১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সালাম দিন শুদ্ধ উচ্চারণে

-

সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ এবং স্পষ্ট ভাষায় সালাম দিন। কখনো বিকৃত বা অশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দেবেন না। কারণ সালাম হচ্ছে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও বন্ধন সৃষ্টিতে একটি কার্যকর সামাজিক রীতি এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্কৃতি। যদি সালামকে বিকৃত করেন তাহলে আপনি ইসলামকে বিকৃত করেন। ইসলামী সমাজের অধিবাসীরা একে অন্যের যে কল্যাণকামী, শুভাকাক্সক্ষী ও হিতাকাক্সক্ষী সেটি এই সালামের মাধ্যমেই অধিকতর প্রকাশ পায়। একে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ হলে প্রথমেই একে অন্যের নিরাপত্তা বা শান্তির দোয়া করবেন এরপর অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করবেন। প্রথমেই বলবেন, ‘আসসালামু আলাইকুম বা সালামুন আলাইকুম’ অর্থাৎ তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। সাথে সাথে অন্যজন বলবেন, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ অর্থাৎ ‘এবং তোমার ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক’। সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক হিংসাবিদ্বেষ দূরীভূত হয়; অহঙ্কার থেকে বেঁচে থাকা যায়।

সালাম প্রদানের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি শান্তির বার্তা পৌঁছায়। একে অপরের নিরাপত্তা, রহমত ও বরকতের জন্য দোয়া করা হয়। এ জন্য সালাম একটি বিশেষ দোয়া ও ইবাদতও বটে। কেননা প্রথমত, অন্যের জন্য শান্তি কামনা করা মানে দোয়া করা। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর কাছে চাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। তাই সালামের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিস্ফুট হয়। সালামের মাধ্যমে একে অন্যের কল্যাণকামিতার বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়। সাক্ষাতের শুরুতেই বলে দেয়া ‘আমি আপনার কল্যাণকামী সহৃদ বন্ধু। হৃদ্যতা ও সুসম্পর্ক সৃষ্টিতে সালাম ইসলামী জীবনব্যবস্থার এক অন্যতম সংস্কৃতি। সর্বোপরি সালাম আদান-প্রদানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

কুরআন ও হাদিসে সালামের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে নবী! ইবরাহিমের সম্মানিত মেনহমানদের কাহিনী কি তোমার কাছে পৌঁছেছে? তারা যখন তার কাছে এলো, বলল- আপনার প্রতি সালাম। সে বলল- আপনাদেরকেও সালাম কিছুসংখ্যক অপরিচিত লোক।’ (সূরা জারিয়াত : ২৪-২৫)
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর যখনই কেউ মর্যাদাসহকারে তোমাকে সালাম করে তখন তাকে তার চেয়ে ভালো পদ্ধতিতে জবাব দাও অথবা কমপক্ষে তেমনিভাবে। আল্লাহ সব জিনিসের হিসাব গ্রহণকারী।’ (সূরা নিসা-৮৬)
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তবে গৃহে প্রবেশ করার সময় তোমরা নিজেদের লোকদের সালাম করো, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়েছে কল্যাণের দোয়া, বড়ই বরকতপূর্ণ ও পবিত্র।’ (সূরা নূর-৬১)

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে ঈমানদাররা! নিজের গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না গৃহবাসীদের সম্মতি লাভ করো এবং তাদেরকে সালাম করো। এটিই তোমাদের জন্য ভালো পদ্ধতি, আশা করা যায় তোমরা এ দিকে নজর রাখবে।’ (সূরা নূর-২৭)
রাসূলুল্লাহ সা:-ও সালামের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা: থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামের কোনো জিনিসটি উত্তম? তিনি বললেন, ‘তুমি খাদ্য খাওয়াবে ও চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেবে।’ (বুখারি-১২, ২৮, ৬২৩৬, মুসলিম-৪২, আহমাদ-৬৭৬৫)

আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈমানদার ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বলে দেবো না, কী করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার সৃষ্টি হবে? তা হলো- তোমরা পরস্পরের মধ্যে বেশি সালাম বিনিময় করবে।’ (মুসলিম-৯৮, তিরমিজি-২৬৮৮, আবু দাউদ-৫১৯৩, ইবনে মাজাহ-৩৬৯২, আহমাদ-৮৮৪১)
কিন্তু ইসলামের এই সুন্দর সম্ভাষণ বা সংস্কৃতিকে আমরা বিকৃত করে ফেলেছি। বিভিন্ন ধরনের বিকৃতির সালাম আমাদের সমাজে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
সালামের কিছু ভুল উচ্চারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১. স্লামালাইকুম : অর্থ উটের নাড়িভুঁড়ি আপনার জন্য।
২. সালামালাইকুম
৩. স্লামালিকুম : আপনাদের ওপর গজব হোক।
৪. সেলামালাইকুম বা আসলা মালিকুম : অর্থ শান্তির পরিবর্তে গজব, অশান্তি ও শাস্তি কামনা।
৫. আস্লা মালিকুম
৬. সেলামালিকুম
৭. আস-সামুকুম অর্থ তোমাদের ওপর অস্বস্তি, ক্লান্তি, অসন্তোষ, বিরক্তি ইত্যাদি।

৮. আসামু আলাইকুম : ইহুদিরা জেনে বুঝে মুসলমানদেরকে আস সামু আলাইকুম বলে সালাম দিত। যার অর্থ তোমাদের মৃত্যু হোক। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ইহুদিদের কেউ তোমাদের সালাম দেয়ার সময় বলে যে, আসামু আলাইকুম (অর্থাৎ তোমাদের মৃত্যু হোক)। জবাবে তোমরা বলবে- ওয়া আলাইকুম (অর্থাৎ তোমাদের ওপরও তাই)।’ (আবু দাউদ-৫২০৬) হাদিসটি সহিহ। ইমাম আবু দাউদ রহ: বলেন, ইমাম মালেক রহ: আবদুল্লাহ ইবনে দিনার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তাতে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘জবাবে তোমরা বলবে- ওয়া আলাইকুম।’ (বুখারি ও মুসলিম)

৯. সেলাম : কলকাতার ‘সংসদ বাংলা অভিধান সালামকে বিকৃত করেছে। তারা সালামের শুদ্ধ বানান লিখেছে ‘সেলাম’। সালামের ব্যাখ্যায় লিখেছে ‘সালাম’ হচ্ছে ‘সেলাম’-এর রূপভেদ। তাদের মতে আস-সালামু-আলাইকুমের শুদ্ধ বানান হচ্ছে, ‘সেলাম আলায়কুম’ যার অর্থ লেখা হয়েছে ‘নমস্কার’।

উপরে উল্লিখিত আল কুরআনের সূরা জারিয়াত, সূরা নিসা ও সূরা নূরে সালাম দেয়া-নেয়ার উত্তম পদ্ধতি এবং বরকত ও দোয়ার কথা বলা হয়েছে। সৃষ্টির প্রথম মহামানব আদম আ:-কে আল্লাহ তায়ালা সালামের দেয়া-নেয়ার পদ্ধতি শিখিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের জীবনে একে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ হলে এই সম্ভাষণ, দোয়া ও সংস্কৃতি চলছে, চলবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে মুসলিম সমাজে সালামের শব্দাবলির এমন বিকৃতি লাভ করেছে যে, সালামের উদ্দেশ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বর্তমান মুসলিম সমাজে সালাম অহঙ্কারের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক নেতা, অফিসের বড় বস, বড় বুজুুর্গ, বড় আলেম, পীর-মাশায়েখকে আগে সালাম দিতে হবে এমন কোনো পদ্ধতি বা সুন্নাহ রাসূলুল্লাহ সা: বলেন যাননি। বরং রাসূলুল্লাহ সা:-এর যুগে সালাম নিয়ে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত, কে কার আগে সালাম দিতে পারে। সালাম দিলে অহঙ্কার কমে, অন্তরের কৃপণতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। সালাম পাওয়ার চেয়ে দেয়ার সওয়াব বেশি। এ জন্য রাসূল সা: ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবাইকে আগে আগে সালাম দিতেন।

লেখক : প্রবন্ধকার

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement