ইসলামের দৃষ্টিতে জীববৈচিত্র্য
- ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
- ১১ জুন ২০২৪, ০০:০০
জীববৈচিত্র্য কী
প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ, প্রাণী ও আণুবীক্ষণিক জীবসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে, সেই বাস্তুতন্ত্রে অগণিত নানা ধরনের জীব প্রজাতির সমাহার বা সমাবেশকে জীববৈচিত্র্য বলে। আর স্থলজ এবং জলজ বাস্তুতন্ত্র এবং এই বাস্তুতন্ত্রের বাস্তু কাঠামোসহ সমস্ত উৎসে প্রজাতির প্রাচুর্যকে জীববৈচিত্র্য বা জীববৈচিত্র্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটি পৃথিবীতে (বা কোনো অঞ্চল) পাওয়া জিন, প্রজাতি, বাস্তুতন্ত্র এবং বাস্তুসংস্থানীয় ঘটনাগুলোর সংগ্রহ।
জীববৈচিত্র্য বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য তৈরি করে এবং পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলে। বায়োটিক প্রজাতির টেকসইতার জন্য এটি প্রয়োজনীয়। জীববৈচিত্র্য শিল্প, ফিশারি, পশুপালন, বনজ, ফার্মাসি এবং কৃষিকাজের মতো ক্ষেত্রগুলোতে পরিষ্কার বাতাস এবং পানি সরবরাহে ব্যবহৃত হয়। উচ্চ জীববৈচিত্র্য অর্থনৈতিক লাভ এবং কৃষি, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশে অবদান রাখে।
পৃথিবীর তিন ভাগই পানি দ্বারা বেষ্টিত। পৃথিবীতে সমুদ্রের মোট আয়তন ৩৬১ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। এটি পৃথিবীর জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ গ্রহে প্রতি বছর গাছপালার মাধ্যমে যে পরিমাণ বিশুদ্ধ অক্সিজেন বায়ুতে মেশে তার ৭০ শতাংশই আসে সামুদ্রিক উদ্ভিদ থেকে। সমুদ্রই মানুষের জন্য জলজ সম্পদের ভাণ্ডার। সমুদ্রের পানি বায়ুতে ভেসে আল্লাহর করুণার মেঘ হয়ে এসে বৃষ্টিরূপে পতিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণা সিক্ত হয়ে নবজীবন লাভ করে। প্রকৃতির প্রতিটি গাছপালা ফুলে-ফলে ভরে ওঠে। সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে ফসলের মাঠ। পানির অপর নাম জীবন। মহান আল্লাহ বলেন-‘আমি প্রতিটি মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া-৩০) আজ পানির উৎস ভাণ্ডার সমুদ্রই নানাভাবে দূষণের শিকার। সব প্রকার বর্জ্য আবর্জনা এবং পারমাণবিক পরীক্ষার শেষ স্থল সাগর-মহাসাগর। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ২০ বিলিয়ন টন বর্জ্য ও বিভিন্ন প্রকার আবর্জনা সাগরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।
এদিকে সামুদ্রিক মাছে রয়েছে বহু উপকারিতা, আছে মান্ুেষর প্রয়োজনীয় উপকরণ। চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মাছের মধ্যে থাকা উপাদানগুলো মানুষের হৃদযন্ত্র কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখার জন্য কাজ করে। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক ড. দারিউস মোজাফফারিয়ান বলেন, কেউ যদি নিয়মিত মাঝারি মাছ খান তাহলে তার হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। সারা বিশ্বে পরিচালিত ৩০টি বড় ধরনের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বা দু’বার মাছ খান তাদের, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি গড়ে ৩৬ শতাংশ কমে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর তিনিই সে সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলঙ্কারাদি, যা তোমরা পরিধান কর। আর তুমি তাতে নৌযান দেখবে, তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পারো এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো।’ (সূরা নাহল, আয়াত-১৪) আর জীবজন্তু মানুষের অবলা প্রতিবেশী। তাদের মুখে ভাষা নেই বলে তারা তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা মানুষকে বলতে পারে না। তবে মানুষের জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে তাদের কষ্টের কথা অনুধাবন করতে হবে। সহিহ বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে, ‘একবার এক পথিক খুব পিপাসার্ত হয়ে একটি কূপের কাছে পৌঁছে নিচে নেমে পানি পান করেন। এরপর উঠে দেখেন, একটি কুকুর তৃষ্ণাতাড়িত হয়ে হাঁপাচ্ছে আর নিজের পা চাটছে। কুকুরটির তৃষ্ণাজ্বালা অনুভব করে লোকটি পুনরায় কূপের ভেতরে নেমে জুতোয় করে কিছু পানি এনে তাকে পান করালেন। আল্লাহ তার এ কাজটি কবুল করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। এ কথা শুনে সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! পশুদের প্রতি দয়া করলেও কি আমাদের পুরস্কার রয়েছে? নবীজী বললেন, হ্যাঁ, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করলেই সওয়াব রয়েছে।’
বুখারি ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘এক মহিলা একটি বিড়ালের কারণে জাহান্নামি হয়েছেন। বিড়ালটিকে তিনি আটকে রেখেছিলেন; কোনো খাবার না-দেয়ার কারণে বিড়ালটি মারা যায়। বিড়ালটিকে মুক্ত করে দিলে হয়তো জমিনের পোকামাকড় খেয়ে সে বেঁচে থাকতে পারত।’ গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী আল্লাহ আমাদের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাদের থেকে সেবা নেয়ার আগে ঠিকমতো দানাপানি খাওয়াতে হবে। আমাদের প্রিয় নবী অবলা প্রাণীর কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। একদিন তিনি নিরিবিলি পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি উটের দিকে তার নজর পড়ে যায়। উটটির পিঠে ভারী বোঝা চাপানো ছিল বলে সহজে পথ চলতে পারছিল না। চালক উটটির গতি বাড়ানোর জন্য বারবার চাবুক মারছিল আর উটটি অসহ্য যন্ত্রণায় কেবল ঘাড় নাড়ছিল। দৃশ্যটি দেখে নবীজী দারুণভাবে ব্যথিত হন। চালককে তিনি উটটির প্রতি সদয় হতে বলেন। নবীজী এভাবেই মানুষকে জীবজন্তুর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন। আর পবিত্র কুরআনে প্রায় ২০০ আয়াতে প্রাণিজগতের প্রসঙ্গ এসেছে। এমনকি পৃথকভাবে বিভিন্ন প্রাণীর নামে ছয়টি সূরার নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- সূরা বাকারা (গাভি), সূরা আনআম (উট, গরু, বকরি), সূরা নাহল (মৌমাছি), সূরা নামল (পিপীলিকা), সূরা আনকাবুত (মাকড়সা), সূরা ফিল (হাতি) ইত্যাদি। এসব নামকরণ থেকে প্রাণিজগতের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি মতে, পশুপাখির প্রতি নম্রতা প্রদর্শন ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত। পশুপাখিকে কষ্ট দেয়া গোনাহের কাজ।
রসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘একবার এক পিপাসার্ত কুকুর কূপের পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। পিপাসায় তার প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচার নারী তা দেখতে পায়। সে নিজের পায়ের মোজা খুলে কুকুরটিকে পানি পান করায়। এ কারণে তার অতীত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ (বুখারি-৩৪৬৭)
পশুপাখি মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত। কুদরতিভাবে আল্লাহ এগুলো মানুষের করায়ত্ত করেছেন। এরা করুণার পাত্র। ইসলামী দৃষ্টিতে, যথাসম্ভব পশুপাখির সাথে দয়াশীল আচরণ করতে হবে। হাদিসে এসেছে, ‘যেকোনো প্রাণীর ওপর দয়া করার মধ্যেও সাওয়াব আছে।’ (বুখারি-৬০০৯)
তাই পশুপাখির সাথে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। পশুপাখিকে অহেতুক নিশানা বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর জমিনে তাদের অবাধ বিচরণের সুযোগ দেয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুই পাখি হত্যা করে, কিয়ামতের দিন পাখিটি আল্লাহর কাছে এই বলে নালিশ করবে যে, হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে।’ (নাসায়ি, ইবনে হিব্বান)
যে প্রাণী প্রতিপালন করা হয় সেগুলোর সুস্থতা ও খাবার-দাবারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ওয়াজিব। মহানবী সা: বলেছেন, ‘এসব বাকশক্তিহীন প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। সুস্থ অবস্থায় এগুলোতে আরোহণ করো, সুস্থ অবস্থায় আহার করো।’ (আবু দাউদ-২৫৪৮)
আল্লাহ পৃথিবীতে অনেক জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি করেছেন। জীববৈচিত্র্য আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনের অন্তর্গত (আয়াতুল্লাহ)। পাহাড়ি ও বনাঞ্চলের হাতি, বাঘ, সিংহ, বানর, হনুমান প্রভৃতি হিংস্র-অহিংস্র প্রাণীই বিশেষ সৌন্দর্য বর্ধন করে। সমুদ্র এবং বিস্তীর্ণ ভূভাগে এরূপ অনেক প্রাণী রয়েছে। সেগুলোকে কষ্ট দেয়া এবং নিধন করা বৈধ নয়।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণার মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় আমাদের সবাইকে জনসচেতনতা তৈরিতে একত্রে কাজ করতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা