১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

টেকসই ব্যবসার ভিত্তি ও রমজান

-

ইসলাম কর্মমুখী জীবনকে শুধু ইবাদতই সাব্যস্ত করেনি, আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো’- (সূরা আল জুমা : ১০)। হালাল উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো হালাল ব্যবসা। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘উত্তম উপার্জন হলো, একজন মানুষের নিজের হাতের কামাই এবং সবধরনের মাবরুর ব্যবসাবাণিজ্যের কামাই’। (মুসনাদে আহমদ : ১৭২৬৫)। মূসা ও সালেহ আ: ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের মহানবী সা: ব্যবসা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সাথে। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবিদের মধ্যে আবু বকর, ওমর, ওসমান, ত্বালহা, সা’দ, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ও জুবায়ের ইবনুল আওয়াম রা: ব্যবসায়ী ছিলেন।
জীবিকা উপার্জনের অনস্বীকার্য ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবসা টেকসই হওয়া অতীব জরুরি। টেকসই ব্যবসায়ের প্রধান অন্তরায় হলো- প্রতারণা, সিন্ডিকেট তৈরি করা, আস্থাহীনতা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, অত্যধিক লোভ, সামাজিক দায়বদ্ধতায় উদাসীনতা, তাকওয়াবিমুখতা ইত্যাদি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রমজান উৎকৃষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো।’ (সূরা আল বাকারাহ : ১৮৩) রমজানের মিশনই হলো- তাকওয়াভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। এটি এক বিশেষ ‘ট্রেনিং পিরিয়ড’।
মসজিদে সকাল-সন্ধ্যায় তাসবিহ পাঠকারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(তারা) সেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসাবাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর জিকির, সালাত কায়েম করা ও জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা সেদিনকে ভয় করে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। যাতে তাদের কৃত আমলের জন্য আল্লাহ তাদেরকে প্রতিদান দেন এবং তিনি স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন অপরিমিত রিজিক দান করেন। ’(সূরা নূর : ৩৭-৩৮) অর্থাৎ একজন সৎ ব্যবসায়ীকে তার ব্যবসা কার্যক্রম কখনোই আল্লাহর জিকির, সালাত কায়েম করা ও জাকাত প্রদান করা, আখিরাতে বিশ্বাস করা থেকে বিরত রাখতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ক্রেতা ও বিক্রেতা পৃথক না হওয়া পর্যন্ত উভয়ের এখতিয়ার (গ্রহণ ও বর্জনের স্বাধীনতা) থাকবে। যদি তারা উভয়ে সত্য কথা বলে ও (পণ্যের দোষত্রুটি) যথাযথ বর্ণনা করে, তবেই তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি (দোষ) গোপন করে ও মিথ্যা বলে, তবে তাদের কেনাবেচার বরকত বিনষ্ট হয়ে যাবে’ (সহিহ বুখারি : ২০৭৯) অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির সাথে কথা তো বলবেনই না বরং তাদের দিকে তাকিয়েও দেখবেন না এমনকি তিনি তাদের গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না বরং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।’ এদের অন্যতম হলো- ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে ব্যবসার পণ্য বিক্রি করে’ (সহিহ মুসলিম)।
উক্ত দু’টি হাদিসে ব্যবসায়িক লেনদেনে সততা ও পণ্যের গুণের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় না নেয়াকে আখিরাতে মুক্তি ও ইহজগতে ব্যবসায়ে লাভবান, সমৃদ্ধি ও সফলতার মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য দিকে সাওম ও প্রতারণাকে পরস্পর সাংঘর্ষিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।
আবার সাওমের উদ্দেশ্য যেমন তাকওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া তেমনি ব্যবসায়ে সফলতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে তাকওয়াকে। তাই রমজান হলো- টেকসই ও সফল ব্যবসা চর্চার সর্বোৎকৃষ্ট ‘ট্রেনিং পিরিয়ড’। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কিয়ামতের দিন ফাজের (পাপী) হিসেবে উপস্থিত করা হবে, তবে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সৎকর্ম করে ও সত্য কথা বলে তাকে ছাড়া।’ (তিরমিজি : ১২১০) সফল ব্যবসায়ী সম্পর্কে মহানবী সা: বলেন, ‘বিশ্বস্ত, সত্যবাদী মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদদের সাথে থাকবেন। (ইবনে মাজাহ) ব্যবসায়ীর চিরস্থায়ী জীবনের সফলতার জন্য ইহজাগতিক কয়েকটি চারিত্রিক আচরণ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ব্যবসায়ীকে ইহজগতে নিশ্চিত সফলতার দ্বার উন্মোচন করে দেবে।
সুতরাং টেকসই ব্যবসার ভিত্তি হলো- বিশ্বাসগত দিক থেকে আল্লাহর স্মরণ ও আখিরাতে বিশ্বাস এবং আচরণগত দিক থেকে ব্যবসা কার্যক্রমে সততা ও বিশ্বস্ততা, সালাত কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, পণ্যের গুণের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া, তাকওয়া অবলম্বন করা ও সৎকর্ম করা। তাই আমরা রমজানকে টেকসই ব্যবসা চর্চার ‘প্রশিক্ষণ সময়’ হিসেবে গ্রহণ করে জাগতিক ও পারলৌকিক জীবনের সফলতা নিশ্চিত করতে পারি।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক


আরো সংবাদ



premium cement