১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জাহান্নাম থেকে মুক্তি

-

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।’ (সূরা আলে ইমরান-১৮৫) আর মৃত্যুর মাধ্যমেই দুনিয়ার জীবনের সমাপনী আসে এবং আখিরাতের অনন্ত জীবনের সূচনা হয়। এ জীবনের দু’টি অবস্থান। একটি জান্নাত, আরেকটি জাহান্নাম। তারাই হবে জান্নাতি যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নিষেধ মেনে কুরআন ও হাদিসের আলোকে দুনিয়ার বুকে জীবনযাপন করেছে। আর যারা তা অমান্য করেছে তারাই জাহান্নামি। আর জাহান্নাম শাস্তির জায়গা ও দুঃখের কারাগার। তবে এমন কিছু আমল আছে, যা মানুষকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে।
জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচুন : জাহান্নামের আগুন থেকে নিজে বাঁচুন এবং পরিবারকে বাঁচান। আল্লাহ তায়ালার আদেশও অনুরূপ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। সেখানে রূঢ় স্বভাব ও কঠিন হৃদয়ের ফেরেশতারা নিয়োজিত থাকবে, যারা কখনো আল্লাহর কোনো নির্দেশ অমান্য করে না। তাদের যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে।’ (সূরা আত-তাহরিম-৬) এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, মা-বাবা বা পরিবার প্রধানের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নিষেধ মেনে দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করলে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এরপর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে তার পরিবার-পরিজনকেও জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা।
জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রার্থনা : মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানী লোকের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও জমিন সৃষ্টি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে আর বলে-হে আমাদের প্রতিপালক! এসব আপনি নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র, আপনি আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)
জাহান্নাম থেকে সতর্ক থাকুন : সিমাক ইবনু হারব রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘একবার নুমান ইবনে বাশির রা: জুমার খুতবায় বললেন, আমি রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘আমি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি। শোনো, জাহান্নাম থেকে আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি।’ এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি দূরের বাজারেও অবস্থান করত, তাহলে এই কথাগুলো সে শুনতে পেত। আর এই পরিস্থিতিতে রাসূল সা:-এর চাদর কাঁধ থেকে নিচে তাঁর দুই পায়ের কাছে পড়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমাদ-১৮৩৯৮)
হযরত আদি ইবনে হাতেম রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, এক মজলিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো; এরপর তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর আবার বললেন, ‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো।’ এরপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং অস্বস্তি প্রকাশ করলেন। এ রকম তিনবার করলেন তিনি। তখন আমাদের মনে হলো, যেন তিনি জাহান্নাম দেখছেন। তারপর বললেন, ‘অর্ধেক খেজুর সাদকা করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। কেউ তা-ও না পারলে সে যেন উত্তম কথা বলার দ্বারা জাহান্নাম থেকে বাঁচে।’ (বুখারি-১৪১৭, মুসলিম-১০১৬)
গিবতমুক্ত জীবনযাপন : কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি অন্যের কাছে প্রকাশ করাকে গিবত বলে। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে গিবত খুবই জঘন্য ও নিন্দনীয় কাজ এবং কবিরা গুনাহ। তাই এ থেকে মুক্ত থাকা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। গিবতমুক্ত জীবন গড়তে পারলে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার (মুসলিম) ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার ইজ্জত-সম্মান রক্ষায় সহায়তা করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনে তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।’ (সুনানে তিরিমিজি-১৫২৮)
দান-সাদকা : ইসলাম এমন একটি জীবন-দর্শন, যার অন্যতম সৌন্দর্য হলো দান-সাদকা ও মানব কল্যাণ। দান-সাদকা মানুষের উত্তম বিনিয়োগ। নিয়মিত দান-সাদকা করলে জাহান্নাম দূর হয়, জান্নাতের নিশ্চয়তা লাভ হয়। আবু হুরায়রা রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘দানশীল মানুষ আল্লাহর অতিশয় নিকটে থাকেন, মানুষেরও নিকটবর্তী এবং জান্নাতেরও কাছে থাকেন। জাহান্নাম তার থেকে দূরে থাকে।’ (তিরমিজি-৬৯৪)
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন : আল্লাহ তায়ালার ভয়ে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে পারা গোটা পৃথিবীর প্রশান্তি, পরিতৃপ্তি ও মুগ্ধতার চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। যার মূল্য হচ্ছে কিয়ামতের দিনে আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি। চোখের পানির কত মূল্য! এই চোখের পানি আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। দুধ দোহন করার পর তা যেমন আর গাভীর ওলানে ফিরিয়ে নেয়া অসম্ভব। আল্লাহর পথে জিহাদের ধুলোবালি এবং জাহান্নামের আগুন কখনো একত্রিত হবে না।’ (তিরমিজি-১৬৩৩, মুসনাদে আহমাদ-১০৫৬৭, মিশকাত-৩৮২৮) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘দুই প্রকার চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না- ১. যে চোখ আল্লাহ তায়ালার ভয়ে ক্রন্দন করে এবং ২. যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারাদারিতে নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করে।’ (তিরমিজি-১৬৩৯)
অশ্রু হৃদয়ের প্রশান্তি। অশ্রুতে আছে মুক্তি; হোক তা মাছির মাথা পরিমাণ। হযরতআবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহর (আজাবের) ভয়ে যে মুমিন বান্দার দু’চোখ থেকে অশ্রু বের হয়, যদিও তা মাছির মাথা পরিমাণ হয়; এরপর তার চেহারায় কিছু গড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৪১৯৭)
সুন্দর ব্যবহার : মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করলে মানুষ যেমন খুশি হয়, তেমনি মহান আল্লাহও খুশি হন এবং পুরস্কৃত করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো না যে, কোন ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম হারাম এবং জাহান্নামের জন্য কোন ব্যক্তি হারাম? যে ব্যক্তি মানুষের কাছাকাছি থাকে, সহজ-সরল স্বভাবের, নম্রভাষী ও সদাচারী গুণে গুণান্বিত হয়।’ (তিরমিজি-২৪৮৮)
নামাজ আদায় : নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হজরত হানজালা উসাইদি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথ পাবন্দির সাথে আদায় করে, উত্তমরূপে অজু করে, সময়ের প্রতি খেয়াল রাখে, রুকু-সিজদা ঠিকমতো আদায় করে এবং এভাবে নামাজ আদায় নিজের ওপর আল্লাহ তায়ালার হক মনে করে, জাহান্নামের আগুন তার জন্য হারাম করে দেয়া হবে।’ (আহমাদ-৪/২৬৭)
আয়াতুল কুরসি পাঠ : পবিত্র কুরআনের শ্রেষ্ঠতম আয়াত হলো আয়াতুল কুরসি। এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ নাম ও গুণাবলি আলোচিত হয়েছে। এই আয়াতটি খুবই ফজিলতপূর্ণ। আয়াতুল কুরসি পাঠ করলে মানব জাতির অনেক কল্যাণ সাধিত হয় এবং বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে বাঁচা যায়। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, মৃত্যুর সাথে সাথে সে জান্নাতবাসী হবে।’ (সুনানে নাসায়ি-৫/৩৩৯)
রোজা পালন : রোজা একটি কল্যাণকর ইবাদত। রোজা ইহকাল ও পরকালে মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। হযরত ওসমান রা: বলেন, আমি রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘যুদ্ধের মাঠে ঢাল যেমন তোমাদের রক্ষাকারী, রোজাও তদ্রƒপ জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল।’ (নাসায়ি-২২৩০) রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য এক দিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তায়ালা ওই এক দিনের বিনিময়ে তার থেকে জাহান্নামকে ৭০ বছর (পরিমাণ পথ) দূরে রাখবেন।’ (বুখারি-২৮৪০)
জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া : দোয়া হলো আল্লাহর কাছে চাওয়ার অপূর্ব ও অতুলনীয় মাধ্যম। দোয়া মুমিনের প্রাপ্তি ও মুক্তির হাতিয়ার। দোয়াও একটি ইবাদত। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তিনবার আল্লাহ তায়ালার কাছে জান্নাত প্রার্থনা করে, জান্নাত তখন বলে, হে আল্লাহ! তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। আর যে ব্যক্তি তিনবার আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চায়, জাহান্নাম তখন আল্লাহ তায়ালার কাছে বলে, হে আল্লাহ! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন।’ (তিরমিজি-২৫৭২)
লেখক : সম্পাদক মাসিক সারস, পূর্ব রূপসা, খুলনা


আরো সংবাদ



premium cement