দহনের দুরন্ত আগুন
- জেসমিন নাহার
- ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০৫
সদ্যস্নাত তাসপিয়ার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লতানো চুল বেয়ে টুপ টুপ পানি পড়ছে। জাহিদ সেই পানিতে হাতের তালু পেতে বলে
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া
ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু
তাসপিয়া হাহা হেসে বলে ও আল্লাহ আমার প্রবাসী স্বামী দেখি কবিতাপ্রেমী হয়ে দেশে ফিরেছে। কবি হলে তো সেই হতো।
জাহিদ দু’পাটির দাঁত বের করে হেসে বলে হয়েছি তো শুনো দু’লাইন,
চুল তার কবেকার হাঁটুর নিচে দোলে-
বোতল বোতল তেল শ্যাম্পু গেল মোর চলে।
ও এখন তুমি আমার চুলের সৈার্ন্দযের ক্যাডিট নিচ্ছ তোমার তেল শ্যাম্পুর বদলেতে? আমার যতœটা দেখলে না? যাও- যাও বাথরুমে গোসল সেরে আসো।
তাসপিয়া এলোমেলো বিছানা পরিপাটি করতে গিয়ে দেখে জাহিদের মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে, কল মি। তাসপিয়া মোবাইল চেক করে। দেখে স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী যদিওবা একটু চাকমা টাইপ চেহারার এক মহিলার নানা ধরনের ছবি।
ছবিতে দেখতে পায় কাঠের আলনায় শাড়ির সাথে জাহিদের প্যান্ট-শার্ট, লুঙ্গি ভাঁজ করে রাখা। আরেক ছবিতে- ছয় সাত বছরের একটি ছেলের সাথে ওই মহিলার ছবি।
তাসপিয়ার মাথা গরম হয়ে কান দিয়ে গরম ভাপ বেরোতে লাগল। বুকের ভেতরটায় কালবৈশাখী ঝড় বইতে লাগল। মুহূতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
জাহিদ রুমে আসতেই তাসপিয়া বলে এই ছবি কার? তোমার জামা-কাপড়ইবা ওর কাপড়ের সঙ্গে কেন?
জাহিদ হেসে বলে, এই জীবনে মনটা বড় হলো না। একদম ছোট মনেরই রয়ে গেলে। এটা আমার রুমমেট রহমানের ছোট বোন শেফালী। অবশ্য আমি ওকে শেফা বলেই ডাকি। ওদের ওখানে গিয়েই তো প্রতিবার রহমানের দেওয়া সবকিছু দিয়ে আসি। রহমানও তো যখনই দেশে আসে আমার দেওয়া জিনিস তোমায় দিয়ে যায়।
এরকম নির্লজ্জের মতো ছবি তুলেছ কেন?
সাত বছর ধরে ওদের ওখানে যাই, দু-চার দিন থাকি। আন্তরিক সম্পর্ক। ছবি এনেছি তোমাদের দেখাব বলে। দোষের তো কিছু দেখছি না।
এতটা বছর বিদেশে থেকে এবার একেবারেই চলে এসেছে। তিন মাসে চারবার গিয়েছে রহমানের রাড়িতে। চোখে পড়ার মতো কিছু মনে হয়নি বলে সন্দেহ ছিল না; কিন্তু এখন স্বচ্ছ সুন্দর দিনগুলোতে কালো ছায়ায় ভরে গেল। সন্দেহের বীজ সার মাটিতে পোঁতা হয়ে তাগড়াতুগড়া বিষবৃক্ষের বিষ ছড়াতে লাগল। বিশ বছরের সংসার ভালোবাসার স্বামি অন্যের হয়ে যাবে ভাবতেই হিংস্র হয়ে ওঠে তাসপিয়া। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা আরো বেপরোয়া করে তোলে তাকে। জাহিদের প্রতি পদে পদে তাসপিয়ার নজর।
শেফার কাছ থেকে মন সরানোর জন্য সুন্দর করে সেজে জাহিদকে বলে দেখ তো কেমন লাগছে?
তাচ্ছিল্যের চোখে চেয়ে জাহিদ বলে, দেখতে আর কেমন হ্যাঙ্গারে জামা যেমন।
তাতো বলবেই। ত্রিশ বছর শুধু বলেই যাচ্ছো মোটা হও গায়ে গোশত লাগাও। আমি তো পারিনি, তোমার সংসারের গায়ে গোশত লাগাতে গিয়ে। তাই বুঝি গোশতওয়ালী কুমিরের চাষ করে যাচ্ছো? ঐ কুমির যাতে তোমায় গিলে না খায় সেটি দেখো।
জাহিদ চ্যাঁচায়- চোপ, ছোটলোকের বাচ্চা গিলে খাবে কি? তুইতো খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছিস। আমি খেয়ে না খেয়ে সুখ আল্লাদ ত্যাগ করে রোজগার করে পাঠিয়েছি। শুয়ে-বসে খেয়ে খেয়ে গলার জোর হয়েছে। একদম গলা টিপে দেবো।
আমি শুয়ে বসে খেয়েছি সেটি শুধু দেখেছ । একবার ভেবেছ আমি কী করেছি সংসারের জন্য? নাকি দেখার চোখ এখনো ফোটেনি?
গাঁয়ের বাড়িতে রেখে দিয়েছ তোমার মা ভাই বোনদের চাকরানী বানিয়ে। টাকাপয়সাও দিয়েছ তাদের হাতে। আমার কথা কি কিছু ভেবেছিলে? সবাইকে খাইয়ে আমি কী খেতাম কোনো দিন জানতে চেয়েছ? সবাই মিলে কথার তুবড়ি ফাটিয়ে কাপড় কাচার মতো কেচে ধুয়ে দিত আমায়। জানাতাম তোমায়, কোনো দিন প্রতিবাদ করেছ? অমানবিক যন্ত্রণা সয়ে টানা ছয় বছর কানে তুলো দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকাতে মায়ের বাসায় উঠে তাদের গলগ্রহ হয়ে গায়ে গণ্ডারের চামড়া লাগিয়ে থেকেছি। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন ভাই-বোনদের কথায় তো আর মিছরি থাকে না, থাকে মিছরির ছুরি। বিয়ের পর মেয়েদের বাবার বাড়িতে থাকা যে কতটা কষ্ট সবাই তা বোঝে না। যার উপর দিয়ে বুলডোজার যায় সে-ই বোঝে চ্যাপটা হওয়ার কষ্ট।
তিন তিনটে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কচ্ছপের মতো মাটি কামড়ে পড়ে থেকে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়েছি। না জমিয়ে হুল্লোড় করে খেয়ে দেয়ে শেষ করতে পারতাম না? শেষ করিনি কারণ তোমার সংসারে গোশত লাগিয়েছি। ঢাকায় আড়াই কাঠা জমি কিনেছি, যা তুমি সংসার চালিয়ে কখনোই পারতে না। সেই জমিতে মাত্র দুইখানা রুম একটা বাথরুম আর কিচেন, টিনশেড করে থেকে কত কষ্ট করেই না টাকা জমিয়ে জমিয়ে শেষ পর্যন্ত এই দুই তলাটা করেছি।
দুধ ডিম মাছ গোশত মুখে দিইনি, মনে করেছি থাক, আমার টুকু বাচ্চারা আরেক বেলায় খাক। একটা কাজের লোক রাখিনি নিজেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছি। ভালো দামি জামা-কাপড় পরিনি সখ আহ্লাদ মাটি চাপা দিয়ে রেখেছি।
তিক্তস্বরে জাহিদ বলে, যেই না রুচি তুমি পড়বে ভালো জামা-কাপড়। গাঁও-গ্রামের মহিলারাও রুচিশীল জামা-কাপড় পরে।
জাহিদের ম্যাচের কাঠির এক ঘষা আর তাসপিয়ার বুকের ভেতরে দাউ দাউ আগুন জ্বলা। মুহূর্তে বাইরে বেরিয়ে আসে সেই আগুনের হল্কা। ক্রধে কাঁপতে-কাঁপতে তাসপিয়া বলে এমন কথাও তুমি বলতে পারলে? আমার রুচি যদি দেখাতে যেতাম তোমার সংসারের গোশত লাগত না। আরে তোমার ওই গাঁয়ের শেফালী তো রুচিশীল জামা-কাপড় পরে তোমার চোখ ধাঁধিয়েছে, মন মাতিয়েছে, যাতে তোমার মনের মাঝে বাসা বাঁধতে পারে। সে-কি তুমার সংসারের চিন্তা করেছে? সে তার নিজের চিন্তা করেছে। আর অমি তোমার সংসারের গায়ে গোশত লাগানোর চিন্তা করেছি।
সংসারের জন্য সেই জায়গাটা কিনেছি সেই টাকাটা ও-তো তুমি দাওনি।
বাপ-ভাইদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিনেছি। তুমিতো গুনে গুনে খাওয়া-পরার টাকা টুকুই দিয়েছ। ওখান থেকে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়ে ঋণ শোধ করেছি।
তিন তিনটি বাচ্চা পালন করেছি, ওদের স্কুলে আনা-নেওয়া করেছি, ওদের অসুখ-বিসুখে ডাক্তার দেখিয়েছি, বাজার করেছি, রোদের মধ্যে ঘামে ভিজে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গ্যাস বিল কারেন্ট বিল পানির বিল পরিশোধ করেছি। এত কষ্ট না করে আরামে গা ভাসিয়ে চললে এত সুন্দর বাড়ি তোমার হতো কী করে? নিজেকে জীর্ণশীর্ণ করে তোমার সংসারটা হৃষ্টপুষ্ট করেছি। তার প্রতিদান না দিয়ে এখন তুমি মোটাতাজা মেয়ে মানুষের সাথে রংতামাশা করে ছবি তুলে বেড়াচ্ছ?
জাহিদ ক্রোধে ফেটে বলে, আমার মতন নিষ্পাপ মানুষকে পাপী বানিয়ে ফেলছিস। তোদের মতো মহিলাদের কারণে পুরুষরা খারাপ হতে বাধ্য হয়।
তাসপিয়া নরম গলায় বলে আরে আমার কথায় তুমি খারাপ হবে কেন? তোমার চলার গতি পথই আমায় বলতে বাধ্য করছে।
জীবনের ঝড় যুদ্ধ দহন সহ্য করে এই বৈরী পৃথিবীর বুকে জীবন তার পূর্ণ গতিতে হেঁটে চলছে। জাহিদের হাতের টাকা-পয়সারও ঘাটতি শুরু হয়। অনেকটা সময় বাড়ির বাইরে কাটায়। কোথায় কাটায় জিজ্ঞেস করলেই শুরু হয় ভাঙচুর। কোনো কথাই বলা যায় না। সামান্যতে উত্তেজিত হয়ে ক্রোধের পর্যায়ে চলে যায়। ওর পীড়নে শান্তশিষ্ট তাসপিয়া দিনে দিনে জেদে ক্রোধে অস্থির হয়ে ওঠে। বুকের মধ্যে এক অসম রাগের মাথা খোঁড়াখুঁড়ি, মনের মধ্যে ঈর্ষার যন্ত্রণা হতেই থাকে।
জাহিদকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে। জাহিদ বোঝার চেয়ে অবুঝই হয়ে ওঠে বেশি।
কেঁদে কেঁদে বলে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনের চেয়ে পরকীয়ার বন্ধন দেখা যায় বড় বেশি। না হলে কেন তুমি ঐ মাহিলার সাথে সম্পর্ক ছাড়ছ না? আমার দিকে চেয়ে না হয় না হোক তোমার সন্তানদের দিকে চেয়ে হলেও ও পথ থেকে ফিরে এসো।
ভালো হোক আর মন্দ হোক তাসপিয়ার যে কোনো কথায়ই জাহিদের পিত্তি জলে যায়, কথার উচ্চারণে শরীরের বিষ ধরিয়ে দেয়। দিনে দিনে চেনা মানুষটা অমানুষ হয়ে ওঠে। প্রতি পদে পদে দু’জনার অমিল হওয়া সত্ত্বেও তাসপিয়া জোড়াতালি দিয়েও সংসারটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে অবিরত।
এক সন্ধ্যায় জাহিদ ফুরফুরে মেজাজে পা দুলিয়ে টিভি দেখছিল। এইচএসসি আর এসএসসি পড়–য়া মেয়ে দুটো এসে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে বাবা, মা আর তুমি যেই সাবজেক্টা নিয়ে এত অশান্তিতে আছো আমাদের সংসারটা প্রায় ভাঙি ভাঙি করছে সেটি কি সত্যি?
সত্যি না মিথ্যা তোমাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে? আনকালচার্ড মায়ের কাছ থেকে এগুলোইতো শিখবে। এর থেকে ভালো কিছু আসা করা ভুল।
বড় মেয়েটা বলে বাবা আজ দুপুরে রহমান চাচার বাড়ি থেকে তার চাচাতো ভাই এসেছিল। বলল তুমি নাকি শেফা আন্টিকে বিয়ে করেছ?
দরজায় দাঁড়ানো তাসপিয়ার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। যেন তার পুরো শরীরটাই ভেঙে খানখান হয়ে গেল। এক প্রলয় বাতাসে ভেঙে পড়ল প্রতিরোধের দ্বার। মাটিতে গড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ছোট মেয়েটা মাকে আঁকড়ে ধরে বলে, এরকম কষ্ট পাবে বলে তোমাকে জানাইনি।
কর্কশ কণ্ঠে কুৎসিত ভাষায় জাহিদ চিৎকার করে বলে- জেনেই যখন গেছ লুকানোর মতো কিছুই নেই। যা শুনেছ সত্যিই শুনেছ। ও ঘরে আমার ছয় বছরের একটা ছেলেও আছে। ওরা এখন ঢাকাতেই ভাড়াবাসায় আছে।
তাসপিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি এমনটা কেন করলে? আমার অপরাধ কী ছিল, ভুলটা কী ছিল? এ সংসারের জন্য কী না করেছি আমি? কী দেইনি তোমাকে?
জাহিদ উচ্চৈঃস্বরে বলে কী পেয়েছি তোমার কাছ থেকে আমি? জীবনে সুখ যা পাওয়ার ওর কাছ থেকে পেয়েছি। মন চাইলে এ সংসারে থাকতে পারো না হলে পথ খোলা। ওদের আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না।
তাসপিয়ার কষ্টে বুক ফেটে যায় । কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার এত কাছের মানুষটা এত দূরের কিভাবে হলো? কেন তাকে কেড়ে নিয়ে গেল। মানুষ এতটা অকৃতজ্ঞ কী করে হতে পারে? হে খোদা মৃত্যু কেন দেহ থেকে আত্মাটা আমার বের করে নেয় না?
তাসপিয়ার কান্না দেখে তার ছেলে-মেয়েরাও গড়িয়ে কাঁদে। জাহিদের ভিতরটাও নরম হয়ে আসে। সান্ত্বনার স্বরে বলে, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। শত মাথা কুটলেও এর সংশোধন আমি করতে পারব না। তোমার ভয় কী? তোমাকে তো ফেলে দিচ্ছি না। তুমিতো এ সংসারে বড়, তোমার সাথে কি কারো তুলনা হয়? তুমি থাকবেই। তোমার চিন্তা কী? তোমায় আমি শেফার মাথার উপরেই রাখব। বরঞ্চ ওকে তোমার পায়ের নিচেই রাখব। সামনের মাসে ওকে এ বাড়ির নিচতলায় নিয়ে আসব। তুমি উপর তলায় ওর মাথার উপরেই থাকবে।
ছোট মেয়েটা চাপা স্বরে বড় বোনকে বলে আপু বাবা বড় একটা হাতি মেরে দুটো সোনামুখী সুই দান করল। বড় মেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে না রে, হাতি সমান জুতো মেরে পায়ের তলায় কালনাগিনী রাখার বন্দোবস্ত করে দিলো।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা