১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গুনাহের ক্ষতি

-

গুনাহ মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গুনাহের প্রতিক্রিয়া অন্তরে এমনভাবে বিস্তার লাভ করে, যেভাবে বিষের ক্রিয়া মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিষের শক্তি যত বেশি হয়, এর প্রতিক্রিয়াও তত মারাত্মক হয়। বস্তুত গুনাহের বহুবিধ ক্ষতি রয়েছে। নিম্নে এর কিছু ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
রিজিক থেকে বঞ্চিত হওয়া : শুধু খাদ্য বা জীবিকার নাম রিজিক নয়। সম্মান-মর্যাদা, ভালোবাসা, ইলম, ধন-সম্পদ সবই রিজিকের অন্তর্ভুক্ত। তবে মুখ্য হচ্ছে খাবার। রিজিক আল্লাহপ্রদত্ত অনেক বড় নেয়ামত। কিন্তু মানুষ তার গুনাহের কারণে রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয় মানুষ স্বীয় গুনাহের কারণে রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০২২)
গুনাহ মানুষের জীবন ও রিজিকের বরকত কমিয়ে দেয়। এজন্যই যারা মহান আল্লাহর নাফরমানি করে আপনি তাদের জীবনে, দ্বীন ও দুনিয়ায় সামান্য পরিমাণ বরকতও দেখতে পাবেন না। আর জমিন থেকে যতটুকু বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে তা মানুষের গুনাহের কারণেই উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দরজা খুলে দিতাম।’ (সূরা আরাফ : ৯৬) অন্য সূরায় আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের (নেয়ামত) বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয়ই আমার শাস্তি বড় কঠিন।’ (সূরা ইবরাহিম : ৭)
ইলম থেকে বঞ্চিত হওয়া : ‘ইলম’ আরবি শব্দ। এ শব্দটি দ্বারা জ্ঞান, অনুধাবন ও উপলব্ধি করাকে বোঝানো হয়। ইসলামী পরিভাষায় ইলম শব্দটি দ্বারা প্রায়শই শুধু ‘ইসলামী জ্ঞান’কে বোঝানো হয়ে থাকে।
গুনাহগার ইলম থেকে বঞ্চিত হয়। কেননা, ইলম হলো আল্লাহপ্রদত্ত এক নূর, যা মানুষের অন্তরে প্রতিভাত হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার জন্য এক আলোর ব্যবস্থা করেছি, যা নিয়ে সে মানুষের মাঝে চলে।’ (সূরা আনআম : ১২২)
আর গুনাহ এই নূর বা আলোকে নিভিয়ে দেয়। এজন্য গুনাহের কারণে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়। অনেক কিছু শিখেও সে তা ভুলে যায়। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে কেউ জ্ঞানপ্রাপ্ত হলে তা স্থায়ী হবে এমনটা নিশ্চিত নয়; বরং জ্ঞানী ব্যক্তিও গুনাহ করতে থাকলে আল্লাহ তার জ্ঞানকে ছিনিয়ে নিতে পারেন। আবদুুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, ‘অবশ্যই আমি মনে করি, মানুষ তার শিক্ষা করা ইলম ভুলে যায় তার কৃত গুনাহের কারণে।’ (জামিউ বয়ানিল ইলম : ১/১৯৬)।
অন্তরে কালো দাগ পড়া : মানুষের অন্তর পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। মানুষ যখন কোনো সৎকাজ করে, তখন তার অন্তরে নূর সৃষ্টি হয় এবং শরীরে শক্তি সঞ্চারিত হয়। আর যখন অতি মাত্রায় গুনাহ করতে থাকে, তখন তার অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। ফলে তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে তার অন্তরে ভালো কিছুর প্রভাব পড়ে না। তখন ভালো কথা তার ভালো লাগে না, চাইলেই ভালো কাজে মন বসানো যায় না। তখন সে গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো মুমিন গুনাহ করে, তখন তার অন্তরের মধ্যে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। পরে যদি সে গুনাহ ত্যাগ করে এবং পবিত্রচিত্তে তাওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে সেই কালো দাগ ধৌত হয়ে তার অন্তর পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যদি সে তাওবা না করে আবারো গুনাহ করে, তাহলে অন্তরের কালো দাগটি বিস্তার লাভ করতে থাকে। অবশেষে তার পুরো অন্তর একেবারে কালো হয়ে যায়।’ (তিরমিজি : ৩৩৩৪)
লজ্জা-শরম কমে যাওয়া : লজ্জা মানবচরিত্রের অন্যতম মহৎ গুণ। যা নারী-পুরুষ সবার জন্য অপরিহার্য। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের স্থান জান্নাত। পক্ষান্তরে নির্লজ্জতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ। দুশ্চরিত্রের স্থান জাহান্নাম।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১০৫১৯; তিরমিজি : ২০০৯; মিশকাত : ৫০৭৭)
গুনাহের কাজ করলে ধীরে ধীরে লজ্জা-শরম কমে যেতে থাকে। যার লজ্জা নেই, সে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘লজ্জা কেবল কল্যাণ ও মঙ্গলই বয়ে আনে।’ (বুখারি : ১০২৭৫) এই লজ্জাই মানুষকে অন্যায় ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখে। কিন্তু লজ্জাহীন মানুষ নির্বিঘেœ সব মন্দ কাজ করতে পারে। কোনো কিছুই তাকে মন্দ কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। কোনো কাজ করতে তার বিবেক বাধা দেয় না। এগুলো সবই তার কৃত গুনাহের কুপ্রভাবে হয়।
একটি গুনাহ আরেকটি গুনাহের জন্ম দেয় : একটি গুনাহ আরেকটি গুনাহের জন্য বীজস্বরূপ। একটি গুনাহ থেকে আরেকটি গুনাহ জন্ম নেয়। এভাবে অনেক গুনাহ সঙ্ঘটিত হয়। মূলত মানুষের অন্তর থেকে যখন খারাপ কাজকে খারাপ মনে করার অনুভূতি দূর হয়ে যায়, তখন আস্তে আস্তে গুনাহ করাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ফলে এটিকে আর খারাপ কিছু মনে হয় না। এ কারণে পরবর্তীতে গুনাহ পরিত্যাগ করা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখতে হবে। আর গুনাহ সঙ্ঘটিত হয়ে গেলে কালক্ষেপণ না করে তাওবা করে নিতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন সব প্রকার গুনাহ বর্জন করো (সূরা আনআম : ১২০)
ইবাদাতের প্রতি মনোযোগ কমে যাওয়া : বান্দা যখন প্রবৃত্তির লাগামহীন অনুসরণ করে তখন গুনাহের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর ফলে ধীরে ধীরে ইবাদাতের প্রতি তার মনোযোগ কমতে থাকে এবং ঈমান দুর্বল হতে থাকে। ফলে দেখা যায়, আল্লাহর আনুগত্য না করলেও তার মনে দুঃখ বা আফসোস অনুভূত হয় না; বরং তখন ইবাদাত করা অনেক কঠিন মনে হয়। সে বাহ্যিক ইবাদাত বন্দেগি করলেও তাতে কোনো ধরনের স্বাদ অনুভব করে না। অন্যায় ও অশ্লীলতা চর্চায় তার অন্তর সুখ লাভ করে এবং সেটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। এগুলো সবই তার কৃত গুনাহের কুপ্রভাবে হয়।
পৃথিবীতে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়া : গুনাহের কারণে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য ভয়াবহ বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপদাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, ভূমিধস, অগ্নিকাণ্ড, বিভিন্ন মহামারী ইত্যাদি নানামুখী প্রাকৃতিক বিপর্যয় পাঠান। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে আল্লাহ তাদের কোনো কোনো কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (আল্লাহর পথে) ফিরে আসে।’ (সূরা রূম : ৪১)।
হজরত আলী রা: ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক বিপদাপদ কোনো না কোনো গুনাহের কারণে পতিত হয়। আর কোনো বিপদাপদকে উঠিয়ে নেয়া হয় না তাওবা করা ব্যতীত।’
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সূরা শুরা : ৩০)
লেখক : সম্পাদক, মাসিক সারস, পূর্ব রূপসা, খুলনা


আরো সংবাদ



premium cement