১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাতাস আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি

-


আলকুরআনের আলোকে বাতাস আল্লাহর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। আলকুরআনের আলোকেই বাতাস দুই প্রকারের হয়ে থাকে। এক প্রকার বাতাস রয়েছে যা আল্লাহর ফজল ও করম বয়ে নিয়ে আসে যাকে আমরা রহমতের বাতাস বলে অভিহিত করি। দ্বিতীয় প্রকারের বাতাস আল্লাহর আজাব বয়ে নিয়ে আসে যাকে আমরা গজবের বাতাস বলে থাকি।
রহমতের বাতাস, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহই বাতাস পাঠান ফলে তা মেঘমালা উঠায়, তারপর তিনি এ মেঘমালাকে আকাশে ছড়িয়ে দেন যেভাবেই চান সেভাবে এবং তাদের খণ্ড-বিখণ্ড করেন, তারপর তুমি দেখো বারিবিন্দু মেঘমালা থেকে নির্গত হয়েই চলছে। এ বারিধারা যখন তিনি নিজের বান্দাদের মধ্যে থেকে যার ওপর চান বর্ষণ করেন তখন তারা আনন্দোৎফুল্ল হয়। অথচ তার অবতরণের আগে তারা হতাশ হয়ে যাচ্ছিল। আল্লাহর অনুগ্রহের ফলগুলো দেখো, মৃত পতিত ভূমিকে তিনি কিভাবে জীবিত করেন, অবশ্যই তিনি মৃতদের জীবন দান করেন এবং তিনি প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর শক্তিশালী।’ (সূরা রুম : ৪৮-৫০)

আল্লাহ বলেন-‘আর আল্লাহই বাতাসকে নিজের অনুগহের পূর্বাহ্নে সুসংবাদবাহীরূপে পাঠান। তারপর যখন সে পানিভরা মেঘ বহন করে তখন কোনো মৃত ভূখণ্ডের দিকে তাকে চালিয়ে দেন এবং সেখানে বারিবর্ষণ করে (সেই মৃত ভূখণ্ড থেকে) নানা প্রকার ফল উৎপাদন করেন। দেখো, এভাবে আমি মৃত্যুর অবস্থা থেকে বের করে আনি। হয়তো এ চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ থেকে তোমরা শিক্ষা লাভ করবে।’ (সূরা আ’রাফ-৫৭)

গজবের বাতাস যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তা ছাড়া তোমাদের জন্য নিদর্শন আছে আ’দ জাতির মধ্যে যখন আমি তাদের ওপর এমন অশুভ বাতাস পাঠালাম যে, তা যে জিনিসের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলো তাকেই জরাজীর্ণ করে ফেলল।’ (সূরা জারিয়াত-৪১) এ বাতাসের জন্য ‘আকিম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা বন্ধ্যা নারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অভিধানে এর প্রকৃত অর্থ ‘ইয়াবিস’ বা শুষ্ক । যদি শব্দটিকে আভিধানিক অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে এর অর্থ হবে- তা ছিল এমন প্রচণ্ড গরম ও শুষ্ক বাতাস যে, তা যে জিনিসের ওপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে তাকে শুষ্ক করে ফেলেছে। আর যদি শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার অর্থ হবে- তা ছিল বন্ধ্যা নারীর মতো এমন হওয়া যার মধ্যে কোনো কল্যাণ ছিল না। তা না ছিল আরামদায়ক, না ছিল বৃষ্টির বাহক। না ছিল বৃক্ষরাজির ফলবানকারী, না এমন কোনো কল্যাণ তার মধ্যে ছিল যে জন্য বাতাস প্রবাহিত হওয়া কামনা করা হয়। অন্য স্থানগুলোতে বলা হয়েছে, এ বাতাস শুধু কল্যাণহীন ও শুষ্কই ছিল না; বরং তা প্রচণ্ড ঝড়ের আকারে এসেছিল যা মানুষকে শূন্যে তুলে সজোরে আছড়িয়ে ফেলেছে এবং অবস্থা একাধিকক্রমে আট দিন ও সাত রাত পর্যন্ত চলেছে। এভাবে আ’দ জাতির গোটা এলাকা তছনছ করে ফেলেছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আর আ’দকে কঠিন ঝঞ্ঝাবাতাস দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। যা তিন, সাত ও আট দিন ধরে অবিরাম তাদের ওপর চাপিয়ে রেখেছিলেন। (তুমি সেখানে থাকলে) দেখতে পেতে তারা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে আছে যেন খেজুরের পুরনো কাণ্ড।’ (সূরা হাক্কাহ : ৬-৭)

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তাদের অবস্থা ছিল এই যে, পৃথিবীতে তারা অন্যায়ভাবে নিজেদের বড় মনে করে বসেছিল এবং বলতে শুরু করেছিল; আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তারা এ কথা বুঝল না যে, আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকারই করে চলল। অবশেষে আমি কিছু অমঙ্গলকর দিনে তাদের ওপর প্রবল বাতাস পাঠালাম যেন পার্থিব জীবনেই তাদের অপমান ও লাঞ্ছনাকর শাস্তি আস্বাদন করাতে পারি। আখিরাতের আজাব তো এর চেয়েও অধিক অপমানকর। সেখানে কেউ তাদের সাহায্যকারী থাকবে না।’ (সূরা হামিম আস সিজদা : ১৫-১৬)

আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘তিনিই তোমাদের জলেস্থলে চলাচলের ব্যবস্থা করেন। কাজেই যখন তোমরা নৌকায় চড়ে অনুকূল বাতাসে আনন্দে সফর করতে থাকো, তারপর অকস্মাৎ বিরুদ্ধ বাতাস প্রবল হয়ে উঠে, চারদিক থেকে ঢেউয়ের আঘাত লাগতে থাকে এবং আরোহীরা মনে করতে থাকে তারা তরঙ্গবেষ্টিত হয়ে গেছে তখন সবাই নিজের আনুগত্যকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তার কাছে দোয়া করতে থাকে এবং বলতে থাকে- যদি তুমি আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো তাহলে আমরা শোকরগুজার বান্দা হয়ে যাবো।’ (সূরা ইউনুস-২২)
আলকুরআনেই অন্যত্র বলা হয়েছে- ‘সেখান থেকে তারা ফিরে বেহুদা কথা বলতে থাকে। হয় তারা এ ধরনের কথা অস্বীকার করে অথবা নিজেদের কৃতিত্বের প্রকাশ করতে থাকে।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আর তোমাদের কি এ ধরনের কোনো আশাঙ্কা নেই যে, আল্লাহ আবার কোনো সময় তোমাদের সাগরে নিয়ে যাবেন এবং তোমাদের অকৃতজ্ঞতার দরুন তোমাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘূর্ণি পাঠিয়ে তোমাদের ডুবিয়ে দেবেন এবং তোমরা এমন কাউকে পাবে না, যার কাছে তোমাদের এ পরিণতির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে?’ (সূরা বনি ইসরাইল-৬৯)

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর আমি যদি এমন একটি বাতাস পাঠাই যার প্রভাবে তারা দেখে তাদের শস্য পীতবর্ণ ধারণ করেছে তাহলে তো তার কুফরি করতে থাকে।’ (সূরা রুম-৫১) তা ছাড়া রহমতের বারিধারার পরে যখন শস্যক্ষেত সবুজ শ্যামল হয়ে ওঠে তখন যদি এমন কোনো কঠিন শৈত্য বা উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ চলে, যার ফলে পাকা শস্য একেবারে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। তখন তারা আল্লাহর কুৎসা গাইতে থাকে এবং তাকে দোষারোপ করতে থাকে এই বলে যে, আমাদের ওপর এ কেমন বিপদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ যখন আল্লাহ তাদের ওপর তাঁর অনুগ্রহধারা বর্ষণ করে চলছিলেন তখন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরিবর্তে তার অমর্যাদা করেছিল।’
বাতাস অপকারের চেয়ে মানুষের উপকারেই বেশি ব্যবহৃত হয়। আল কুরআন থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের রিজিককে বহুলাংশে বাতাসের ওপর নির্ভরশীল করে দিয়েছেন।

যখন প্রচণ্ড গরম শুরু হয় তখন মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, চারদিকে দিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়। একটু বৃষ্টির জন্য মানুষ ছাতক পাখির মতো হা-হুতাশ শুরু করে। বাতাস চলাচলহীন বদ্ধ অবস্থা যাকে আমরা ভ্যাপসা বা গুমোট বাধা গরম বলে থাকি তখন মানুষের শ^াসরুদ্ধ হয়ে আসে। সে সময় আমরা একটু রহমতের বাতাস ও বৃষ্টির আশা করে থাকি। বৃষ্টি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বৃষ্টিতে বাতাস না থাকার কারণে এই বৃষ্টি আরো গুমোট অবস্থার সৃষ্টি করে। মানুষ তখন বলতে থাকে, বৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু গরম কমে নাই। কিন্তু বৃষ্টিতে যদি বাতাস থাকে তাহলে বৃষ্টির সাথে ঠাণ্ডাও নেমে আসে ফলে মানুষ স্বস্তির নিঃশ^াস ছাড়ে।
সুতরাং বাতাস আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত। যারা আল্লাহর এই নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় না করে উল্টো তার বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়, তাদের জন্য এই বাতাসই আল্লাহর নির্দেশে গজব হিসেবে আবির্ভূত হয়।
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement