০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জিলহজ ১৪৪৫
`

অপচয়ের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা

-

মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় হলো আয় ও ব্যয়। জীবনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আয় অনুযায়ী ব্যয় করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন অপচয় ও অপব্যবহার না করা।
আরবি ‘ইসরাফ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো- সীমালঙ্ঘন, অপচয়, অপব্যয়, অমিতব্যয়, বাড়াবাড়ি, মাত্রাতিরিক্ত, অপরিমিতি। কিন্তু কিছু বিজ্ঞ আলেম ‘ইসরাফ’ শব্দকে ব্যয় করা ও খাওয়ার সাথে নির্দিষ্ট করেছেন। বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ আলী আল জুরজানি (৭৪০-৮১৬ হি.) রহ. ইসরাফের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : ইসরাফ হলো কোনো নিকৃষ্ট বা তুচ্ছ উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা। এও বলা হয়ে থাকে যে, ইসরাফ হলো অবৈধ বস্তু ভক্ষণ করা অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার গ্রহণ করা। উপরোক্ত অর্থ থেকে ইসরাফের সংজ্ঞা আমরা এভাবে দিতে পারি যে, মানুষ তার কথা এবং কাজে সীমালঙ্ঘন করা। আর ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ কল্যাণকর আদর্শ। তাই এতে অপচয় ও অপব্যয়ের মতো কৃপণতাও নিষিদ্ধ। কারণ কৃপণতাও মানুষের একটি মন্দ স্বভাব, বিশ্বাসঘাতকতা ও নির্দয়তার লক্ষণ। আর হালাল কাজে চাহিদার বেশি খরচ করাকে অপচয় বলা হয়। যা কুরআনের ভাষায় ‘ইসরাফ’ বলা হয়। তাই তো কুরআনে অপচয়কে শয়তানের কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর মানুষ শিশুকালে তার মা-বাবার আচরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা যদি অপচয়কারী হয়ে থাকে তাহলে সন্তানও অপচয়ের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এ জন্য স্বামী-স্ত্রীকে দ্বীন মেনে চলা বাধ্যতামূলক। আর তা সন্তানের কল্যাণের জন্যই। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে সৎকর্মপরায়ণ তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয় তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেন, ‘মেয়েদেরকে চারটি গুণ দেখে বিয়ে করতে হয় : তার সম্পদ; তার বংশমর্যাদা; তার সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারী (ধর্মপালন)। তুমি দ্বীনদার মেয়েকে বিয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দাও। অন্যথায় তোমার ধ্বংস অনিবার্য। বেশির ভাগ মানুষ অর্থ-সম্পদ হাতে এলেই হিসাব ছাড়া খরচ করে। সে একটিবারও ভেবে দেখে না যে, দুনিয়ার জীবন সর্বাবস্থায় সমান থাকে না। আজকে হাতে অর্থ আছে কালকে না-ও থাকতে পারে। তাই প্রত্যেকেরই উচিত, আল্লাহর দেয়া প্রতিটি নিয়ামত যথাযথভাবে খরচ করা।

অপচয় একটি গর্হিত কাজ। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি বস্তু অপছন্দ করেন- ১. অনর্থক এবং বাজে কথা বলা; ২. নি®প্রয়োজনে মাল নষ্ট করা এবং ৩. অত্যধিক প্রশ্ন করা।’ (বুখারি) ক. পানির অপচয়- বিনা প্রয়োজনে পানি ব্যয় করা অন্যায়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তুমি যদি সাগরপাড়ে বসেও পানি অতিরিক্ত ব্যবহার করো, তাও অপচয় হবে। খ. খাওয়া দাওয়া- প্লেটে খাবার নিয়ে ফ্যাশন বা সৌজন্যবোধ মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার না খাওয়া। আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘এবং তোমরা আহার করো ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ, আয়াত-৩১)
অপচয় ও অপব্যয়ের ক্ষতিকর দিক : অপচয় ও অপব্যয়ের ক্ষতিকর অনেকগুলো দিক রয়েছে, যেগুলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি আন্তর্জাতিক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। অযথা খরচ দুনিয়ার ব্যবস্থাপনাকে যেমন বিশৃঙ্খল করে, তেমনি ব্যক্তির আখিরাতকেও নষ্ট করে। সুতরাং এখানে অপচয় ও অপব্যয়ের কিছু ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হলো।
১. অপব্যয় হারাম উপার্জনে উদ্বুদ্ধ করে : অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে অনেক সময় মানুষ অর্থসঙ্কটে পড়ে যায়। তখন সংসারের আবশ্যকীয় ব্যয় নির্বাহ করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে হারাম উপার্জনের দিকে ধাবিত হয়। অথচ হারাম খাদ্যে গঠিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ওই শরীর যা হারাম দ্বারা গঠিত তার জন্য জাহান্নামই উপযুক্ত স্থান।’ (সহিহুল জামে, হা-৪৫১৯)
২. অপচয়ের মাধ্যমে পাপের চর্চা হয় : অপচয়ের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন পাপকাজে জড়িয়ে পড়ে। সে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অবাধ্যতায় ব্যবহার করে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে সে হারাম পথে অর্থ ব্যয় করতে উদ্যত হয়। যেমন- মদ, জুয়া, লটারি, ধূমপানসহ সব ধরনের নেশা জাতীয় দ্রব্য পান করা, আনন্দমেলা, যাত্রা, সিনেমা দেখা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে সময় ও অর্থের অপচয়ের সাথে সাথে পাপের চর্চা হয়।

তা ছাড়া ইসলামের নির্দেশনার বাইরে অতি ভোজনের মাধ্যমে বরং সে নিজেই নিজের ক্ষতি ডেকে আনে। অথচ ইসলাম অপচয় না করে পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সুন্দর নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আদম সন্তান তার পেটের তুলনায় অন্য কোনো খারাপ পাত্র ভর্তি করে না। মানুষের জন্য তো কয়েক লোকমা খাদ্যই যথেষ্ট, যা তার মেরুদণ্ডকে সোজা করে রাখবে। আর যদি একান্তই প্রয়োজন হয়, তাহলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয় আর এক-তৃতীয়াংশ নিঃশ্বাসের জন্য রাখবে।’ (তিরমিজি-২৩৮০, ইবনে মাজাহ-৩৩৪৯, সহিহাহ হা-২২৬৫)
৩. পরকালে সম্পদের হিসাব দিতে হবে : পরকালে মহান আল্লাহর সামনে প্রত্যেককে স্বীয় সম্পদের হিসাব দিতে হবে যে, সম্পদ কোথা থেকে সে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে। রাসূল সা: বলেন, ‘কিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় তার রবের কাছ থেকে একটুকুও নড়বে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, কীভাবে তা অতিবাহিত করেছে? তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কী কাজে তা বিনাশ করেছে? তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে? আর সে যতটুকু জ্ঞানার্জন করেছিল সে অনুযায়ী আমল করেছে কি-না।’ (তিরমিজি-২৪১৬, মিশকাত-৫১৯৭, সহিহাহ হা-৯৪৬)
৪. অপচয় ও অপব্যয় সম্পদ বিনষ্টের নামান্তর : অপব্যয় ও অপচয়ের মাধ্যমে সম্পদ নষ্ট হয়, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন- ১. অনর্থক কথাবার্তা বলা; ২. সম্পদ নষ্ট করা এবং ৩. অত্যধিক প্রশ্ন করা।’ (বুখারি-১৪৭৭, মুসলিম-৫৯৩)
৫. বরকতশূন্য হওয়া ও দারিদ্র্যের কবলে পড়া : অপচয়-অপব্যয় করার কারণে সম্পদে বরকত থাকে না। ফলে সম্পদ এক সময় নিঃশেষ হয়ে যায়। আর ওই ব্যক্তি তখন ঋণ করতে থাকে। অবশেষে সে অভাব-অনটনের মধ্যে পতিত হয়।
অপচয়ের বিষয়ে আমাদের করণীয় কি হবে তা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপচয় করে না, কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।’ (সূরা ফোরকান, আয়াত-৬৭)

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি


আরো সংবাদ



premium cement