০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫
`

ইয়াওমি আরাফার রোজা ও ঈদ : মত-অমত

-

সাওমি ইয়াওমা আরাফা অর্থাৎ আরাফার দিবসের রোজার ফজিলত অনেক বেশি। আল-হাজ্জু আরাফাতুন। আরাফার মাঠে অবস্থানই হজ। এ ক্ষেত্রে ‘উকুফি আরাফা’ পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। রমজানের রোজার পর এই আরাফাসহ জিলহজ মাসের আরাফার দিন পর্যন্ত রোজা রাখা সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ। যারা হজ করছেন না, তারাই এই রোজা পালন করবেন। এখন প্রশ্ন হলো- আরাফার দিন কোনটি। সহজ উত্তর হলো-হাজীরা যেদিন মিনার তাঁবু থেকে আরাফার মাঠে গিয়ে অবস্থান করেন।
নিঃসন্দেহে সৌদি আরবের আরাফার মাঠকে ঘিরেই ওই দিনটির হিসাব হয়, হয়ে এসেছে এবং হবে। ওই দিনের বাইরে পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানুষেরা রোজা রাখবে সেটি ‘আরাফা দিবস’ হবে না- এটিই স্বাভাবিক।
প্রাচীনকালের কথা ভিন্ন। সে সময় এখনকার মতো প্রযুক্তি ছিল না। আজ যেমন আপনি চাইলে সরাসরি আরাফা দিবসসহ হজের সব কার্যক্রম আপনার হাতের মুঠোর মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়েই দেখতে পারেন, প্রাচীনকালে তো সেই সুযোগ ছিল না। দুই-তিন মাসের দীর্ঘ হজ সফরে বের হতেন সে সময়কার হজযাত্রীরা। স্বাভাবিকভাবেই তখন মক্কার বাইরের দেশগুলোকে চাঁদের ওপরই নির্ভর করতে হতো। তখনকার দিনের আরাফার রোজাদাররা জানতেও পারতেন না তিনি যেদিন রোজা রেখেছেন সেই দিনই কি আরাফা দিবস ছিল? কিন্তু এখন তো আমরা জানি কবে আরাফার দিবস। সুতরাং এ নিয়ে বিতর্ক তোলার মানে হলো আমরা প্রযুক্তি-পূর্বকালেই অবস্থান করছি।
যেই হাদিস মেনে আরাফার রোজার ফজিলতের কথা বলা হচ্ছে, সেই হাদিসে জিলহজের ‘৯ তারিখ’ আরাফা দিবস- এ রকম কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে- ‘আরাফা দিবস’। যদিও সৌদি আরবে ওই দিবসটি ৯ তারিখেই পড়ে। তাহলে রাসূল সা: কেন তারিখ উল্লেখ না করে ‘ইয়াওমি আরাফা’ বললেন? মাথা খাটাতে হবে। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসাবে যদি আমরা ৯ তারিখে আরাফা দিবসের রোজা রাখি তাহলে দেখা যাবে প্রকৃত আরাফা দিবস হয়তো আগের দিন হয়ে গেছে। সুতরাং ফজিলত লাভ করতে হলে অবশ্যই যেদিন হাজীরা আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন, সেই দিনই রোজা রাখতে হবে। তারিখের হিসাবে নয়, আরাফায় হাজীদের অবস্থানের দিনেই রোজা রাখা উচিত।
আরো মনে রাখতে হবে- পৃথিবীতে লাখ লাখ মসজিদ আছে কিন্তু কাবা শরিফ একটিই। সাফা-মারওয়া, মিনা-আরাফা-মুজদালিফা একটিই। পৃথিবীর আর কোনো দেশে বা স্থানে এগুলোর অস্তিত্ব নেই। আপনি অন্য কোনো এলাকায় কাবার ডিজাইনে একটি ঘর বানিয়ে নিতে পারেন কিন্তু সেখানে তাওয়াফ করলে কাবার তাওয়াফ হবে না। কারণ ইসলামের কিছু বিধান স্থানকেন্দ্রিক অর্থাৎ ভৌগোলিক অবস্থানকেন্দ্রিক আবার কিছু বিধান সময়কেন্দ্রিক। হজ ছাড়া বাকি সবই সময়কেন্দ্রিক। অর্থাৎ সময়ের হিসাব কষে বিধানগুলো পালন করতে হবে। ইসলামের এই সময়ের ক্যালেন্ডার চান্দ্র এবং সৌর-দুটোই। হিজরি মাস শুরুর হিসাব চান্দ্র। যেমন- রমজানের হিসাব কিংবা ঈদুল ফিতরের হিসাব চান্দ্র। আবার নামাজের হিসাব সৌর। এটি গেল সময়কেন্দ্রিক হিসাব।
স্থানকেন্দ্রিক হিসেবে হজ পালনীয়। সেখানে স্থানের কোনো বিকল্প নেই। কী মজার ব্যাপার- জিলহজ মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল মানে করণীয় ইবাদত হলো সাওমু ইয়াওমি আরাফা বা আরাফার দিনের রোজা। অবশ্য সেটি যারা হজ করতে যাননি, তাদের ক্ষেত্রে। হাজীদের ক্ষেত্রে নয়। ক্যালেন্ডার দেখে তাই এই রোজা রাখা ঠিক হবে না। পৃথিবীর ভূগোলের কোনো স্থানের মানুষ যদি এ রকম থেকে থাকেন যে, হাজীরা কবে মিনা থেকে আরাফায় গিয়ে অবস্থান নেবেন তা জানেন না বা জানার সুযোগ নেই, তাদের কথা ভিন্ন। তারা তাদের গণনা পদ্ধতিতেই রাখবেন আরাফার সাওম। অনেকে বলতে পারেন, রাসূল সা: যে বছর হজ করেছেন সে বছর হজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৯ জিলহজ তারিখে। কথা সত্য। কিন্তু এ কথা কি ভেবেছেন- সেই বছর বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে জিলহজ মাসের কত তারিখ ছিল? সেই বছরও মক্কার চান্দ্র মাসের ৯ তারিখেই আরাফা দিবস পালিত হয়েছিল- বাংলাদেশের হিসাবে নয়।
এ নিয়ে যারা বিতর্ক করবেন- তাদের ব্যাপারে কুরআন বলেছে- আফালা তা’কিলুন? এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছেন আল্লাহ।
অতএব আমরা যখন সুস্পষ্টভাবে জানতে পারছি, দেখতে পাচ্ছি আরাফার দিবস কবে- তখন স্থানকেন্দ্রিক ইবাদতের হিসাবকে সময়কাল হিসাবে দেখার কিংবা পালন করার কোনো সুযোগ আছে কি? অবশ্যই ভাবতে হবে।
‘ইয়াওমি আরাফার’ রোজার বিষয়টি আরো একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো ঈদুল আজহা। ইসলামে রোজা রাখা-না রাখা খুবই ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। রোজা না রাখার কথা বলা হয়েছে পাঁচ দিন। ঈদুল ফিতরের দিন এবং ঈদুল আজহার দিন থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত চার দিন। সুতরাং ‘ইয়াওমি আরাফা’ সঠিকভাবে নিরূপিত না হলে সওয়াবের উদ্দেশে ঈদের দিন রোজা রেখে হারাম কাজের শাস্তি পাওয়ার মতো দুর্ভাগ্যবান হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
আমাদের মস্তিষ্কে আল্লাহ সহস্রাধিক কোটি স্নায়ুকোষ বা নিউরন কী কাজে দিয়েছেন- ভাবতে হবে। বিশেষ করে যারা ফতোয়া দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগি করার কাজে সহযোগিতা করেন, সেসব বিজ্ঞ আলেম সমাজকে স্নায়ুকোষের ব্যবহার বেশি বেশি করতে হবে। আল্লাহ আমাদের জ্ঞান-বিবেক-মেধা-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা বাড়িয়ে দিন, জ্ঞান-গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে দিন, সহজ দ্বীনকে কঠিন করার হাত থেকে রক্ষা করার মানসিকতা দিয়ে ধন্য করুন। আমিন।
এবার ইয়াওমি আরাফা ছিল শনিবার। শুক্রবার দিবাগত রাতে সাহরি খাবার সময় ছিল। সে অনুযায়ী রোববার ছিল ঈদুল আজহা। রোজা রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ কোনো কোনো দেশে সেদিন ঈদ হয়নি, হয়েছে সোমবার। আমিও সোমবারের দেশে ছিলাম। একা একা তো আর ঈদের জামাত করা যায় না, অসামাজিক হয়ে কোরবানিও করা ঠিক নয়। সুতরাং কিংবর্তব্যবিমূঢ় হতে হয়েছে। এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি বলে মনে করি।


আরো সংবাদ



premium cement