১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আত্মজিজ্ঞাসা আত্মসমালোচনা

-

(প্রথমাংশ)
হতে পারে আমরা স্বল্পসংখ্যক মুমিন মুসলিম আত্মজিজ্ঞাসা বা আত্মসমালোচনা করি। আত্মজিজ্ঞাসা হবে অনেক অনেক যথা- আমি কি ভালো বা সৎ লোক নাকি মন্দ বা অসৎ লোক? উত্তর যদি হয়- আমি সৎ লোক তাহলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে থাকব সঙ্গত কারণে। পক্ষান্তরে উত্তর যদি পাই- আমি অসৎ লোক, সাথে সাথে আমাকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে তাওবাহ করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সৎ লোকে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য। তা ছাড়া আমাকে শরণাপন্ন হতে হবে ধর্মীয় জ্ঞানে সন্তোষজনক পর্যায়ের জ্ঞানী লোকের ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে যা আমার সৎ লোকে পরিণত হওয়ার জন্য অপরিহার্য। আমরা মরণশীল, আমাদেরকে পূর্বনির্ধারিত সময়ে মৃত্যুবরণ করতেই হবে হাশরের মাঠে যথাসময়ে দাঁড়ানোর এবং পরবর্তী কার্যক্রম বা হিসাব-নিকাশের কাঠগড়ায়, যার পরিণাম হবে হয় জান্নাত অথবা জাহান্নাম। আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা থাকতে হবে ঈমান নিয়ে সৎকর্মশীল হয়ে মৃত্যুবরণ করার, যাতে করে আল্লাহ স্থান দেন জান্নাতে।
আমি যখন আমার উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব পেলাম আমি সৎ লোক- তখন প্রশ্ন আসবে আমি নিজেকে ভালো বা সৎ লোক সাব্যস্ত করলাম কিসের ভিত্তিতে বা কী কারণে? তখন আমাকে নির্ণয় বা গণনা করতে হবে ভিত্তি বা কারণগুলো যা হতে পারে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যথা- আল্লাহ, রাসূল-নবীগণ, আসমানি কিতাবসমূহ ও কুরআনসহ ফেরেশতাগণ, পরকাল, তাকদির, মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন ইত্যাদি। আমি যথাযথ মুসলিম অর্থাৎ আল্লাহর সব আদেশ যথাসাধ্য পালন করি যথা- সালাত প্রতিষ্ঠা, সিয়াম সাধনা, জাকাত প্রদান, হজব্রত পালন, হালাল বা বৈধ উপার্জন, দান-সাদকা, পিতা-মাতার আদেশ পালন ও তাদের ভক্তিশ্রদ্ধা, সত্য বলা, ন্যায়বিচার, ধর্মীয় জ্ঞানার্জন, সৎ চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা, পরোপকার, অন্যের শুভকামনা, সদাচরণ ইত্যাদি চর্চা করি, অন্যের সুখে সুখী, অন্যের দুঃখে দুঃখী, সমবেদনা, রোগী দেখা, অন্যের আপদে বিপদে এগিয়ে যাওয়া, সাধ্যমতো ঋণ দান করা, মানবাধিকার সংরক্ষণ ইত্যাদি গুণাবলি ধারণ করি। পক্ষান্তরে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা বা নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড বর্জন করি এবং অন্যকেও বর্জন করানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করি। যথা- মিথ্যা বলা, সুদ খাওয়া, অবৈধ উপার্জন, ব্যভিচার, অবিচার, হারাম খাদ্য ভক্ষণ, অসদাচরণ, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, সন্তানদের প্রতি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে অবহেলা, চুরি-ডাকাতি, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, আল্লাহর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য ইত্যাদি কর্মকাণ্ড করা, অহঙ্কারী, ক্রোধান্বিত, পিতা-মাতার অবাধ্য, দায়িত্বহীন ইত্যাদি হওয়া, পরশ্রীকাতরতা, পরনিন্দা, অশালীন চলাফেরা (বিশেষ করে মহিলাদের জন্য), ধর্মীয় জ্ঞানে অজ্ঞতা, রাসূল সা:-এর অবাধ্য হওয়া, এক কথায় যেকোনো নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত বা অভ্যস্ত থাকা। অপর দিকে আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর যদি পাওয়া যায়- আমি অসৎ লোক, তখন প্রশ্ন আসবে কিসের ভিত্তিতে বা কী কারণে আমি আমাকে অসৎ লোক নির্ধারণ করলাম। কারণগুলো হতে পারে উপরোল্লিখিত সৎ কাজগুলো আমার দ্বারা পরিপূর্ণভাবে বা আদৌ করা হয় না এবং অসৎ কাজগুলো আমি প্রায় বা সময় সময় করে থাকি, সবগুলো অথবা আংশিক।
আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়ার পর যদি উত্তর হয় আমি সৎ লোক তাহলে আমার আন্তরিক চেষ্টা থাকতে হবে যে, আলোচ্য সৎ কাজগুলোর পরিধি বা ব্যাপকতা কিভাবে বাড়াতে পারি এবং অসাধারণ সতর্ক ও সাধনা থাকতে হবে শয়তানের প্ররোচনা ও প্রতারণা থেকে আল্লাহর নিরাপত্তা পাওয়ার এবং সাথে সাথে এ দোয়া দুটো প্রচুর পরিমাণে আল্লাহর দরবারে পেশ করার যথা- ১. আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম। আমি বিতাড়িত শয়তানের প্ররোচনা ও প্রতারণা থেকে আল্লাহর কাছে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি। ২. অকুর রব্বি আয়ুজুবিকা মিন হামাজাতিশ শায়াতিনি ওয়া আয়ুজুুবিকা রব্বি আইইয়াহ জুুরুন। হে রাসূল! বলুন, হে আমার প্রতিপালক! আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি। হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার কাছে তাদের উপস্থিতি থেকে, অর্থাৎ শয়তান যেন আমার কাছে আসতেই না পারে। (সূরা মুমিনুন, আয়াত : ৯৭-৯৮)
সূরা মুমিনুনের উপরোক্ত আয়াতদ্বয় থেকে শয়তানের প্ররোচনার ভয়াবহতা এবং অকল্যাণের ব্যাপকতা সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ তাঁর রাসূল সা:-কে আরেকটি দোয়া শিখিয়েছেন আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অপকারিতা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য, যা ছয়টি আয়াতবিশিষ্ট এবং সর্বশেষ সূরা নাসে বর্ণিত আছে : ১. হে রাসূল! আপনি বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের প্রতিপালকের; ২. মানুষের অধিপতির; ৩. মানুষের উপাস্যের; ৪. আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অপকারিতা থেকে; ৫. যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরসমূহে; ৭. জিনদের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে। লক্ষণীয়, সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত- কুমন্ত্রণাদাতা মানুষের মধ্যেও বিরাজমান আছে।
উপরোক্ত দোয়াসমূহ ছাড়া রাসূল সা: আরো কমপক্ষে তিন ধরনের দোয়া শয়তানের ধোঁকা এবং প্রবঞ্চনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য নিয়মিত পাঠ করতেন। বিতাড়িত অভিশপ্ত শয়তান যে শুধু প্ররোচনাকারী তা নয়, সে মহাপ্রতারকও বটে। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- ‘শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।’ (সূরা ফুরকান-২৯)
উপরোক্ত আলোচন থেকে আমাদের শিক্ষণীয়, আমরা দুর্বল মুমিন, মুসলিম; ফলে আমাদেরকে উপরোক্ত দোয়াগুলো বিশেষ করে রাসূল সা:-কে আল্লাহর শেখানো উপরোক্ত দোয়াদ্বয় বেশি বেশি এবং যথাসাধ্য পাঠ করতেই হবে, তাতে করে ইনশাআল্লাহ আমরা অভিশপ্ত শয়তানের প্রতারণা, ধোঁকা, প্রবঞ্চনা ইত্যাদি থেকে আল্লাহর রহমতে নিরাপত্তা অর্জন করতে পারি। সর্বোপরি আল্লাহর নিষেধাজ্ঞাটি আমাদেরকে পালন করতেই হবে। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- ‘হে মুমিনরা! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে (অবশ্যই সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ) শয়তান তো অশ্লীলতা ও অসৎ কাজের নির্দেশ বা প্ররোচনা দেয়।’ (সূরা নূর-২১)
অভিশপ্ত ও বিতাড়িত ভয়াবহ শয়তান কতখানি মারাত্মক মহাপ্রতারক, ধোঁকাবাজ এবং প্ররোচক তা সহজেই অনুমেয়, যখন সে প্রতারণা ও প্ররোচনার মাধ্যমে অসাধারণ সম্মানিত ও আল্লাহর সান্নিধ্যে অবস্থানরত আদি পিতা আদম আ:-কে মা হাওয়া আ:-সহ জান্নাত থেকে বের করতে সক্ষম হলো। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- ‘অতঃপর শয়তান তাদের (আদম আ: ও হাওয়া আ:) পদস্খলন ঘটিয়ে দিলো এবং তারা যেখানে ছিল সেই সুখ-সম্মান (জান্নাত) থেকে তাদেরকে বের করল এবং আমি (আল্লাহ) বলেছিলাম যে, তোমরা বেহেশত থেকে নেমে যাও, তোমরা (মানবজাতি) একে অন্যের শত্রু, আর পৃথিবীতে তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্ট সময়ের অবস্থিতি ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।’ (সূরা বাকারাহ-৩৬)
সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোন, শয়তানের আলোচ্য মহাপ্রতারণা ও প্ররোচনার স্বরূপ ছিল কত উঁচু স্তরের কুমন্ত্রণা-শয়তান আল্লাহর নামে শপথ করে আদম আ: ও হাওয়া আ:-কে বলে যে, নিষিদ্ধ গাছের কাছেও না যাওয়ার যে নির্দেশ আপনাদেরকে দেয়া হয়েছে তার বিশেষ কারণ আছে। কারণ হলো ওই গাছের ফল ভক্ষণ করলে আপনারা বেহেশতে চিরকাল থাকতে পারবেন, চিরসুখী হতে পারবেন এবং আল্লাহ পাকের চিরসান্নিধ্য লাভে সক্ষম হবেন।’ (সূত্র : তাফসিরে নূরুল কুরআন-প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২৪)
আমরা শয়তানের উপরোক্ত মহাপ্রতারণা, প্ররোচনা বা ধোঁকা থেকে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করব যে, আমরা দুর্বল ঈমানদার অতি সাধারণ মানুষ। ফলে আলোচ্য শয়তানের প্ররোচনা বা প্রতারণা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য আমাদেরকে কঠোর সাধনা ও সংগ্রামে নিয়োজিত থাকতে হবে এবং আল্লাহর শিখানো উপরোক্ত দুটো দোয়া পাঠ করার মাধ্যমে যথাসাধ্য তার আশ্রয় প্রার্থনা করে যেতেই হবে।
হে আল্লাহ! দয়া করে আমাদেরকে আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনায় অভ্যস্ত এবং শয়তানের প্ররোচনা বা প্রতারণা থেকে আপনার আশ্রয় দান করে সৎকাজ বাস্তবায়ন ও অসৎকাজ বর্জনের মাধ্যমে সৎ মানুষ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশী জেলে ভারতে ধরে নিয়ে যাওয়ায় জামায়াতের উদ্বেগ বিস্ফোরণে আফগান শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী নিহত জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে ষড়যন্ত্রকারীরা অবশ্যই ব্যর্থ হবে : আমিরে জামায়াত অবসরে গেলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ জিয়াউল করিম জাতিসঙ্ঘের আরো জোরদার সহযোগিতার আহ্বান ঢাকার আওয়ামী লীগ একটি পাপিষ্ঠ দলের নাম : মাসুদ সাঈদী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা : কুলাউড়ায় আ’লীগ নেতা আজাদ গ্রেফতার খুনকে অপমৃত্যু হিসেবে রেকর্ড করলেই ওসি দায়ী : ডিএমপি কমিশনার সিরিয়াকে বশে রাখতে দামেস্কের কাছে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায় ইসরাইল ভারতের সাথে বিদ্যুৎ নিয়ে চুক্তিগুলো বাতিল সহজ নয় : রিজওয়ানা হাসান গৌরনদীতে মাদককারবারির কারাদণ্ড

সকল