১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মানবজাতিকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য

-

মানবজাতি বিশেষ করে মুমিন মুসলিমগণকে অবশ্যই জানতে হবে আল্লাহ কী উদ্দেশ্যে তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহর সেই উদ্দেশ্য অবশ্যই তাদের সাধন করতে হবে। আমরা মুসলিমগণ জানি, আল্লাহর যা ইচ্ছা তিনি তাই করতে পারেন তৎক্ষনাৎ বা যথাসময়ে। আল্লাহ হলেন সীমাহীন শক্তিধর। তাঁর না শুরু আছে, না আছে শেষ। এমন কোনো গুণ নেই, যা তাঁর নেই এবং সেসব গুণ সীমাহীন। সম্মানিত পাঠকগণ! আসুন, এহেন (আলোচ্য গুণে গুণান্বিত) আল্লাহ তায়ালা যে সম্মানে আমাদেরকে ভূষিত করেছেন এবং যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, আমরা একক ও সম্মিলিতভাবে আমাদের মহান স্রষ্টার সেই উদ্দ্যেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করে তার সন্তুষ্টি প্রাপ্ত হয়ে, আমাদেরকে তার প্রদত্ত শীর্ষস্থানীয় সম্মান রক্ষা করে পরকালের চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করি। মরতে আমাদের হবেই। অস্থায়ী পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহ বা ভ্রান্ত ধারণাগুলো যেন আমাদের পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের সফলতা (যার শুরু আছে শেষ নেই) থেকে উদাসীন করে ফেলতে না পারে। প্রসঙ্গত, আল্লাহর সতর্ক বাণীখানা উল্লেখযোগ্য, অর্থ : (হে নির্বোধ গোলামেরা! সন্দেহাতীত সত্য ভুলে পারলৌকিক জীবনের ওপর) বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ, অথচ পরকালের জীবনই অধিক উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী (যা সন্দেহাতীত মহাসত্য কথা, ফলে তোমরা পরিচালিত হচ্ছ ভ্রান্ত পথে সঠিক পথ হারা হয়ে)। সূরা আল-আ‘লা : ১৬-১৭

আমরা যদি পারলৌকিক জীবন থেকে উদাসীন হয়ে যাই তাহলে আমরা অসহনীয়, অবর্ণনীয় জাহান্নামের শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হয়ে সর্বহারাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব, যা উল্লেখ আছে সূরায়ে ‘আল-আশরে’ অর্থ : ‘মানবজাতি অবশ্যই হবে পরকালে সর্বহারা অর্থাৎ জাহান্নামবাসী তবে ব্যতিক্রম হবে যারা সত্যিকার অর্থে মুমিন মুসলিম হয়ে সৎকাজ করে, পরস্পর পরস্পরকে সত্য অবলম্বন এবং ধৈর্য ধারণের আদেশ, উপদেশ ও পরামর্শ দান করে।’

সম্মানিত পাঠকগণ! আসুন আমরা সঙ্গত কারণে জ্ঞাত হই সঠিকভাবে সীমাহীন শক্তিধর, মহাবিশ্ব ও সব প্রাণীকুলের স্রষ্টার মানবজাতি ও জিনজাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে। যথা :

সৃষ্টির উদ্দেশ্য একাধিক
আল্লাহর বাণী অর্থ : জিন এবং মানবজাতি সৃষ্টি করেছি শুধু সর্বদা আমার (আল্লাহর) দাসত্ব করার জন্য (যা আমাদেরকে সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য, আমাদেরই কল্যাণার্থে উভয় জগতে অর্থাৎ ইহকালে সুখ-শান্তি এবং পরকালে চিরশান্তি ও ভোগ-বিলাসবহুল জীবনযাপন, যা মন চাবে তাই পাবে)। সূরা আয-যারিয়াত : ৫৬।
আল্লাহর বাণী অর্থ : তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে আবির্ভূত করা হয়েছে, তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখ ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো। সূরা আলে-ইমরান : ১১০।

উপরোক্ত আয়াত থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ আমাদেরকে উচ্চপর্যায়ে সম্মানিত করেছেন ‘শ্রেষ্ঠজাতি’ আখ্যায়িত করে, সাথে সাথে স্মরণ করিয়ে দিলেন বর্ণিত সম্মান রক্ষা করতে হলে আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্যগুলো আমাদের অবশ্যই পূরণ করতে হবে অন্যাথায় আমরা বঞ্চিত হব শ্রেষ্ঠজাতি হওয়া থেকে। যথা :
সদাসর্বদা আমরা (মানবজাতি) সদাসর্বদা অবশ্যই যথাসাধ্য আদেশ, উপদেশ ও পরামর্শ দিতে থাকব বিশ্ববাসীকে সৎকাজ বা আল্লাহর আদেশ পালন করতে।

আমরা অবশ্যই বিরত রাখব বিশ্ববাসীকে (যেকোনো মূল্যে) অসৎ বা নিষিদ্ধ কাজ হতে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা পালন বা অনুসরণ করে। সে ক্ষেত্রে ইনশাআল্লাহ স্থাপিত হবে সুখ-শান্তি সারা বিশ্বে।

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করব আল্লাহকে তার সব গুণাবলিসহ, সব বাণী বিশ্বাসকরত, সব আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা পালন করে। আল্লাহকে বিশ্বাস করলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করব ইনশাআল্লাহ ফেরেশতাগণকে আল্লাহপ্রদত্ত কিতাবগুলোকে, নবী-রাসূলগণকে, পরকাল, তাকদির ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে। ফলে আমরা ইনশা আল্লাহ পরিপূর্ণ মুমিন হয়ে যাব।
সম্মানিত পাঠকগণ! আসুন আমরা আল্লাহর গুণাবলি বা সীমাহীন ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞাত হই, যাতে আমরা আল্লাহকে চিনতে ও ভয় করে চলতে পারি।

আল্লাহ সীমাহীন ক্ষমতাধর, যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন তৎক্ষণাৎ বা যথাসময়ে, এ মহাবিশ্ববাসী বা সব প্রাণীকুলকে চোখের পলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেন। অদ্যাবধি সব মৃত মানুষ ও প্রাণীকুলকে চোখের পলকে জীবিত করে দিতে পারেন। সম্রাট বা বাদশাহকে ফকির এবং ফকিরকে বাদশাহ বানিয়ে দিতে পারেন চোখের পলকে। আল্লাহ ছয় দিনে পৃথিবী এবং সপ্তাকাশ সৃষ্টি করলেন, ৬০ গজ লম্বা আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করলেন মাটি থেকে, মা হাওয়া আ:-কে সৃষ্টি করলেন আদম আ:-এর বা-পাঁজরের হাড় থেকে, মরিয়ম আ:-কে সৃষ্টি করলেন পিতা ব্যতীত, ঈসা আ:-কে (কুম বিইযনিল্লাহ বলিয়ে) মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা দান করেছিলেন, ইউনুস আ:-কে মাছের উদরে ঢুকিয়ে নদীর তলদেশে ৪০ দিন জীবিতাবস্থায় রেখে নদীর তীরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে মহাকঠিন রোগাবস্থায় এবং লোকালয় হতে জঙ্গলে বিতাড়িত দাউদ আ:-কে চোখের পলকে সুস্থ করে দিলেন, এমনি করে আল্লাহ কর্তৃক আরো অনেক ধ্বংসলীলার ঘটনা যথা : কাওমে নূহ, কাওমে লুত, কাওমে আদ, কাওমে সামুদ, সৈন্যবাহিনীসহ ফেরাউনের নীলনদে ডুবে মরা ইত্যাদি যে আল্লাহ আমাদের শুনালেন সে আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতা যদি কেউ বিশ্বাস না করে তাকে বলা হবে আকারে মানুষ হলেও সে মানুষ নয় বরং পশুর ন্যায় বা তার চেয়ে নিকৃষ্ট।

প্রমাণ আল্লাহর বাণী অর্থ : ‘আর অবশ্যই আমি (আল্লাহ) সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষকে। তাদের রয়েছে অন্তর, তা দ্বারা তারা বুঝে না, তাদের রয়েছে চোখ, তাদ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের রয়েছে কান, তা দ্বারা তারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তার চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট। তারাই গাফেল বা উদাসীন।’ (সূরা আল-আরাফ : ১৭৯) মহান আল্লাহ তায়ালা কতখানি ক্রোধান্বিত হলে পরে তারই সৃষ্ট মানবজাতি যাদের তিনি শ্রেষ্ঠজাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সেই মানবজাতিকে ধিকৃত বা ভর্ৎসনা করতে পারেন-‘পশুর মতো বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট’ বলে। এ আয়াত থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, যে আল্লাহ সীমাহীন দয়ালু-দয়াবান সে একই আল্লাহ ক্ষেত্র বিশেষে হয়ে যান সীমাহীন ক্রোধান্বিত, ফলে বিশ্ব আক্রান্ত হয় তার ক্রোধপ্রসূত আজাব-গজবে। যার বাস্তব প্রমাণ আমরা সদাসর্বদা দেখতে বা শুনতে পাচ্ছি এবং পেতে থাকব বলে প্রতীয়মান হয় বর্তমান বিশ্বের অবস্থা থেকে।

অবর্ণনীয় ভয়াবহ ও বিশ্ব কাঁপানো কোভিড-১৯ আমরা দেখেছি, বর্তমান বিশ্বের অভূতপূর্ব ভয়াবহ অবস্থা এবং বিশ্ববাসীর অসহনীয় দুর্ভোগ আমরা দেখতেছি। আসুন, এ হতে এবং উপরিউক্ত বর্ণনা হতে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করে আল্লাহর কুরআনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরি এবং আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক জগতের জীবনটা যথাক্রমে শান্তিময় ও চিরশান্তিময় করি, ইনশাআল্লাহ।

আমি পছন্দ করি এককভাবে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা পালন করতে কিন্তু অন্যের জন্য তা চিন্তা করি না, সেক্ষেত্রে আমি আমাকে আল্লাহর সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য আংশিকভাবে পালন করলাম। তা ছাড়া আমার ওপর প্রযোজ্য হবে রাসূল সা:-এর সেই মহামূল্যবান ও সাবধান বাণীটি অর্থ: ‘তোমাদের মধ্যে কেউ (পরিপূর্ণ মুমিন) হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার জন্য যা পছন্দ করে বা ভালোবাসে, তা তার ভাইয়ের বা অন্যের জন্য পছন্দ না করে বা ভালো না বাসে।’ আমি আমার জন্য ভালোবাসি সৎকাজ করতে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত থাকতে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমার ধর্মীয় দায়িত্ব হবে তা ভাই-বোনদের জন্য পছন্দ করা। হাদিসটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় পালনীয়।

হে আল্লাহ! দয়া করে আপনার ঘোষণা মতে ‘দুর্বল’ বিশ্ববাসীকে তৌফিক দিন কুরআনকে আঁকড়ে ধরে পরিপূর্ণ মুমিন-মুসলিম হয়ে তাদের সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য যথাযথভাবে সাধন করে তারা যেন হতে পারে আপনার প্রিয় পাত্র উভয় জগতে। আমিন।

লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট্স অব বাংলাদেশ।


আরো সংবাদ



premium cement