০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

হিলফুল ফুজুল : মহানবী প্রতিষ্ঠাতা না কি সমার্থক

-

হিলফুল ফুজুল। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম শান্তি সংগঠন। প্রাচীন আররের বুকে প্রতিষ্ঠা হওয়া এই সংগঠন আরব ছাড়িয়ে আধুনিক আজমের প্রসিদ্ধ ও পরিচিত। আমাদের কাছে নামটিও পবিত্র। আমরা অনেকে মনে করি- অশান্তি, জুলুম, অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা হওয়া এই সংগঠন মহানবী সা: নিজে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যুবক বয়সে, যুবকদের নিয়ে। অনেক বই-কিতাবেও লেখা আছে এমনই। লোকমুখেও প্রসিদ্ধ এমন কথা। কিন্তু গ্রহণযোগ্য সিরাতের কিতাব এবং ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ বলছে ভিন্ন কথা। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, মহানবী সা: নিজে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না; বরং আবরের অন্য সচেতন ব্যক্তিরা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মহানবী সা: ছিলেন সেই সংগঠনের একজন জোরালো সমর্থক।
জাবিদ গোত্রের এক ব্যবসায়ী একবার কিছু পণ্য নিয়ে মক্কায় আসেন। আস বিন ওয়াইল সাহমি তার সব পণ্য কিনে নেন। সাহমি কুরাইশের অনেক বড় নেতা ছিলেন। সে দম্ভে ওই ছোট ব্যবসায়ীর পাওনা অর্থ পরিশোধ করলেন না। অনেক আবেদন করার পরও কোনো ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বঞ্চিত ব্যবসায়ী বঞ্চনার এ অভিযোগ নিয়ে তার মিত্র গোত্র আহলাফ গোত্রের আব্দুদ্দার, মাখজুম, জুমাহ, সাহাম ও আদি বিন কাবের কাছে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করে দিতে তাদের সাহায্য চাইলেন। তারা সাহমির প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা ভেবে কেউ এগিয়ে এলো না।
‘হে কুরাইশ গোত্র! একজন মজলুমকে সাহায্য করো। যার ব্যবসায়িক পণ্য ছিনতাই করে নেয়া হয়েছে। সে এখানে ভিনদেশী! নিজ বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন থেকে অনেক দূরে। সে ইহরাম বেঁধে আছে অথচ সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এখনো ওমরাহ পূর্ণ করতে পারেনি। হে হাজরে আসওয়াদ ও হাতিমে আগমনকারী! আমাকে সাহায্য করো। মান-সম্মান তো ওই ব্যক্তির, যার কর্ম ভালো। প্রতারক ও মন্দলোকের চাদরের কোনো সম্মান নেই।’
তার কান্নাজড়িত ফরিয়াদ শুনে নবীজীর চাচা জুবাইর বিন আবদুল মুত্তালিব উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন ‘এই মজলুমকে কি এমন অসহায় ও নিরুপায় ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে?’
বিষয়টি নিয়ে তিনি বনু হাশিম, বনু মুত্তালিব, বানু জুুহরা, বানু তামিমসহ আরো কয়েকটা গোত্রের সচেতন ব্যক্তিদের আহ্বান করেন এবং সবাইকে নিয়ে আবদুল্লাহ বিন জাদআনের বাড়িতে সমবেত হন। তারা নিজেরা সঙ্কল্প করেন, জালেম থেকে মজলুমের হক আদায় না করা পর্যন্ত তারা মজলুমের সাহায্যের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। এরপর তারা আস ইবনে ওয়ালিদ সাহমির কাছে আসেন এবং তার থেকে ব্যবসায়ীর মূল্য আদায় করে নিয়ে ব্যবসায়ীকে বুঝিয়ে দেন (তাকাকাতে ইবনে সাদ, প্রথম খণ্ড, ১২৬-১২৭ পৃষ্ঠা, নসবু কুরাইশ, ২৯১ পৃষ্ঠা)।
সিরাত ও ইতিহাসের কিতাবে আরো উল্লেখ রয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে জাদআন তাদের সবার জন্য ভোজের আয়োজন করেন। সেখানে দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য সবাই মিলে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। সেখানে কয়েকটি বিষয়ে তারা একমত হন। এ চুক্তি সম্পাদনের সময় নবীজী সা:-ও আবদুল্লাহ ইবনে জাদআনের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন।
১. দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা; ২. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা; ৩. অত্যাচারিতকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করা; ৪. দুর্বল, অসহায় ও এতিমদের সাহায্য করা; ৫. বিদেশী ব্যবসায়ীদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ৬. সর্বোপরি সব ধরনের অন্যায় ও অবিচার অবসানের চেষ্টা করা।
কথাগুলোর উপরে সবাই মিলে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-১০৬)।
এখানে প্রতিষ্ঠাতা যে নবীজী ছিলেন না, সেটি স্পষ্ট হলো। রিসালাত তথা নবুয়তের দায়িত্ব পাওয়ার পরে, নবী সা: তিনি আগের স্মৃতিচারণ করে সাহাবায়ে কেরামকে বলেছিলেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জাদআনের ঘরে আমি এমন একটি মৈত্রীচুক্তির মধ্যে শরিক ছিলাম যে, এর বিনিময়ে আমি লাল উটও গ্রহণ করা পছন্দ করতাম না। যদি ইসলাম আসার পরেও এমন কোনো চুক্তিতে আমাকে ডাকা হতো তবে আমি সে ডাকে সাড়া দিতাম’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, ১৫৪-১৫৫ পৃষ্ঠা; নবীয়ে রহমত-১২১ পৃষ্ঠা)।
আব্দুল্লাহ ইবনে জাদআনের বাড়িতে এই ঘটনা ঘটার অনেক আগে, বনু জুরহুম এবং বনু কাতুরা গোত্রের কয়েকজন সচেতন মানুষ একত্র হয়ে একটি সংগঠন করার প্রস্তাব করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন, এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা আরবে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে যখন আব্দুল্লাহ ইবনে জাদআনের বাড়িতে সিদ্ধান্ত হয়ে একটি সংগঠন দাঁড়িয়ে গেলো এবং চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, তখন তারা আগের উদ্যোক্তাদের সম্মানার্থে তাদের নামের সাথে মিলিয়ে সংগঠনের নাম রাখেন হিলফুল ফুজুল।
প্রসঙ্গত আগে যারা এমন সংগঠন করতে চেয়েছিলেন, তাদের কয়েক জনের নামে ‘ফজল’ শব্দ ছিল। আর আরবিতে ফজল শব্দের বহুবচন ‘ফুজুল’। সেখান থেকেই হিলফুল ফুজুল শব্দের অবতারণা (সিরাতে ইবনে কাছির, প্রথম খণ্ড, ২৫৭-২৫৯ পৃষ্ঠা)।

লেখক : শিক্ষক, মাদরাসুল হেরা, মিরপুর, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement