১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ওয়াদা রক্ষা ঈমানের অঙ্গ

-

জীবন চলার পথে মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে ওয়াদা-অঙ্গীকারের আশ্রয় নিতে হয়। ওয়াদা রক্ষা একজন মোমেনের উত্তম বৈশিষ্ট্য। কারণ ঈমান ব্যক্তিকে উৎকৃষ্ট সব গুণ আত্তীকরণে উদ্বুদ্ধ করে আর বদ-চরিত্র ধারণ বাধা দান করে। মোমেন ব্যক্তি হবেন অত্যুৎকৃষ্ট গুণের আধার। তা ছাড়া ওয়াদা রক্ষা ভদ্রতার পরিচয়কও বটে। কেবল দুষ্ট লোকেরাই ওয়াদা ভঙ্গে অভ্যস্ত হন। পক্ষান্তরে মোমেন-মুসলিম ওয়াদা পালনে বদ্ধপরিকর হন।

ওয়াদা রক্ষায় আল-কুরআন
আল্লাহ তায়ালা সেই কথাকে পছন্দ করেন যা অনুযায়ী কাজ হয়। যে কথা অনুযায়ী কাজ হয় না সে কথা এবং সেই কথার বক্তাকে তিনি অপছন্দ করেন। এমন কথা ও ওয়াদা থেকে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বারণ করে বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করো না, তা কেন বলো। তোমরা যা করো না, তা বলা আল্লাহর কাছে মহাঅপরাধ’ (সূরা আস-সফ : ২-৩)। যা করতে পারবে না তার অঙ্গীকার করা মানুষের অনুচিত। সূরা মায়িদায় অঙ্গীকার পূরণের আদেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করো।’ আবার সূরা নাহলে জগতের সব মানুষকে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন- ‘তোমরা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করো।’

অঙ্গীকার পূরণে নবী সা:-এর নির্দেশ
প্রিয়নবী সা: নিজে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ওয়াদা রক্ষায় বদ্ধপরিকর ছিলেন। স্বীয় অনুসারীদেরও ওয়াদা পূরণে জোর তাগিদ দিয়েছেন। হজরত উবাদা ইবনে সামেত রা: বর্ণনা করেন- নবীজী বলেছেন, ‘অঙ্গীকার করলে পূরণ করো। আর কথা বললে সত্য বলো’ (সহিহ ইবনে হিব্বান-২৭১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, একজন ব্যক্তি নবীজীর কাছে কিছু আরজ করলেন। নবীজী বললেন, ‘তোমাকে দেয়ার মতো কোনো কিছু আমার কাছে নেই। লোকটি নবীজীকে বললেন, আপনি আমাকে অঙ্গীকার দেন। উত্তরে নবীজী বললেন, ‘অঙ্গীকার পূরণ করা ওয়াজিব’ (আল-মাকাসেদুল হাসানা-৪৫৪)।

কোন অঙ্গীকার পূরণ করা উচিত?
শয়তান মানুষের পদস্খলনে বদ্ধপরিকর। মানবের পদস্খলন ঘটানোই তার একমাত্র আরাধনা। তাই মানুষের থেকে ভালো-খারাপ উভয় কাজ হয়ে যায়। সৎকাজের অঙ্গীকারের পাশাপাশি অসৎকাজের অঙ্গীকারেও মানুষ সিদ্ধহস্ত। কেউ খারাপ কাজের অঙ্গীকার করলে তা কি পূরণ করা আবশ্যক? এ ব্যাপারে নবীজী বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ভালো কাজের ওয়াদা করে, সে যেন তা পূরণ করে। আর যদি কেউ মন্দ কাজের অঙ্গীকার করে, তাহলে তার ইচ্ছাধিকার রয়েছে।’ হাদিসে যদিও ইচ্ছাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মন্দ কাজের অঙ্গীকার পূরণ না করাই মোমেনের কাজ। পাপ কাজের ওয়াদা পূরণ করাও পাপ।

অঙ্গীকার ঋণ আবার দক্ষিণা
অন্যের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করলে, তা পরিশোধ করা যেমন অত্যাবশ্যকীয় তেমনি কারো সাথে কোনো অঙ্গীকার করলে তা পূরণ করাও জরুরি। কারণ অঙ্গীকার এক প্রকারের ঋণ। নবীজী বলেছেন, ‘মোমেনের অঙ্গীকার ঋণ। আর মোমেনের অঙ্গীকার হাত দ্বারা গ্রহণ করার মতোই’ (আল-ফিরদাউস-৪১১২)। হাদিসে অঙ্গীকারকে যেভাবে ঋণ বলা হয়েছে তেমনি অঙ্গীকারকে দান-দক্ষিণা হিসেবেও গণ্য করা হয়েছে। হাসান বসরী রা: নবীজী থেকে বর্ণনা করেন, একজন মহিলা নবীজীর কোনো জিনিসের আবেদন করলেন। কিন্তু তা না পেয়ে নবীজীকে বললেন, আমাকে অঙ্গীকার দিন। তখন নবীজী বললেন, নিশ্চয়ই অঙ্গীকারও এক প্রকারের দক্ষিণা’ (মাকারেমুল আখলাক-২০০)।

অঙ্গীকার ভঙ্গকারী মোনাফেক
অঙ্গীকার ভঙ্গ ও দ্বিচারিতা অবলম্বন মানবের একটি নিকৃষ্ট স্বভাব। আল্লাহর অপছন্দনীয় বিষয়। তাঁর দরবারে এমন ব্যক্তি মোনাফেক হিসেবে চিহ্নিত যিনি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন। অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে ব্যক্তি মোনাফেকের চিহ্নযুক্ত হয়। নবীজী বলেছেন, ‘মোনাফেকের চিহ্ন তিনটি : মোনাফেক কথা বললে মিথ্যা বলে, আমানতের খেয়ানত করে এবং অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে’ (মুসলিম-৫৯)।

ইবাদতগুজার হলেও সে মোনাফেক
ওয়াদা ভঙ্গ করা বড় অপরাধ। মহাপাপ। এই পাপের কারণে ব্যক্তি মোনাফেকের কাতারে চলে যায়। আর আল্লাহর কাছে মোনাফেকের স্থান কাফেরের থেকেও খারাপ। তাই, অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ব্যক্তি হাজী, গাজি, নামাজি, রোজাদার হলেও মোনাফেক হিসেবেই পরিগণিত হবে। আবু হুরায়রা রা: নবীজী থেকে বর্ণনা করেন- তিনটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে মোনাফেক। যদিও সে নামাজ আদায় করে, রোজা রাখে এবং এই বলে দাবি করে যে, আমি একজন মুসলিম। আমানতের খেয়ানত করা। কথায় মিথ্যা বলা আর অঙ্গীকারের খেলাফ করা’ (মাকারেমুল আখলাক-১৯৮)।

শিশুসন্তানকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা
ইসলামে অঙ্গীকারের স্পর্শকতা এতটাই বেশি যে, শিশুসন্তানকে বাগে আনতে মজা করে পিতা-মাতারা যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা আবশ্যকীয়ভাবে পূরণ করার আদেশ দেয়। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমের ইবনে রাবিয়া রা: বলেন, আমি ছোট্ট থাকাবস্থায় একদিন নবীজী আমাদের বাসায় আসেন। আমি খেলতে যাচ্ছিলাম। তখন আমার আম্মা বলল, আব্দুল্লাহ! আসো, আমি তোমাকে একটি জিনিস দেবো। নবীজী আমার আম্মাকে বললেন, ‘তুমি তাকে কি দেয়ার ইচ্ছা করেছ?’ মা বললেন, আমি তাকে খেজুর দেয়ার ইচ্ছা করেছি। উত্তরে নবীজী বললেন, ‘যদি তুমি এমনটি না করতে তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা লেখা হতো’ (মুসনাদে আহমাদ-৩ : ৪৭৭)।

ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা অঙ্গীকার নয়
সন্তানকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সন্তানের কচি হৃদয়ে পিতা-মাতার প্রতিটি আচরণের প্রভাব রেখাপাত করে। তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না করলে তারা এটিকে স্বাভাবিক মনে করে বড় হবে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করাকে সাধারণ বিষয় হিসেবে মেনে নেবে। ফলে তারাও অঙ্গীকার ভঙ্গে অভ্যস্ত হবে। ইবনে মাসউদ রা: নবীজী থেকে বর্ণনা করেন, ‘কেউ যেন তার সন্তানকে এমন ওয়াদা না দেয় যা তিনি পূরণ করতে পারেন না’ (তাবকাতুল-কুবরা-৪ : ১৫০)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তামাশা বা ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা উচিত নয় এবং তোমাদের কেউ স্বীয় সন্তানকে এমন অঙ্গীকার দিও না যা সে পূরণ করতে পারে না’ (আদাবুল মুফরাদ-৮১)।

ব্যবসায় অঙ্গীকার ভঙ্গ ধ্বংস আনে
ধোঁকা এবং ওয়াদাভঙ্গ ব্যবসার বরকত নষ্ট করে। গ্রাহকের আস্থা বিনষ্ট করে। ব্যবসার অপার সুযোগ অঙ্কুরেই বরবাদ করে। ব্যবসায় ওয়াদা ভঙ্গের একটি কার্যকর মাধ্যম শপথ করা। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী কথায় কথায় শপথ করে, নানান প্রকারের অঙ্গীকার করে পণ্য গুজিয়ে দেন। এমনটি করা অনুচিত। নবীজী বলেছেন, ‘ব্যবসায় অধিক শপথ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, তা বরকত নষ্ট করে’ (মুসলিম)। সাহাবি ওয়াসেলা বলেন, আমরা ব্যবসায়ী ছিলাম। নবীজী আমাদেরকে বলতেন, ‘হে ব্যবসায়িক সম্প্রদায়! তোমরা মিথ্যা অঙ্গীকার থেকে বেঁচে থাকো’ (আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব-২ : ৫৯০)।

অঙ্গীকার রক্ষা করা নবীদের বৈশিষ্ট্য
অঙ্গীকার রক্ষা করা নবীদের বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে আল্লাহ প্রেরিত যত নবী এসেছিলেন, তাদের প্রত্যেকে অঙ্গীকার পূরণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কঠিন পরিস্থিতিতেও তারা অঙ্গীকার রক্ষা থেকে পিছপা হননি। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, আবু সুফিয়ান রা: আমাকে জানিয়েছিলেন, বাদশাহ হেরাক্লিয়াস তাকে বললেন, আমি আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম (মুহাম্মদ) তোমাদেরকে কিসের আদেশ করে? তখন আপনি বলেছেন, তিনি নামাজ, সততা, নিষ্পাপতা এবং অঙ্গীকার পূরণের আদেশ করেন। বাস্তবেই এগুলো নবীদের বৈশিষ্ট্য’ (বুখারি)। হজরত আবুল হামসা রা: বলেন, নবুয়াত প্রাপ্তির আগে আমি নবীজীর কিছু জিনিস বাকিতে ক্রয় করেছিলাম এবং অঙ্গীকার করি যে, অমুক স্থানে আসতেছি। বাসায় গিয়ে বিষয়টি আমি ভুলে যাই এবং তিন দিন পর স্মরণে আসে। আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখি তিনি সেখানেই আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, হে যুবক! তুমি আমাকে কষ্টে রেখেছ। বিগত তিন দিন থেকে আমি এখানে’ (আবু দাউদ-৪৯৯৬)।

অঙ্গীকার পূরণে জান্নাতের নিশ্চয়তা
ওয়াদা রক্ষা করা এতটা মহৎ আমল এবং এর বদৌলতে জান্নাতের নিশ্চয়তাও দেয়া হয়েছে। হজরত উবাদা ইবনে সামেত রা: নবীজী থেকে বর্ণনা করেন, ‘তোমরা আমাকে নিজেদের ব্যাপারে ছয়টি জিনিসের নিশ্চয়তা দেও তাহলে আমি তোমাদেরকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো। কথা বললে সত্য বলবে। অঙ্গীকার করলে পূরণ করবে। আমানত দিলে রক্ষা করবে। লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে। চোখ সংবরণ করবে এবং হাতের হিফাজত করবে’ (গায়াতুল-মাকসাদ-২০৫০)।

লেখক : খতিব, বায়তুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর


আরো সংবাদ



premium cement