দুর্যোগ প্রস্তুতিতে ইসলাম
- ডা: মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
- ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রকৃতি দান করেছেন। আমাদের বসবাসের উপযোগী করে এই সুন্দর বসুন্ধরা সাজিয়েছেন অপরূপ মায়াবী কারুকার্যে। যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রী দিয়েই মানুষকে পাঠিয়েছেন পৃথিবীর বুকে। এই প্রকৃতি মহান আল্লাহর সৃষ্ট ও পরিচালিত। তবে মাঝেমধ্যে প্রকৃতি বিরূপ ধারণ করে। আমাদের ওপর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ভারী বর্ষণ, বন্যা, খরা, দাবানল, শৈত্যপ্রবাহ; দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ভূমিকম্প, সুনামিসহ ইত্যাকার প্রাকৃতিক সব দুর্যোগ। এসব বিপদ থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে।
দুর্যোগে রাসূলের কেমন অবস্থা হতো : কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে রাসূলুল্লাহ সা: বিচলিত হয়ে পড়তেন। আল্লাহর শাস্তির ভয় করতেন। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করতেন এবং অন্যদেরও তা করার নির্দেশ দিতেন। ঝড়-তুফান শুরু হলে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। নফল নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাতেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর এ আমল দ্বারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী তা জানতে পারি। হাদিসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুমিনের বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্যের! তার প্রতিটি কাজই কল্যাণকর। যদি তারা (মুমিন বান্দা) সুখে থাকে তবে শুকরিয়া আদায় করে, যার ফলে তা কল্যাণকর হয়। আর সে বিপদে পড়লে ধৈর্য ধরে, তাও মঙ্গলজনক হয়।’ (মুসলিম)
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধৈর্য ধারণ করা : মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিভিন্ন বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা ও সতর্ক করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা নিজেদের বিপদ-মুসিবতের সময় বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে করুণা ও অনুগ্রহ বর্ষিত হয় আর এরাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সূরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)
দুর্যোগের সময় পালনীয় সুন্নত : প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কিছু সুন্নত আমল করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, যখন কোথাও ভূমিকম্প হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড় বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা, তার কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা, মহান আল্লাহকে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা: নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহর জিকির করো, তার কাছে তাওবা করো।’ (বুখারি-২/৩০, মুসলিম-২/৬২৮)
আল্লাহর জিকিরের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত বা দোয়া-দরুদ পাঠ করা। দুর্যোগের সময় জিকিরের আরো উপায় হতে পারে ইস্তিগফার, তাসবিহ পাঠ ইত্যাদি। হাদিস শরিফে আছে, প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া বইলে রাসূলুল্লাহ সা: মসজিদে যেতেন এবং নামাজে মশগুল হতেন। (মিশকাত শরিফ-৬৯৬) সাহাবিদের জীবনে আমরা দেখি, বিপদ-মুসিবতে তারা নামাজে দাঁড়াতেন এবং ধৈর্য ধারণ করতেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ-৫৩৪৫) ঝড়-তুফানে তাকবির (আল্লাহু আকবর) বলা ও আজান দেয়া সুন্নাত। (তবে এই আজানে ‘হাইয়াআলাছ ছালাহ’ ও ‘হাইয়াআলাল ফালাহ’ দুটি বাক্য বলার প্রয়োজন নেই)
বৃষ্টি-বাদলের সময় দোয়া : আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: বর্ণনা করেন, বৃষ্টি হলে রাসূলুল্লাহ সা: এই দোয়া পড়তেন- ‘আল্লাহুম্মা ছয়্যিবান নাফিআ’ (হে আল্লাহ! এই বৃষ্টি যেন আমাদের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর হয়)। (বুখারি ও মুসলিম) হজরত জায়েদ ইবনে ছাবিত রা: বর্ণনা করেন- বৃষ্টির পর রাসূলুল্লাহ সা: বলতেন, ‘আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহে আমরা বৃষ্টিস্নাত হয়েছি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অতিবৃষ্টির সময় সুন্নাত দোয়া পড়া : হজরত আনাস ইবনে মালিক রা: বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ সা: অধিক বৃষ্টি ও ভারী বর্ষণের সময় এই দোয়া পড়তেন, ‘হে আল্লাহ! এই ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ আমাদের আশপাশ থেকে সরিয়ে নিন, দয়া করে আমাদের ওপর ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ দেবেন না। হে আল্লাহ! এই ভারী বর্ষণ দিন টিলা-পর্বতে, উঁচু ভূমিতে, উপত্যকায়, বনভূমি ও চারণ ভূমিতে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ঝড়-তুফানের সময় দোয়া : হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ সা: ঝড়-তুফানের সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে এই দোয়া পড়তেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি এই ঝড়ের কল্যাণ, এর মধ্যস্থিত কল্যাণ, এর সাথে প্রেরিত কল্যাণ। আমি আপনার কাছে পানাহ চাই এই ঝড়ের অনিষ্ট থেকে, এর মধ্যস্থিত অনিষ্ট থেকে, এর সাথে প্রেরিত অনিষ্ট থেকে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
বজ্রপাত, ঝড়-তুফান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার দোয়া : প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ করুণ এক রূপ হলো বজ্রপাত, যা মহান রাব:Ÿুল আলামিনের শক্তিমত্তা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। এ সম্পর্কে কুরআন মজিদে রয়েছে- ‘বজ্রধ্বনি তার সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে, ফেরেশতারাও তাকে ভয় করে (প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে)। তিনি বজ্রপাত ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে আঘাত করেন। আর তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডা করে, অথচ তিনি মহা শক্তিশালী।’ (সূরা রাআদ-১৩)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: বর্ণনা করেন- বজ্রপাত ও বিজলি চমকানোর সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে রাসূলুল্লাহ সা: এই দোয়া পড়তেন, ‘হে আল্লাহ! গজব দিয়ে আমাদের নিঃশেষ করবেন না, আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করবেন না; এর আগেই আমাদের ক্ষমা করে দিন।’ (মিশকাত শরিফ-১৫২১, সুনানে তিরমিজি-৩৪৫০; নাসায়ি-৯২৭, মুসনাদে আহমাদ-৫৭৬৩, আদাবুল মুফরাদ, বুখারি-৭২১)
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায় : প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হলো আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টি। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি অযথা কাউকে শাস্তি দিতে চান না। আল্লাহর আজাব থেকে বাঁচার জন্য আমল পরিশুদ্ধ করতে হবে। যে আমলে আল্লাহ খুশি হন, সে আমল বেশি বেশি করতে হবে। নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকাহ ইত্যাদি ভালো কাজ করতে হবে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘সদকাহ আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে।’ (তিরমিজি-৬০০)
মুমিন বান্দার উচিত, সবসময় আল্লাহর পথে অগ্রসর হওয়া, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা, তার নির্দেশিত বিধিবিধান পালন করা। বিশেষ করে তার নিষেধাজ্ঞাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করা। তবেই আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনের কঠিন বিপদাপদ ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি দেবেন এবং মৃত্যুর পরে উত্তম প্রতিদান দেবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ (কল্যাণের ফয়সালা) তৈরি করে দেন।’ (সূরা তালাক-২) হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে করুণা চাও, কেননা আল্লাহ তার কাছে করুণা চাওয়াকে ভালোবাসেন।’ কুরআনে আরো এসেছে- ‘গুরু শাস্তির আগে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তির আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ (সূরা সাজদা-২১)
এ আয়াতের তাফসিরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘ছোট শাস্তি হলো দুনিয়ার বিপদাপদ, রোগব্যাধি, মৃত্যু এবং তাদের ওপর নেমে আসা অন্যান্য মুসিবত, যা দিয়ে আল্লাহ তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন, যাতে বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’ যেকোনো দুর্যোগ মুহূর্তে প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত প্রসারিত করার পাশাপাশি ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় তাদের প্রতিপালকের প্রতি তাওবার মাধ্যমে ফিরে আসা। তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়া। কেননা, যারাই বিপদাপদের মুহূর্তে তার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, তিনি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, তার দুঃখ-দুর্দশা দূর করেছেন।
লেখক : কলাম লেখক ও সংগঠক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা