১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বহু-বিয়ে ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

-


বহু-বিয়ের প্রথাটি ইসলামপূর্ব যুগেও দুনিয়ার প্রায় সব ধর্মমতেই বৈধ বলে বিবেচিত হতো। আরব, দক্ষিণ এশিয়া, ইরান, মিসর, ব্যাবিলন প্রভৃতি সব দেশেই এই প্রথার প্রচলন ছিল। বহু-বিয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বর্তমান যুগেও স্বীকৃত।
বর্তমানকালে ইউরোপের একশ্রেণীর চিন্তাবিদ বহু-বিয়ে রহিত করার জন্য তাদের অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করে আসছেন বটে, কিন্তু তাতে কোনো সুফল হয়নি; বরং তাতে সমস্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফল রক্ষিতার রূপে প্রকাশ পেয়েছে। অবশেষে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ব্যবস্থারই বিজয় হয়েছে। তাই আজকে ইউরোপের দূরদর্শী চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বহু-বিয়ে পুনঃপ্রচলন করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছেন।
ইসলামপূর্ব যুগে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বহু-বিয়ে প্রথা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন ধর্ম এবং দেশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এর প্রতি কোনো প্রকার বাধা-নিষেধও ছিল না। ইহুদি, খ্রিষ্টান, আর্য, হিন্দু ও পারসিকদের মধ্যে বহু-বিয়ে প্রচলিত ছিল। ইসলামের প্রাথমিক যুগেও কোনো সংখ্যা নির্ধারণ ছাড়াই এই ব্যবস্থা চালু ছিল। তবে তৎকালে সীমা-সংখ্যাহীন বহু-বিয়ের জন্য অনেকের লোভ-লালসার অন্ত ছিল না। অন্যদিকে এ থেকে উদ্ভূত দায়িত্বের ব্যাপারেও তারা সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারত না; বরং এসব স্ত্রীকে তারা রাখত দাসী-বাঁদীর মতো এবং তাদের সাথে যথেচ্ছা ব্যবহার করত। তাদের প্রতি কোনো প্রকার ইনসাফ করা হতো না। চরম বৈষম্য বিরাজ করত পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
অনেক সময়, পছন্দসই দু’-একজনের প্রতি লক্ষ রেখে অবশিষ্টদের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করা হতো।

ইসলামের বিধান : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনুল কারিমে মানবজাতির উদ্দেশে ইরশাদ করেন- ‘আর যদি তোমরা ভয় করো যে, এতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্য থেকে যাদের ভালো লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা করো যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একটিই; অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৩)
আল-কুরআন এই সামাজিক অনাচার ও জুলুমের প্রতিরোধ করেছে। বহু-বিয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধও জারি করেছে। ইসলাম একই সময় চারের অধিক স্ত্রী রাখাকে হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েমের জন্য বিশেষ তাগিদ দিয়েছে এবং ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম করা হলে তার জন্য শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে।

আলোচ্য আয়াতে একাধিক অর্থাৎ, চারজন স্ত্রী গ্রহণ করার সুযোগ অবশ্য দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে এই চার পর্যন্ত কথাটি আরোপ করে তার ঊর্ধ্ব সংখ্যক কোনো স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে না; বরং তা হবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তাও ব্যক্ত করে দেয়া হয়েছে।
মহানবী সা:-এর বহু-বিয়ের মধ্যে সুপ্ত ছিল বহু প্রজ্ঞা ও আল্লাহর নির্দেশ : মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন সত্যপথের দিশারী, গাঢ় অমানিশা বিদূরকারী। তার চরিত্রে ছিল না কদর্য, ছিল না কোনো পঙ্কিলতা। তার মর্যাদা সুউচ্চ সপ্ত আকাশের চেয়েও বহু ঊর্ধ্বে। বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি নেই তার আদর্শ জীবনীতে। তিনি ছিলেন এক মহামানব, যার তুলনা কখনো মিলবে না নীল আকাশের নিচে! তার আলোকিত জীবন বিশ্ব-মানবতার আদর্শ, ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে মুক্তি ও উত্তরণের পথ।
মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনীতে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহজাব, আয়াত-২১)
রাসূলুল্লাহ সা:-এর বহু-বিয়ের মধ্যে সুপ্ত ছিল বহু প্রজ্ঞা। মহামহিম আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেন। আবু সাইদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিয়ে করিনি এবং আমার মেয়েদের অন্য কারো কাছে বিয়ে দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাইল আ: বিয়ের আদেশ-সম্বলিত বার্তা না এনেছেন।’ (উয়ুনুল আছার-২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব-৩/২১৯)
নবী-রাসূলরা আল্লাহর কিতাব ও মুজিজাপ্রাপ্ত হন। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তারা কোনো কাজ করেন না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর তিনি (রাসূল) প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না; বরং যা কিছু বলেন তা সবই (আল্লাহর কাছ থেকে) প্রত্যাদেশ হয়।’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)

মহানবী সা:-এর বহু-বিয়ের অনেক কারণ রয়েছে। তা হলো- দ্বীন প্রচার-প্রসার। মহানবী সা: ছিলেন বিশ্বনবী ও রাষ্ট্রনায়ক। চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ইসলাম ধর্মকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি আদিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। ফলে মহানবী সা:-এর পক্ষে দ্বীন প্রচার করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁর বহু-বিয়ে ধর্মীয় বিধান প্রচার ও প্রসারে বিরাট ভূমিকা রাখে। বহু-বিয়ের ফলে বিভিন্ন গোত্রের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যা রাজনৈতিক জটিলতা দূর করে দ্বীন প্রচারের সুযোগ করে দেয়।
যদি সমতা রক্ষা করা সম্ভব না হয়, চারটি পর্যন্ত বিয়ের অনুমতি দেয়ার পর বলা হয়েছে : অর্থাৎ যদি আশঙ্কা করো যে, স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না, তবে এক স্ত্রীতেই তৃপ্ত থাকো।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায়বিচার করতে না পারো, তাহলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর করো। এতে বোঝা যাচ্ছে, একাধিক বিয়ে ঠিক তখনই বৈধ হতে পারে, যখন শরিয়ত মোতাবেক সবার সাথে সমান আচরণ করা হবে; তাদের সবার অধিকার সমভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে অপারগ হলে এক স্ত্রীর ওপরই নির্ভর করতে হবে এবং এটিই ইসলামের নির্দেশ।

রাসূলুল্লাহ সা: একাধিক স্ত্রীর বেলায় সবার সাথে পরিপূর্ণ সমতার ব্যাপারে বিশেষভাবে তাগিদ করেছেন এবং যারা এর খেলাফ (ব্যতিক্রম) করবে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির খবর দিয়েছেন। নিজের ব্যবহারিক জীবনেও তিনি এ ব্যাপারে সর্বোত্তম আদর্শ স্থাপন করে দেখিয়েছেন। এমনকি তিনি এমন বিষয়েও সমতাপূর্ণ ব্যবহারের আদর্শ স্থাপন করেছেন, যে ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন ছিল না।
এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি এদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে।’ (মিশকাত শরিফ, পৃষ্ঠা-২৭৮)
লেখক : ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

 


আরো সংবাদ



premium cement
স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক, প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি: বদরুদ্দীন উমর রাজশাহীতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ২ কর্মী গ্রেফতার জামায়াত নেতা ড. তাহের সম্পর্কে সাংবাদিক ইলিয়াসের মন্তব্যের প্রতিবাদ গাজীপুরে নতুন ট্রেন ও অসমাপ্ত বিআরটি লেনে বিআরটি বাস সার্ভিসের উদ্বোধন বেনজীর ও মতিউরের বিরুদ্ধে দুদকের ৬ মামলা ছিনতাই রোধে রাজধানীতে শেষ রাতে পুলিশি টহল বাড়ানোর নির্দেশ পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্টের সাথে বিএনপি নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ জামায়াতের একজন নেতাও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেনি: ড. মাসুদ মালয়েশিয়ায় বেতন না পেয়ে কোম্পানির অফিস ঘেরাও-অবরোধ, যা বলল বাংলাদেশ দূতাবাস সংস্কার বা পরিবর্তন সবকিছু শুরু হয়েছিল বিএনপির হাত ধরেই : মির্জা ফখরুল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৩৭৩

সকল