১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আল্লাহই চিরঞ্জীব

-

সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। মহীয়ান গরিয়ান রবের অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই রবে না। সুন্দর ব্যবস্থাপনার ভূপৃষ্ঠটির ভেতরে ও বাইরে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু মহান ও দয়াময় রবের সত্তাই বাকি থাকবে। এ জন্যই আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হলো- ‘বাকি’। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এ ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি জিনিসই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তোমার মহীয়ান ও দয়াবান রবের সত্তাই অবশিষ্ট থাকবে’ (সূরা আর রহমান : ২৬-২৭)। এই পৃথিবীর মানুষ অবিনশ^র নয়, সেসব সাজ-সরঞ্জামও চিরস্থায়ী নয়, যা তারা ভোগ করছে। অবিনশ^র ও চিরস্থায়ী শুধু মহা সম্মানিত ও সুমহান আল্লাহর সত্তা, এ বিশাল বিশ^-জাহান যার সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং যার বদান্যতায় আমাদের ভাগ্যে এসব নিয়ামত জুটেছে।
যে গুরুত্বপূর্ণ মহাসত্য সম্পর্কে জিন ও মানুষ এ দু’টি সৃষ্টিকে সাবধান করা হয়েছে তা হচ্ছে, মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া তারা আর যেসব সত্তাকেই উপাস্য, বিপদে রক্ষাকারী ও অভাব মোচনকারী হিসেবে গ্রহণ করে থাকো তারা ফেরেশতা, নবী-রাসূল, অলি-দরবেশ কিংবা চন্দ্র-সূর্য বা অন্য কোনো সৃষ্টি যাই হোক না কেন তাদের কেউই তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম নয়। অভাব মোচন ও প্রয়োজন পূরণের জন্য ওরা নিজেরাই তো মহান আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাদের নিজেদের হাতই তার সামনে প্রসারিত। তাদের ক্ষমতায় নিজেদের বিপদই যেখানে দূর করতে পারে না, সেখানে সে অন্যের বিপদ মোচন করবে কী করে। পৃথিবী থেকে আকাশমণ্ডল পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত এই মহাবিশে^ যা কিছু হচ্ছে, শুধু এক আল্লাহর নির্দেশেই হচ্ছে।
মহাবিশে^র এ কর্মক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে তাঁরই কর্মতৎপরতার এক সীমাহীন ধারাবাহিকতা চলছে। কাউকে তিনি মারছেন আবার কাউকে জীবন দান করছেন। কারো উত্থান ঘটাচ্ছেন আবার কারো পতন ঘটাচ্ছেন, কাউকে আরোগ্য দান করেছেন আবার কাউকে রোগাক্রান্ত করেছেন, কাউকে ডুবন্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করেছেন আবার সাঁতার কেটে চলা কাউকে নিমজ্জিত করেছেন। সীমা সংখ্যাহীন সৃষ্টিকে নানাভাবে রিজিক দান করছেন। অসংখ্য বস্তুকে নতুন নতুন স্টাইল, আকার-আকৃতি ও গুণবৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর পৃথিবী কখনো এক অবস্থায় অপরিবর্তিত থাকে না। তাঁর পরিবেশ ও অবস্থা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং স্রষ্টা তাকে প্রতিবারই একটি নতুনরূপে সজ্জিত করেন যা আগের সব আকার-আকৃতি থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলে যা-ই আছে সবাই তাঁর কাছে নিজের প্রয়োজন প্রার্থনা করছে। প্রতি মুহূর্তে তিনি নতুন নতুন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত’ (সূরা আর রহমান-২৯)।
সূরা আর রহমানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কুদরতের পরিপূর্ণতা, তাঁর সীমা সংখ্যাহীন দয়া ও অনুগ্রহ, গোটা বিশ্বজাহানের ব্যবস্থাপনা আল্লাহর একক নির্দেশ ও কর্তৃত্বাধীনে চলছে। আসমান ও জমিনের সব কিছুই তাঁর কর্তৃত্বাধীন। এখানে আর কারো কর্তৃত্ব নেই। আল জালিল ও যুল যালালি ওয়াল ইকরাম তথা মহামহিমান্বিত ও গৌরব মহত্বের অধিকারী। তিনি বিশ্বজাহানের গোটা ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যসহ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বিশ্বজাহানের কোনো কিছু অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী নয় এবং ছোট বড় কেউ-ই এমন নেই যে তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে আল্লাহর মুখাপেক্ষী নয়। তিনি চিরবিরাজমান এবং একমাত্র মহিমান্বিত মহত্বের অধিকারী আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বই বাকি থাকবে। তাঁর সামনে মানুষ ও জিনদের ক্ষমতা ও অস্তিত্ব খুবই নগণ্য। সূরা আর রহমান পুরোটাই একটি বক্তৃতার ভাষায় পেশ করা হয়েছে। এটি একটি আবেগময় ও উচ্চমানের ভাষণ। এ ভাষণের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার অসীম শক্তির এক একটি বিস্ময়কর দিক, তাঁর দেয়া নিয়ামতসমূহের এক একটি নিয়ামত, তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা ও পরাক্রমের এক একটি দিক এবং তাঁর পুরস্কার ও শাস্তির ব্যাপক বিস্তৃৃত ক্ষেত্রসমূহের এক একটি জিনিস বর্ণনায় জিন ও মানুষকে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে।
আল্লাহ চিরঞ্জীব ও চিরন্তন। তাঁর কোনো ক্ষয় নেই, তিনি ক্ষয়িষ্ণু তা থেকে পবিত্র। তিনি পুরাতন হন না। তাঁর সত্তাগত কোনো পরিবর্তন বিবর্তন ঘটে না। তিনি স্থান-কালের ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ কালের পরিবর্তন তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না; বরং কালের পরিবর্তন, সৃষ্টির পরিবর্তন তাঁরই সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ এমন এক চিরঞ্জীব ও চিরন্তন সত্তা যিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের দায়িত্ব বহন করছেন, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। তিনি ঘুমান না এবং তন্দ্রাও তাঁকে স্পর্শ করে না। আসমান জমিনে যা কিছু আছে তাঁর’ (সূরা বাকারা-২৫৫)। অর্থাৎ মূর্খতা নিজেদের কল্পনা ও ভাববাদিতার জগতে বসে যত অসংখ্য উপাস্য, ইলাহ ও মাবুদ তৈরি করুক না কেন আসলে কিন্তু সার্বভৌম ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও শাসন কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশভাবে একমাত্র সেই অবিনশ্বর সত্তার অংশীভূত, যার জীবন কারো দান নয়; বরং নিজস্ব জীবনী শক্তিতে যিনি স্বয়ং জীবিত এবং যার শক্তির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এই বিশ্বজাহানের সমগ্র ব্যবস্থাপনা। নিজের এই বিশাল সীমাহীন রাজ্যের যাবতীয় শাসন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক তিনি একাই। অন্য কোনো সৃষ্টির পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়, কারণ এগুলো নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহর সত্তাই একমাত্র চিরঞ্জীব ও চিরন্তন।
আল্লাহ তায়ালা হায়াত ও মউতের মালিক। তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। আল্লাহ বলেন- ‘জীবন ও মৃত্যু আমিই দান করি এবং আমিই হবো সবার উত্তরাধিকারী’ (সূরা হিজর-২৩)। সব সৃষ্টি ধ্বংসের পরে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই টিকে থাকবেন। মানুষ যা কিছু পেয়েছে, এগুলো নিছক সাময়িকভাবে ব্যবহার করার জন্য পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাঁর দেয়া সব জিনিস ত্যাগ করে সবাই বিদায় নেবে একেবারেই খালি হাতে এবং এসব জিনিস যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটিই আল্লাহর ভাণ্ডারে থেকে যাবে।
‘তিনিই জীবনহীন থেকে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটান এবং জীবন্ত থেকে জীবনহীনের’ (সূরা আল ইমরান-২৭)। পৃথিবী ও পৃথিবীর অন্তরালে যত প্রকার জীবন আছে সবার জীবন-মৃত্যুর মালিকও মহান আল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল কোনো প্রাণী এবং বাতাসে ডানা বিস্তার করে উড়ে চলা কোনো পাখিকেই দেখো না কেন, এরা সবাই তোমাদের মতোই বিভিন্ন শ্রেণী। তাদের ভাগ্যলিপিতে কোনো কিছু লিখতে আমি বাদ দেইনি। তারপর তাদের সবাইকে তাদের রবের কাছে সমবেত করা হবে’ (সূরা আনয়াম-৩৮)। অর্থাৎ তাদের জীবন দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা আবার মৃত্যুবরণ করতে হবে আল্লাহরই নির্দেশে।
সারা দুনিয়া এবং দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু সৃষ্টির প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তার নির্দিষ্ট আকার আকৃতিতে অস্তিত্ব লাভ করা পর্যন্ত পুরোপুরি তাঁরই তৈরি এবং তাঁরই দ্বারা লালিত পালিত। কোনো কিছুই আপনা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেনি কিংবা আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়ে যায়নি অথবা তার নির্মাণ ও পরিপাটিকরণে অন্য কারো সামান্যতম অবদানও নেই। সৃষ্টির পরিকল্পনা, সৃষ্টির পরিকল্পিত কাঠামোকে বাস্তবে রূপদান- এ সবই আল্লাহর একক ক্ষমতায় হয়েছে। এগুলোতে কারো সামান্যতম অবদান নেই।
তিনি নিজে যে নকশা চিন্তা করে রেখেছেন তাকে কল্পনা বা অস্তিত্বহীনতার জগত থেকে এনে অস্তিত্ব দান করেন। মানুষ যা তৈরি করে তা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট উপাদানসমূহের একটিকে আরেকটির সাথে জুড়ে দেয়। অস্তিত্ব নেই এমন কোনো জিনিসকে সে অস্তিত্ব দিতে পারে না; বরং আল্লাহর সৃষ্ট বিভিন্ন উপাদানকে ভেঙে নতুন জিনিস তৈরি করে। আকার আকৃতির ব্যাপারেও মানুষ সৃষ্টিকর্তা নয়; বরং আল্লাহর দেয়া বিভিন্ন আকার আকৃতি থেকে নকলকারী বা অনুসরণকারী।
অবয়বদানকারীও আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মানুষ! কোন্ জিনিস তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন করেছেন’ (সূরা ইনফিতার-৮)। আমাদের সুন্দর অবয়ব ও গড়ন আল্লাহর দান। মানুষের মধ্যে যেসব উপাদান আছে সেগুলো নিজে নিজে একত্র হয়ে যাওয়ার ফলে ঘটনাক্রমে তৈরি হয়ে যায়নি; বরং এক মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর আল্লাহ তায়ালা যিনি মুবদিউ ও বাদিউ তিনিই এই পূর্ণাঙ্গ মানবিক আকৃতি দান করেছেন। আমাদের সামনে হরেকরকমের প্রাণী রয়েছে, তাদের মোকাবেলায় সবচেয়ে সুন্দর শারীরিক কাঠামো এবং শ্রেষ্ঠ ও উন্নত শক্তি তাঁরই দান। সুতরাং যেহেতু মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর আল্লাহ তায়ালাকে কেউ সৃষ্টি করেননি, সেহেতু তাঁর ধ্বংস নেই, কেউ তাঁকে ধ্বংস করতে পারে না; বরং তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনি ইচ্ছা করলে সব ধ্বংস করে দিতে পারেন আবার তিনি তা গড়তে পারেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement