস্তু নির্বাচন ও তা উপস্থাপনের মাধ্যমে। E. B White লেখকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে সংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন । তিনি বলেছেন, ‘একজন লেখকের কর্তব্য হচ্ছে ভালো হওয়া, খারাপ হওয়া নয়; সত্য, মিথ্যা নয়; প্রাণবন্ত, নিস্তেজ নয়; সঠিক, ত্রুটিপূর্ণ নয়; তার উচিত লোকদের ওপরে তোলার প্রবণতা ধারণ করা, তাদেরকে নিচে নামানো নয়। লেখকরা কেবল জীবনের প্রতিফলন এবং জীবনকে ব্যাখ্যা করেন না, তারা অবহিত করেন এবং জীবনকে গঠন করেন।’
অর্থাৎ লেখকের দায়িত্ব হচ্ছে সততা, সত্যনিষ্ঠা ও প্রাণবন্ততার মাধ্যমে পাঠক, সমাজ তথা জাতির মূল্যবোধ ও জীবনগঠনে কাজ করা ।
জাতি, সমাজ ও দেশ নির্মাণে লেখক, সাহিত্যিক, নির্মাতা ও শিল্পীরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে । কোনও জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারলে সেই জাতি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে। দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, বিকাশ ও বিবর্তন হয় সাধারণত লেখক, সাহিত্যিক, নির্মাতা ও শিল্পীদের মাধ্যমেই। তাই তাদেরকে অনেক বেশি সচেতন ও মনোযোগী হতে হবে তাদের সাহিত্য ও শিল্প চর্চার বিষয় বা উপজীব্য নির্বাচনে।
লেখক, সাহিত্যিক ও নির্মাতাদের তার শিল্প ও সাহিত্যের উপজীব্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পাঠক বা দর্শকের মনোরঞ্জনের দিকে নজর না দিয়ে তাদের জন্য কী প্রয়োজন তা মাথায় রাখতে হবে সব সময়। অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে পাঠক ও দর্শকের মনোযোগ পাওয়ার জন্য লেখক ও নির্মাতারা অজান্তেই পাঠকের সুকুমার বৃত্তিধ্বংসকারী নানা উপাদান যেমন যৌন আবেদনময় কথামালা বা দৃশ্য সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেন তাদের সাহিত্য বা শিল্পকর্মে। হয়তো পাঠক বা দর্শকের সাময়িক মনোযোগ তারা পান, জনপ্রিয় হয়েও ওঠেন কিন্তু তাদের সেই জনপ্রিয়তা কখনো স্থায়ী হয় না। সময়ের আবর্তনে অতি দ্রুত হারিয়ে যায় ।
দর্শকের মনোরঞ্জনের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়ার জন্যই আজ ভারতের বলিউডের সিনেমা ভারতের দক্ষিণি মুভির কাছে হেরে গেছে। ভারতের অধিকাংশ সিনেমাতে প্রেম, রোমাঞ্চ, যৌনতাকে উপজীব্য করা হয়; কিন্তু দক্ষিণি মুভিতে থাকে মানুষের জীবনবোধ ও মূল্যবোধের গল্প। দক্ষিণের তেলেগু ছবির জনপ্রিয় অভিনেত্রী তামান্না ভাটিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বলিউডের তুলনায় দক্ষিণি ছবি দর্শকের কেন বেশি ভালো লাগছে?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণি ছবিগুলোতে মানবিক আবেগ; মা, বাবা, ভাই, বোন নিয়ে সম্পর্কের দিকগুলোকে অনেক সুন্দর করে তুলে ধরা হয় । দক্ষিণি ছবিতে সেই বিষয়গুলো দেখানো হয়, যার সম্পর্কে নির্মাতারা সম্পূর্ণভাবে অবগত। বলিউডে অনেক সময় শুধুমাত্র দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য ছবি নির্মাণ করা হয় । তাই সেটা অনেক সময় কার্যকর হয় না।’
তিনি আরো বলেন, ‘দক্ষিণি ভারতীয় ছবির কাহিনী শিকড়ের সাথে যুক্ত, অর্থাৎ এখানকার ছবিগুলো মাটির সাথে মিশে আছে। তাই বৈশ্বিক স্তরে দক্ষিণ ভারতীয় ছবি এত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ...।’
পাঠক বা দর্শকের মনোরঞ্জনের দায় কাঁধে না নিয়ে লেখক, নির্মাতা বা শিল্পীদেরকে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব সময় চিন্তা করতে হবে। তাদের লেখায় থাকতে হবে মানবতার জন্য সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর কিছু করার অঙ্গীকার। সংস্কৃতিচর্চার কাণ্ডারি হিসেবে তাদেরকেই নিতে হবে জাতিগঠনের গুরু দায়িত্ব। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সাহিত্যিক ও শিল্পমনা মানুষরা পাঠক বা দর্শকেরর জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়টা মাথায় না রেখে অতি দ্রুত নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে গিয়ে পাঠকের মনোরঞ্জনের দিকে বেশি নজর দিয়ে ফেলেন। সহজ-সরল পাঠক ও দর্শকের জীবন ও মূল্যবোধ গঠনকে তুচ্ছ মনে করে তাদের মনোরঞ্জনের দিকে মনোযোগ দেয়ার জন্য জাতিগঠনে ব্যর্থ হয়ে যায় আমাদের সাহিত্য ও শিল্পমনা বুদ্ধিজীবীরা। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে ওঠেন যে, তারা বুঝতেই পারেন না যে প্রিয় পাঠকের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে তাদের জীবন ও মূল্যবোধ ধ্বংসের মাধ্যমে তাদের কতটা ক্ষতি করে ফেলছেন!
বিভিন্ন নাটক, সিনেমা ও গল্পে নায়ক নায়িকার প্রেমের ভূরি ভূরি উপস্থাপন দেখে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনঃকষ্ট থেকে একবার একটা মন্তব্য করেছিলেন যার মূল অর্থ হচ্ছে, ‘এখনকার নাটক ও গল্পে শুধু প্রেম আর প্রেম, দেখে মনে হয় যেন পৃথিবীতে বাবা, মা, ভাই, বোন বলে আর কেউ নেই; শুধু প্রেমিক আর প্রেমিকাই আছে!’
বিশ্বাসী কবি, সাহিত্যিক, নির্মাতা ও সংস্কৃতিকর্মীদের জাতিগঠনের পাশাপাশি নিজের জীবনগঠনেও অনেক সচেষ্ট হতে হবে। তাদেরকে সত্যের সাক্ষ্য হতে হবে। ‘ক’ ও ‘আমার মেয়েবেলা’র লেখকের জীবন নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠে তেমন প্রশ্ন যেন না উঠে আদর্শবাদী বিশ্বাসী লেখক ও শিল্পীদের নিয়ে সে ব্যাপারে অধিক সচেতন হতে হবে। তাদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে সাহিত্যিক বা শিল্পী মানেই বাউণ্ডুলে নয়। যেন কখনও এমন না হয় যে জাতিকে পথ দেখাতে গিয়ে মুসলিম শিল্পী ও নির্মাতা নিজেরাই পথ হারিয়ে ফেলেছেন। এমন প্রশ্ন যেন না উঠে মুসলিম শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে। তাদের যেমন সচেতন থাকতে হবে সাহিত্য ও শিল্পকর্মের উপজীব্য নির্বাচনে তেমন সচেতন থাকতে হবে নিজের জীবন এবং পাঠক ও দর্শক তথা সমগ্র জাতির জীবনগঠনে।
তাদেরকে সাহিত্য ও শিল্পকর্মের উপজীব্য নির্বাচনে অধিক যতœশীল ও সচেতন থাকতে হবে। একজন মুসলিম লেখক, সাহিত্যিক বা নির্মাতার উচিত ইসলামের সুমহান জীবনবোধ ও মূল্যবোধ কলম ও শিল্পের তুলিতে পাঠকের কাছে চিত্রায়ন করা।


আরো সংবাদ



premium cement