১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কোরবানির পশু নির্বাচনে শরিয়তের নির্দেশনা

-

কোরবানি, বান্দা কর্তৃক মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন ও আত্মত্যাগের এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পরিভাষায়, ঈদুল আজহার দিন থেকে অর্থাৎ ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানির দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু জবাই করাই হচ্ছে কোরবানি। শরিয়তের দৃষ্টিতে, প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করে না, তাদের ব্যাপারে নবীজী সা: কঠোরতা দেখিয়েছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩১২৩)

তবে কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য সঠিক পশু নির্বাচন করা জরুরি। হাদিসের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী দোষ-ত্রুটিমুক্ত পশু ক্রয় করা সবার জন্য আবশ্যক। কেননা, কোরবানির পশুর মধ্যে নির্দিষ্ট গুণাবলি থাকা ও বয়সের হওয়া আবশ্যক, যা ইসলামী শরিয়াহ নির্ধারণ করেছে। তা না হলে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না। যেমন-

১. পশুর বয়স হওয়া : শরিয়তের বিধান মতে, ‘গৃহপালিত জন্তু যথাক্রমে উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা দিয়ে কোরবানি করা বৈধ।’ এগুলো ছাড়া অন্য পশু দিয়ে কোরবানি বৈধ নয়। কোনো প্রকার পাখি দিয়ে কোরবানি করা জায়েজ নেই। (হিদায়া-৪/৪৩২)

আলোচ্য পশুগুলোকে কুরআনের ভাষায় বাহিমাতুল ও বাহিমাতিল আনআম অর্থাৎ চতুষ্পদ জন্তু বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে শব্দগুলো তিন জায়গায় যথাক্রমে সূরা মায়েদার ১ নং আয়াতে এবং সূরা হজের ২৮ ও ৩৪ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। কোরবানির ক্ষেত্রে পশু পরিপূর্ণ বয়সের হতে হবে। অর্থাৎ পশুর নির্দিষ্ট বয়স না হলে কোরবানি আদায় হবে না। এক্ষেত্রে উট পাঁচ বছর বয়সের হতে হবে, গরু ও মহিষ দুই বছরের হতে হবে এবং ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত। একদিন কম হলেও বৈধ হবে না। (কিফায়াতুল মুফতি-৮/১৮৯) তবে ফতোয়ার গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ‘ছয় মাসের ভেড়া, দুম্বা মোটাতাজা হলে এবং দেখতে এক বছর বয়সের মতো দেখা গেলে, এসব পশু দিয়ে কোরবানি করা বৈধ।’

২. চোখ-কান ঠিক থাকা : যে পশু দিয়ে কোরবানি করা হবে, শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী সে পশুর চোখ, কান ও লেজ ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। যেমন- হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন কোরবানির পশুর চোখ ও কান উত্তমরূপে দেখে নিই। আর আমরা যেন কানের অগ্রভাগ কাটা, কানের পেছন দিক কাটা, লেজ কাটা এবং কানের গোড়া থেকে কাটা পশু কোরবানি না করি। (সুনানে আন-নাসায়ি-৪৩৭২)

ফতোয়ার গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, কান এবং লেজ অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি কাটা হলে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না। এমনকি উভয় কানের কাটা অংশ যোগ করলে এক কানের অর্ধেক পরিমাণ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তাহলে এ পশু দিয়ে কোরবানি না করাই উত্তম। করলে কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। (আহকামে কোরবানি)

৩. ত্রুটিমুক্ত হওয়া : কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে পশু দোষ-ত্রুটিমুক্ত হওয়া আবশ্যক। কেননা, রাসূলুল্লাহ সা: পরিপূর্ণ সুস্থ ও দোষমুক্ত পশু দিয়ে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, চার ধরনের দোষযুক্ত পশু কোরবানি করা বৈধ নয়। যেমন- ক. অন্ধ, যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট; খ. রুগ্ণ, যার রোগ সুস্পষ্ট; গ. খোঁড়া, যার খোঁড়ামি সুস্পষ্ট এবং ঘ. বৃদ্ধ ও দুর্বল, যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে। (সুনানে আবু দাউদ-২৮০২)

৪. দাঁত ও শিং থাকা : পশুর যদি এমন পরিমাণ দাঁত থাকে যা দিয়ে ঘাস খেতে পারে, তাহলে কোরবানি বৈধ হবে। আর যদি ঘাস খেতে না পারে, তাহলে কোরবানি বৈধ হবে না। চাই দাঁত বেশি থাকুক, আর কম থাকুক। (আহসানুল ফাতওয়া-৭/৫১৪-৫১৫) তবে কোনো পশুর শিং যদি মূল থেকে ভেঙে যায়, তাহলে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না। কেননা, হজরত ইয়াজিদ মিসরি রহ. থেকে বর্ণিত- ‘রাসূলুল্লাহ সা: কানকাটা, শিংবিহীন, অন্ধ, দুর্বল এবং পা ভাঙা পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন।’ (সুনানে আবু দাউদ-২৮০৩) পাশাপাশি, ছাগলের জিহ্বা যদি এ পরিমাণ কাটা হয় যার ফলে ঘাস ইত্যাদি খেতে অসুবিধা হয়, তাহলে এ ধরনের ছাগল দিয়ে কোরবানি করা বৈধ হবে না। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী-৫/২৯৮)

৫. পাগল পশু : পাগল পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ। তবে পশু যদি মাঠে না চরে এবং ঘাস ইত্যাদি খাওয়ার প্রতিবন্ধক হয় তাহলে কোরবানি সহিহ হবে না। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী-৫/২৯৮)

৬. গর্ভবতী পশু : গর্ভবতী পশু দিয়ো কোরবানি করা বৈধ। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের সময় আসন্ন হলে, গর্ভবতী পশু কোরবানি করা মাকরুহ। এছাড়া পশু কোরবানি করার পরে যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায়, তাহলে ওই বাচ্চাও কোরবানি করতে হবে এবং গোশত খাওয়া বৈধ হবে। (ইসলামে কোরবানি ও আকিকার বিধান)

লেখক : তরুণ গবেষক ও লেখক


আরো সংবাদ



premium cement