২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

স্মৃতি যখন সামনে এসে দাঁড়ায়

স্মৃতি যখন সামনে এসে দাঁড়ায় -

সময় এখন তেল ফুরানো মাটির প্রদীপের মতোই নিঃস্ব। শস্যদানার ভেতরে যে জীবন, তা আমরা দেখি না, তারা (শস্যরা) দেখে। মানুষ কী নির্মম ও হিংস্র কায়দায় সব গ্রাস করছে। গোটা বিশ্বের দিকে তাকালে এটাই মনে হয় আজ আমার।
কেবলই ওই শস্যদানার কথা মনে হয় আমার। আমরা যে নির্মমতা নিয়ে যাপন করি নিজেদের জীবন, আর ক্ষুধার চেয়েও বেশি ব্যয় করি সেই নিয়ামত, তা একবারও ভাবি না। আমার কষ্ট এখানেই যে আমরা প্রাণ ও প্রাণীকে বুঝি না। কেবল ধ্বংস করতে ভালোবাসি। মানুষ আর মানবতা কোথায় গেছে, ভাবলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একবার শ্বাস বন্ধ হলে তো জীবন শেষ। এই বোধটুকুও মানুষের নেই।
মানুষকে যে মরতে হবে, এই সত্য তারা জানে; কিন্তু মানে না।
এই বেদনা নিয়ে বেঁচে আছি।
২.
আমার বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কবি জাহিদ হায়দার। বলল, কবি তো কল ধরছে না। কবি মানে জাহাঙ্গীর ফিরোজ। বললাম- সে তো মসজিদে। জাহিদ বলল, তোর মাথায়ও তো টুপি। বললাম- আমি ফিরছি সেখান থেকেই। জাহিদ বলল, কবিতা এখন নামাজ পড়ে। বললাম- হ্যাঁ, পড়ে। জাহিদ একটি হাসি দিলো দাঁত বের করে। আমি সেই হাসির নাম দিলাম গুয়ামুড়ি হাসি। এই হাসি কি কিছুটা তাচ্ছিল্যের? মনে পড়ে না। তবে ওর হাসির বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে। এখন, মানে আজকাল অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি। এটা কি বয়সের দোষ? মেমরি লস হচ্ছে এটা বুঝতে পারি। ডিমেনশিয়া! কী? হতে পারে। কিন্তু সেই নেংটাকালের অনেক কথাই তো দিব্বি মনে আছে। চলো যাই দেখে আসি সেই কিশোরকালের ছবি, যা এখনকার স্টান্ডার্ড কলোক্যাল বাংলা ভাষায় লিখছি। অনেক প্রজ্ঞাবান বলেন এই ভাষা নাকি প্রমিত বাংলা। এই প্রমিত শব্দের মানে আমি জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। যেমন আমি চেষ্টা করেও আজ আর আমার শিশুকাল কিশোরকালের ভাষা বলতে ও লিখতে পারব না। নো যাইগ্যা বললে অনেকেই ধাক্কা খাবেন কেন না, নো বলতে আমি কী বোঝাতে চাইছি। যারা নো শব্দের অর্থ জানেন, তাদের ৯ ভাগই পড়তে বা লিখতে জানেন না। তাদের ছেলেমেয়েরাও আজ স্ট্যান্ডার্ড কলোক্যালের গরম তাপে আস্তে আস্তে অপ্রমিত বা গ্রামীণ বুলি থেকে সরে আসছে। খেয়াল করলে বোঝা যায় মানুষ কিছু শিখলে, সেশা ধ্বনি ও শব্দের অন্তরে ঢুকতে চায়। এটা তার প্রাকৃতিক বা সহজাত প্রবণতা, যা নেচারাল।
জাহিদের কথায় আসি। ও যখন বলল কবিতা তো ফোন ধরছে না। আমি বুঝলাম কবিতা মানে জাহাঙ্গীর ফিরোজকে মিন করছে। আবার ফোন বলায় আমি বুঝলাম ওর ফোন বা সেলুলার থেকে কল করা বোঝাচ্ছে। ভাষার ভেতরে এই রকম ইঙ্গিতময়তা থাকে। আমরা পরিবেশ প্রতিবেশ ও সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্রে সেসব কথার মানে বুঝে নিই। আমরা গোরু তাড়াবার বা আরো নানা কাজে ব্যবহারের বাঁশের তৈরি ছোটো টুকরো লাঠি বা কাঠি, যাকে আমরা বলতাম নড়ি বা পাজন ইত্যাদি, বুঝতে পারি; কিন্তু আজকালকার নগর শিশু-কিশোররা তা বুঝবে না, চিনবেও না। চুকুরি নামের একটি ফল আছে, তা গ্রামের ছেলেরাও ভুলে বসে আছে, বোধহয়। পাংকিচুংকি নামের একটি ছোট ফল আছে, বাগির পেছনে বা আড়ায় জন্মে, অনেকটা বøুবেরির চেয়েও আকারে ছোট, টক আর মিষ্টি মেশানো, সেসব গাছ তো আজকালকার গ্রামের ছেলেরাও চিনবে কি না, সন্দেহ করি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে বগ ঘরের গা লাগোয়া একটি ছিল, জঙলা গাছে; কিন্তু গরমের সময় পাকা কুচকুচে কালো হয়ে যেত, কত যে তুলে মুখে পুরেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমাদের গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে না, পরিত্যক্ত, ঘরগুলোও নেই। নড়বড়ে, পরিত্যক্ত একটি দাঁড়িয়ে আছে টিনের বেড়াগুলো নড়বড়ে দাঁতের মতোই অযত্নে আছে। আমাদের মরিকি ভাইয়ের ছেলেরা সংসার করে। তার ওয়াশরুমে হাই কমোড, লো ডাউন দুটোই দেখলাম। গ্রাম এখন নগরের সভ্যতার কাছে আছে।
সেই দুরন্ত শিশুকাল আমার পিছু ছাড়ে না।
আমাদের বাড়ির পেছনে বেশ বড়সড় জঙ্গল ছিল, আজ আর নেই। সেই জঙ্গলে ঝোপঝাড় আর বেতের কয়েকটি গুচ্ছ ছিল, ছিল পাটিবেতের একটি এলাকা। আর একটি বেশ বড় ভুতুড়ে জারুলগাছ। ওই জারুলগাছে কত যে পেত্নী থাকত আজ আর মনে নেই। সেই জঙ্গলের পশ্চিম পাশে ছিল একটি গাবগাছ। গাবগাছে ভ‚তদের আড্ডাখানা। কিন্তু গাব পাকলে সেই আড্ডা ভেঙে আমরা গাছে চড়তাম পাকা গাব পাড়তে। ঠিক দুপুরবেলা, গাছ-পাকা গাবের রস খেতে কি যে মজা। আর বেতের গুচ্ছে ঝুলে থাকা বেতফলের গোছা আমরা কোটা দিয়ে টেনে এনে বেথুলের ঝোপা পাড়তাম। টক আর মিষ্টি মেশানো বেতফল (বেথুল) ঠিক দুপুরবেলা, জিভে জল এনে দেয় আজো। পেত্নী ঠাসা জারুলের পাশেই ছিল আরেকটি গাছ। সেই গাছের নাম তো ভুলে বসে আছি। মনে হয় আমরা আঠাগাছ বলতাম। কিংবা লোকবাংলায় প্রচলিত নামই বলতাম। আজ ভুলে, গুলে খেয়ে বসে আছি। হায়রে মেমরি আমার!
চঙ বা ঘুড়ি বানানোর বাঁশপাতা কাগজে বংকুই গোটার মতো ফ্যাকাশে রঙের সেই আঠা দিয়ে কত যে ঘুড়ি বানিয়েছি। মায়ের উঠোন ঝাড়ু দেবার শলাগুচ্ছ বা গোছা থেকে দু-চারটি শলা চুরি করেছি ঘুড়ি বানাবার জন্য। তবে চঙ বানানোর জন্য খুব কষ্ট করতে হতো আমার। চঙের খাঁচা বানানোর জন্য বাঁশের টুকরোকে ফালা ফালা করে নিয়ে সেগুলো ক্রমাগত চেঁছে সুযোগ বা চ্যাপ্টা করে নিয়ে তার পর চারকোনো খাঁচা বানাতাম। প্রথমে চারটি কাঠি বাঁধতাম। তারপর দুই কোনা থেকে দু’টি কাঠি পূরণ চিহ্নের মতো, ইংরেজি এক্স-এর মতো করে চার কোণে বাঁধতাম। তার পাশে দিয়ে আরো সরু কাঠিগুলো ওই রকম করে বাঁধা শেষ হলে চঙের মাথায় একটি পাতলা করে চাঁছা বাঁশের কাঠি বানাতাম। সেটি ঠিক মতো বেঁকে আমার চাহিদা মতো হয় কি না, সেটি পরখ করতেই দিন উজাড় হয়ে যেত। সেই কাঠি ঠিক হওয়ার পর আমি বা আমরা বেতের ঝোপ থেকে একটা পাকা বেতগাছই কেটে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনতাম। তারপর সেই বেত থেকে একটি অংশ পাতলা বের করে কেটে আনতাম। সেই অংশটি দা দিয়ে চেঁছে চেঁছে এমন পাতলা করতাম যে তাতে ফুঁ দিলেও সেই বেতের ফিতা রা রা করে বেজে উঠত। তখন আমি বুঝতাম চঙের মাথার ওই বাঁশের শিরটাতে বেতের পাতলা অংশ এমন কায়দায় বাঁধতাম যে তা গুলালের মতো বেঁকে এসে অন্য প্রান্তে ঠিক মতো বাঁধা যায়। এটা খুব কঠিন ছিল আমার জন্য। তবে প্রতি বছরই এটা করতে করতে অভ্যাস দক্ষতায় পৌঁছে গেল। চঙের নিচের দিকে দুই হাত খানেক লম্বা বাঁশপাতার কোনাকুনি লেজ লাগাতাম আমরা। সেটি ঘুড়ির বেলায় কিন্তু এত ছোটো হতো না। ঘুড়ির লেজ হতো আট-দশ হাত লম্বা আর চিকন। ঘুড়ির নিচে সেই সাপা লেজ লাগিয়ে দিতাম আমরা। সেই সময়টা ছিল আগ্রহায়ণ ও পৌষ মাস। তখন শীতের একটি ঠাণ্ডা আভা বাতাসে থাকত। রোদ আর বাতাসের সেই তাপে আমাদের মনও চনমন করে উঠত। আমরা ধান-কেটে নেয়া জমিতে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতাম। বাতাস কোন দিকে বইছে আমরা বুঝতাম। তার আগে দু’টি কাজ করতাম। বাজারের বাইন্যার দোকান থেকে লম্বা সুতার পুঁটলি কিনে আনতাম। সেই সুতায় গাবের রস দিয়ে তা শুকাতাম। তাতে সুতা বেশ শক্ত হতো, সহজে ছিঁড়ে যেত না। আর যদি ঘুড়ি বা চঙ কাটাকাটির প্রতিযোগিতার অফার পেতাম, তাহলে সুতায় মাঞ্জা দিতে হতো। ওই মাঞ্জা যে দোকানে পাওয়া যায় তা জানতাম না।
প্রতিযোগীদের ঘুড়ি বা চঙের সুতা কেটে দিতে পারলে যে বিজয়ী খুশি জাগত আমাদের, তার তুলনা সারা জীবনে আর পাইনি। চিলা ও ফেসক্যা নামেরও দু’টি ঘুড়ি বানাতাম আমরা। চিলের মতো দেখতে হতো চিলা। চিল উড়লে যে রকম দেখতে হয়, সেই আকৃতি হতো। আর ফেসক্যা যে আমাদের এখনকার চেনা ফিঙে, তা বহুকার পর জেনেছি। চঙ নামের ওই আকাশযাত্রী যে কোনো পাখির রূপ থেকে এসেছে, তা জানতাম না, আজো জানি না। মানুষের সৃজনী চেতনাই তার নির্মাতা, আজ বুঝি।
আমরা যারা কিশোর-যুবা ছিলাম, তারা ছোটো আকারের ঘুড়ি বা চিলা বা ফেসক্যা, চঙ বানাতাম। যারা যুবক তারা বানাতেন অনেক বড় চঙ। দুপুর ও বিকেলে মাঠে নিড়ানির কাজে বসার আগে সেই চঙ উড়িয়ে দিতেন তারা। একটা খোটা বা সুতার খুঁটি মাটিতে গেড়ে রেখে দেয়া হতো অথবা গরু খেদানোর নড়ি বা শক্তপোক্ত বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে দিব্বি কাজে মন দিত তারা। চঙের মাথার সেই বেতের ফিতার রা রা শব্দে মুখর হয়ে উঠত চার পাশ। বাড়ির ভেতরে বসেও ওই রা রা শুনতে পাওয়া যেত। যারা মাঠে কাজ করতে করতে ওই চঙের শব্দের সঙ্গীত শুনতেন, তারা মুগ্ধ হতেন। কাজের ভেতরে থেকেও উপভোগ করতেন সেই পরমানন্দ, যা প্রকৃতির মতোই ছিল স্বাধীন।
ওই স্বাধীনতা আজ আর কোথাও দেখি না।
৩.
চৈত্র-বৈশাখের রোদের দুপুরগুলোতে হাঁসফাঁস করত মানুষ। নিরাক পড়েছে। মানে কোথাও বাতাস নেই। এমনই ঝিম-মারা দুপুরে ক্ষেতের কাজ রেখে তারা গাছের নিচে এসে জিরিয়ে নিত। ঠিলা (যাকে মাটির কলসি বলে চিনি আমরা) ভর্তি পানি নিয়ে আসত তারা মাঠে। সেই পানি পেটপুরে খেত। তার পর ঘাসের কার্পেটে শুয়ে পড়ত। আমরা শিশু-কিশোররা আমগাছের নিচে বেতের পাটি বিছিয়ে শুয়ে গরম থেকে বাঁচতে চেষ্টা করতাম। নিরাক না পড়লে, গাছপালার মধ্যেই একটি মৃদু বাতাসের ধারা বইত। আমি দুপুরের ভাত খেয়ে এসে ঘর থেকে বেতের পাটি বিছাতাম আমাদের কালাচারা কিংবা চিতল বা দরবারি আমগাছের নিচে। ছোটো ভাই ও বোনরাও পাটিতে শোতো। আর আমাদের পাশের গ্রাম একঢালায় ছিল বড় খালার বাড়ি। সেই বাড়িতে ছিল আমাদের অবাধ যাতায়াত। খালাদের ছিল অনেক আমগাছ। দুই বা তিন একরজুড়ে আমের বাগান। আমরা কাঁচা আমের ভর্তা করে গাছের ছায়ায় বসে তা ভোগ করতাম। আহা সেই সব দিনের কোনো তুলনা কি হয়? হয় না।


আরো সংবাদ



premium cement