১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গঠনমূলক কল্যাণ রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ সা:

-


আরব জাতি যখন চরম জাহেলিয়াত ও ঘোরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে পৃথিবীতে হেদায়েতের আলোকবর্তিকা নিয়ে ৫৭০ সালের ১২ রবিউল আউয়াল মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মা আমিনার গর্ভে রাসূল সা:-এর শুভাগমন ঘটে। তাঁর উপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনের আলোকে তিনি জাহেলি যুগের অন্যায়-অবিচার ও অজ্ঞানতার অবসান ঘটান। তিনি এমন একসময় আগমন করেন যখন আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত, অরাজকতা দূরীভূত করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ভিত্তিতে একটি কল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। পবিত্র কুরআনে রাসূল সা:-কে মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সংস্কারক আখ্যায়িত করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি তো তোমাকে (রাসূল সা:) সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সূরা সাবা-২৮) আলোচ্য প্রবন্ধে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে রাসূলে কারিম মুহাম্মদ সা:-এর অবদান সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
কল্যাণ রাষ্ট্র : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা হজের ৪১ নম্বর আয়াতে বলেছেন-‘তারা এমন যাদের আমি জমিনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে।’

এখানে উল্লিখিত চারটি কাজে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে।
প্রথমত, সবচেয়ে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে- ‘সালাত প্রতিষ্ঠার’ মধ্য দিয়ে নাগরিকদের, জনগণের চরিত্র গঠন করতে হবে। নৈতিকতা তৈরি করার মূল মাধ্যম হচ্ছে, প্রতিদিন পাঁচবার আল্লাহ তায়ালার কাছে হাজির হয়ে সে যে আল্লাহর গোলাম, আল্লাহর দাস এবং তার যে একজন মালিক আছে, তাঁর আদেশ-নিষেধ, বিধিবিধান প্রতিদিন পাঁচবার স্মরণ করে নিজের চরিত্রকে আল্লাহমুখী করবে। এটি হচ্ছে প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত, ‘জাকাতভিত্তিক’ একটি অর্থনীতি, অর্থব্যবস্থা চালু করে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন রাষ্ট্রের পূরণ করতে হবে। তৃতীয়ত, ‘সমস্ত ভালো’ কাজগুলো চালু করে দেবে, এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমর (হুকুম) রাষ্ট্র ছাড়া মানুষের উপরে কোনো আদেশ অসাধ্য। একজন ব্যক্তি দাওয়াত দিতে পারে, অনুরোধ করতে পারে, এটি ‘আমর বিল মারুফ’ হয় না। এটি অনুরোধ বিল মারুফ হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ বলছেন- ‘আমর (আদেশ), আর আদেশ দেয়ার একটি মাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্র। তাই আল্লাহ বলছেন- ‘সব ভালো কাজ, সৎকাজগুলো রাষ্ট্র চালু করবে এবং চতুর্থত, সব অকল্যাণকর কাজ, ক্ষতিকর কাজ, খারাপ কাজগুলো বন্ধ করে দিয়ে সমাজকে পবিত্র করবে। এই চারটি কাজ হলো- ১. চরিত্র গঠন করা; ২. অর্থনীতির ব্যাপারে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন; ভাত, কাপড়, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ তার সব হক ফিরিয়ে দেয়া; ৩. সমাজে সমস্ত ভালো কাজ চালু করা; ৪. সমস্ত অকল্যাণকর কাজ বন্ধ করে দেয়া।

সূরা হজে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিবকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র কায়েমের চারটি কাজ দিয়েছেন, দুনিয়ার মানুষ তো ‘ওয়েলফেয়ার স্টেইটে’র সংজ্ঞা দিয়েছে, আল্লাহ তায়ালা যে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেইট’-এর সংজ্ঞা দিচ্ছেন তার হচ্ছে চারটি বৈশিষ্ট্য। উপরোক্ত আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: কিভাবে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সূচনা এবং পরিচালনা করলেন তা বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।
ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর : আকাবার দ্বিতীয় বায়াত ছিল কল্যাণরাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণের মূল বিষয়বস্তু। বায়য়াতুল হারব বা সামরিক অঙ্গীকারের বক্তব্য ছিল এমন- আমরা আমাদের সব সহায় সম্পদ ধ্বংস এবং আমাদের গোত্রপতিদের হত্যার বিনিময়ে হলেও আপনার সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখব বলে অঙ্গীকার করছি।’ এ বায়য়াতের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য ভবিষ্যতের নাগরিকরা স্বেচ্ছায় ও সানন্দে মুহাম্মদ সা:-এর রাষ্ট্রনায়কত্বকে গ্রহণ করে নিলো এবং আনুগত্যও প্রতিষ্ঠিত হলো। এ অঙ্গীকারের পর ১২ জন আঞ্চলিক দায়িত্বশীল (নকিব) নিয়োগ করলেন। ৯ জন খাজরাজ এবং তিনজন আওস থেকে নিয়োগ করা হলো।
ভিত্তিপ্রস্তরের প্রথম কাজ ছিল মসজিদ নির্মাণ করা। এ মসজিদ শুধু নামাজের জন্যই ছিল না; বরং তাকে ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতার কেন্দ্র এবং উৎস হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। একাধারে রাষ্ট্রের দরবার, পরামর্শকক্ষ, সরকারি অতিথি ভবন, গণপাঠাগার ও জাতীয় সম্মেলন ভবন হিসেবে নির্মিত হয়। এই কাজের সমন্বিত আওয়াজ ছিল- ‘আখিরাতের সুখই প্রকৃত সুখ। তা না হলে জীবন নিরর্থক। হে আল্লাহ আপনি আনসার ও মোহাজেরদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, আবু মুহাম্মদ আবদুল মালিক ইবনে হিশাম মুসাফিরি রহ., আকরাম ফারুক (অনুবাদক), দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা-১৩৩)

এ লিখিত সাংবিধানিক চুক্তির অর্জন হচ্ছে, মদিনার নবগঠিত সমাজে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইন মূল ভিত্তির গুরুত্ব অর্জন করে। রাজনৈতিক, আইনগত ও বিচারবিভাগীয় চূড়ান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মুহাম্মদ সা:-এর হস্তগত হয়। বিধিসম্মতভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত ও ইসলামী জীবন বিধান বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
তাওহিদ ভিত্তিক রাষ্ট্রের সূচনা : আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: ধর্মীয় ক্ষেত্রে অনাচার, পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করে সমগ্র সমাজ-সংগঠনকে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী তাওহিদের আদর্শে রাষ্ট্রকে নবরূপে রূপায়িত করেন। সব ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের উৎস একমাত্র আল্লাহকেই মেনে নিয়ে রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেন। তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আল আমিন, উসুয়াতুল হাসানা এবং সায়িদুল মুরসালিন। তাঁকে শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি আপনাকে পুরো বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
আল্লাহর একাত্মবাদের দৃষ্টান্ত দিতে হলে সে যুগের রাসূলের সাহাবিদের জীবন যাপন দেখতে হবে। মোহাজেরদের হিজরতের কঠিন পরিস্থিতিতেও তাওহিদ প্রতিষ্ঠায় তারা ছিলেন অটল। তাদের জীবনে চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। অনেকেই আল্লাহর সব কর্মকাণ্ড মেনে নিতে না পেরে কষ্টে ইসলাম ত্যাগ করে। ‘মদিনা স্বর্ণকারের চুল্লির মতো, যা খাদকে বের করে দেয় এবং খাঁটি সোনাকে আলাদা করে।’ (বুখারি)

তাদের খাদ্যসঙ্কট এতই তীব্র ছিল যার উদ্দেশ্যে হজরত আবু তালহার বর্ণনায় বলেন- আমরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সাহায্যের জন্য রাসূল সা:-এর কাছে গেলাম। যখন আমাদের পেট খুলে উপোস থাকার কষ্ট লাঘবের জন্য বাঁধা পাথর দেখালাম তখন ওই শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিও দেখালেন সেখানে একটি নয়, দু’টি পাথর বাঁধা আছে।’ (ইমাম আবু ঈসা আত তিরমিজি, শামায়েলে তিরমিজি, আইশুন্নাবি সংক্রান্ত অধ্যায়)
বিশ্ববাসীর কল্যাণে সাহাবীরা নিজেদের জীবনে এত কষ্ট সহ্য করেছেন তবুও ইসলামের সৈনিকদের তাকওয়ায় বিন্দু পরিমাণও দুর্বলতা আসেনি।
সাম্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ রাষ্ট্র গঠন : পুরো আরব দেশ জঘন্য পাপ ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে রাসূল সা: সাম্য অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্বমানবতার ভিত্তিতে যে এক উন্নত ও আদর্শ রাষ্ট্রের প্রবর্তন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। তাঁর প্রবর্তিত রাষ্ট্রে গোত্রের বা রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের বন্ধনই ছিল মজবুত ঐক্যের প্রতীক। তিনি অন্ধ আভিজাত্যের গৌরব ও বংশ-মর্যাদায় গর্বের মূলে নির্মমভাবে কুঠারাঘাত হানেন এবং সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্র প্রস্তুত করেন। এই একটি মাত্র আঘাতেই আরবের একমাত্র বন্ধন গোত্রপ্রীতি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং ঈমান এই বন্ধনের স্থান দখল করল। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘মুসলমান কর্তৃক নিরাপত্তা দানের অধিকার সবার ক্ষেত্রে সমান।’ (বুখারি, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বুখারি রহ., হাদিস নং-১৮৭০)
রাষ্ট্রীয় ধনী-দরিদ্র, কালো-সাদার বৈষম্য রইল না। মানুষে মানুষে সব প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূরীভূত করে মানবতার অত্যুজ্জ্বল আদর্শে নাগরিকদের বন্ধন সুদৃঢ় করেন। আরবের ইতিহাসে রক্তের পরিবর্তে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত। রাসূল সা: ঘোষণা করলেন, ‘যে ব্যক্তি গোত্রপ্রীতির দিকে মানুষকে আহ্বান জানায়, সে আমার উম্মত নয়।’ (আবু দাউদ) সুফফাবাসী সাহাবিদের অভিভাবক ছিল ইসলামী রাষ্ট্র। রাসূল সা: স্বয়ং তাদের প্রয়োজনে সক্রিয় থাকতেন।
(এরপর আগামীকাল)

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement