১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আমার নামাজ আমার অনুভূতি

-

কোনো কাজ যত সামনের দিকে যায়, তত সে গভীরতা পায়। যত সামনের দিকে যায় তত শেষের দিকে আগায়। এই আগানোর মধ্যে চিন্তার স্থিরতা, নিবিড়তা, ধ্যান সব কিছুই বাড়তে থাকে। আমি নামাজের প্রথম রাকাত শেষ করেছি। আবারো আমি মহান রবের শ্রেষ্ঠত্ব বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে দাঁড়াচ্ছি। আমার নামাজের শুরু থেকে এখন কি মধুরতা বৃদ্ধি পেয়েছে? না কি কখন নামাজ শেষ হবে, কত কাজ ফেলে নামাজে এসেছি এমন অস্থিরতা বাড়ছে। জীবন্ত নামাজ মানে জীবন্ত ঈমান। ঈমানে যার গভীরতা বেশি, তার নামাজেই মধুরতা বেশি। সে যখন নামাজে দাঁড়ায় পৃথিবীর কোনো ধ্যান আর থাকে না। সে মাওলার ধ্যানে বিভোর হয়ে যায়। কিন্তু আমার নামাজ তাদের মতো নয়। বছরের পর বছর নামাজ পড়ে যাচ্ছি। জীবনে হাজার হাজার রাকাত নামাজ পড়েছি, লাখ লাখ সিজদা করেছি। কই আমার পরিবর্তন কই?

আল্লাহর প্রিয়রা ঈমান আমলে খুব যতœবান। আমি প্রথম রাকাতে সব কাজ শেষ করেছি। দ্বিতীয় রাকাতে দণ্ডায়মান হয়ে আবার মাওলার সামনে মানব জীবনের সর্ব শ্রেষ্ঠ দোয়া পেশ করব। আমার ভাব, আমার চাহনি, আমার পেরেশানি কিছুতেই পরিবর্তন নেই। প্রতি রাকাতে প্রথমেই আমাকে এই সূরা পাঠ করতে হয়। তার গুরুত্ব, তার প্রয়োজনীয়তা কোনোটির চিন্তাই আমার দেমাগে নেই। মুখস্ত আছে পড়ছি। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

যার মূল্য যত বেশি তার যতœই বেশি নেয়া হয়। তার যথাযথ হিফাজত হয়েছে কি না বারবার ফিরে তাকানো হয়। সূরা ফাতিহায় আমার জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া। প্রতি নামাজের প্রতি রাকাতে তাকে বারবার পড়া হয়। তাকে ছেড়ে দিলে নামাজ আদায় হয় না। কী তার ওজন, কী তার মাহাত্ম! প্রথম রাকাতে পড়লাম। আবার দ্বিতীয় রাকাতে পড়ছি, বারবার পড়তেই থাকব। তার ওজন তার মর্যাদা জানা না থাকলে আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর জাগ্রত হবে না। কোনো পরিবর্তন আমার মধ্যে আসবে না। সালাতে মনোযোগী, সালাতে খুশুখুজুওয়ালা ব্যক্তিই কেবল সফলকাম। আমার প্রয়োজন আমি যত উপলব্ধি করতে পারব। আমার দরকার যত আমি বুঝতে পারব। তার প্রতি আমার মনোযোগ আমার চেষ্টা সাধনা তত বেশি নিয়োজিত করব। সূরা ফাতিহা-ই যে আমার জীবনের চাওয়া-পাওয়া এই উপলব্ধি আমার মধ্যে যত বেশি মজবুত হবে সূরা ফাতিহার প্রতি টান, ভালোবাসা তত বেশি থাকবে। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা আমার উপলব্ধিতে না থাকার কারণে তোতা পাখির মতো শুধু আওড়াতে থাকি। সে আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর সৃষ্টি করতে পারে না।

আমি প্রতিদিন আমার দায় নিয়ে নামাজে দাঁড়াই। আমার মনের বদ্ধমূল ধারণা যে, আমি শুধু এভাবে হাজিরা দিতে থাকলেই আমার দায়িত্ব শেষ। দায়মুক্তি আর ভালোবাসা কখনো এক জিনিস হতে পারে না। এখানে রবের প্রতি মহব্বতের টান অনুপস্থিত।

আমি সূরা ফাতিহার সাথে আবার অন্য সূরা পড়ব, রুকু করব, সিজদা করব সবই আগের রাকাতের মতো করতে থাকব। একজন আল্লাহওয়ালা যখন নামাজে আগাতে থাকেন মাওলার প্রতি তার নিবিড়তা বাড়তে থাকে অন্যদিকে আমার তাড়াহুড়ো বাড়তে থাকে। এই তাড়াহুড়ো মাওলার সাথে আমার ভালোবাসাহীনতা নির্দেশ করে। আমি দায়সারা গুছের নামাজ আদায় করি।

নামাজের প্রত্যেকটি কাজের মূল্যায়ন যদি আমার যথাযথ থাকত এই নামাজের মাধ্যমে আমি আল্লাহওয়ালা হয়ে যেতে পারতাম। আমি আমার নামাজ নিয়ে সন্তুষ্টির ঢেঁকুর তুলছি। প্রিয় রাসূল সা:-এর নামাজ, প্রিয় সাহাবিদের নামাজ, আল্লাহওয়ালাদের নামাজের প্রতি আমাদের কোনো খেয়াল নেই। তাদের নামাজ কেমন ছিল, তা জানার চেষ্টাও করছি না। তাদের নামাজের মতো আমার নামাজকে সাজাতে চাচ্ছি না। এতে করে এমনিতেই আমার নামাজ আল্লাহর খুব প্রিয় হয়ে যাবে। কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবে না। এমনটি কি হতে পারে!

নামাজ দ্বীনের খুঁটি, হৃদয়ের প্রশান্তি, কষ্টে দুশ্চিন্তায় সুশীতল ছায়া, দুখের উপশম, পেরেশানিতে শান্তির পরশ, মহান রবের সাথে বান্দার ত্রুটিহীন সংযোগ। এমন ইবাদতে আমার মন উজাড় করে দেয়ার কথা। কই আমার মধ্যে তো তেমন কিছু নেই। এক রাকাতের পর এক রাকাত শেষ করছি। কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব আমার। সময় বয়ে যাবে, নামাজও এক এক রাকাত করে শেষ হবে। আমার লাভ কী হবে, এই চিন্তাটা কি আমি শুরু করতে পারি না।

হ্যাঁ আমি পারি, কিন্তু আমার নফসকে আমি এত বেশি হৃষ্টপুষ্ট করেছি। সে আর আমার কথা শুনতে চায় না; বরং সে-ই আমাকে তার কথামতো চলতে বাধ্য করছে। তাকে আমি আমার বিবেকের দাস বানাতে পারিনি; বরং আমি নিজেই তার মুরিদ হয়ে বসে আছি। তাই আসুন, নামাজকে প্রাণবন্ত জীবন্ত করতে চিন্তা ফিকির শ্রম দেই।


আরো সংবাদ



premium cement