০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ জিলহজ ১৪৪৫
`

ছোটদের সাথে নবীজীর আচরণ

-

(দ্বিতীয় অংশ)
স্নেহ করা : শিশুদের সাথে মহানবী সা:-এর আচরণ ছিল অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ। আল্লাহর রাসূল সা: নিজেও শিশুদের স্নেহ করতেন এবং অন্যদেরকেও শিশুদের স্নেহ করার নির্দেশ দিতেন। নবী করিম সা: এক বাণীতে যেসব লোক শিশুদের স্নেহ করে না তাদেরকে নিজের দলভুক্ত নয় বলে আখ্যায়িত করে হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না ও বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৯৪৩) বিশ্বনবী সা: সেসব মহিলার প্রশংসা করেছেন যারা তাদের শিশুসন্তানদের প্রতি স্নেহশীল। এই প্রশংসার উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের স্নেহের প্রতি গুরুত্বারোপ করে অন্যান্য মহিলাকে শিশুদের স্নেহ করার প্রতি উৎসাহিত করা। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘উষ্ট্রারোহী মহিলাদের মধ্যে কুরাইশি মহিলারা সর্বোত্তম। তারা শিশুসন্তানদের প্রতি স্নেহশীল ও স্বামীর মর্যাদার উত্তম রক্ষাকারিণী।’ (বুখারি-৫০৮২)

কোলে নেয়া : শিশুদেরকে কোলে নেয়া মহানবী সা:-এর অন্যতম সুন্নত। বিশ্বনবী সা: অনেকসময় শিশুদের কোলে নিয়ে আদর করতেন। কখনো কখনো এমনো হতো যে, আল্লাহর রাসূল সা: দুই শিশুকে কোলে নিয়ে একজনকে ডান রানে ও অন্যজনকে বাম রানে বসাতেন। হজরত উসামা ইবনে জায়েদ রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমার হাত ধরে তার এক রানের উপর আমাকে বসাতেন এবং হাসানকে বসাতেন অন্য রানে। তারপর দু’জনকে একত্রে মিলিয়ে নিতেন। পরে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি এদের দু’জনের উপর রহম করুন। কেননা, আমিও এদের ভালোবাসি।’ (বুখারি-৬০০৩)

আরব দেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর নিয়ম ছিল তারা শিশুদের দুধপান করার জন্য গ্রামাঞ্চলের ধাত্রী মহিলাদের কাছে পাঠিয়ে দিত। এতে গ্রামীণ পরিবেশে শিশুদের বিকাশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতো ও তাদের ভাষা শুদ্ধ হতো। এই নিয়মের ধারাবাহিকতায় মহানবী সা:-ও তার পুত্র ইবরাহিম রা:-কে দুধপান করার জন্য গ্রামীণ পরিবেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পুত্রস্নেহে ব্যাকুল হয়ে মহানবী সা: মাঝে মধ্যেই ইবরাহিম রা:-কে দেখার জন্য গ্রামে যেতেন। এরপর সেখানে গিয়ে তাকে কোলে নিতেন। হজরত আনাস ইবনে মালিক রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর চেয়ে শিশুদের প্রতি বেশি স্নেহশীল আর কাউকে দেখিনি। ইবরাহিম রা: মদিনার গ্রামাঞ্চলে দুধপান করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: তাকে দেখার জন্য সেখানে যেতেন। আমরাও তার সাথে যেতাম। তিনি দাইয়ের ঘরে ঢুকতেন, আর ঘরটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকত। কেননা, তার দুধপিতা কর্মকার ছিলেন। তিনি ছেলেকে কোলে তুলে চুমু খেতেন। এরপর প্রত্যাবর্তন করতেন।’ (মুসলিম-৫৯২০)

চুমু দেয়া : হৃদয়ের টান, আকর্ষণ, স্নেহ ও ভালোবাসার কারণেই মূলত শিশুদের চুমু দেয়া হয়। যেসব লোকের অন্তরে আদর ও স্নেহ নেই তারা শিশুদের চুমু দেয় না। অবশ্য অপরিচিত ও অনাত্মীয় লোকদের সন্তানদের চুমু না দেয়াই ভালো। আল্লাহর রাসূল সা: আপন-পর নির্বিশেষে সব শিশুকেই অত্যন্ত ভালোবাসতেন ও আদর করতেন। কিন্তু কেবল আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের সন্তানদের চুমু দিয়ে তাদের প্রতি স্নেহ প্রকাশ করতেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: একদা হাসান ইবনে আলিকে চুম্বন করেন। সে সময় তার কাছে আকরা ইবনে হাবিস তামিমি রা: উপবিষ্ট ছিলেন। আকরা ইবনে হাবিস রা: বললেন, আমার ১০টি পুত্র আছে, আমি তাদের কাউকেই কোনো দিন চুমু দিইনি। রাসূলুল্লাহ সা: তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে স্নেহ করে না, সে দয়া পায় না।’ (বুখারি-৫৯৯৭) আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের শিশুদের চুমু না দেয়া স্নেহশূন্য হৃদয়ের পরিচায়ক। আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে কিছু বেদুইন তাদের সন্তানদের চুমু না দেয়ার কথা বললে মহানবী সা: আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের অন্তরে যদি দয়া না থাকে, তাহলে আমার কী করার আছে?’ হজরত আয়েশা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে গ্রামীণ কিছু আরবীয় লোক এলো। তারা প্রশ্ন করল, আপনারা কি আপনাদের শিশুদের চুমু দেন? উপস্থিত সবাই বললেন, হ্যাঁ! তখন তারা বলল, কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমরা তাদের চুমু দিই না। তারপর রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আমি কী করব, আল্লাহ যদি তোমাদের থেকে স্নেহ সরিয়ে নিয়ে থাকেন।’ (মুসলিম-৫৯২১)

জড়িয়ে ধরা : আল্লাহর রাসূল সা: শিশুদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। কখনো কখনো তিনি কোনো কোনো শিশুকে মৃদুভাবে আকর্ষণ করে কাছে এনে নিজের দেহ মোবারকের সাথে জড়িয়ে নিতেন ও আলিঙ্গন করতেন। এটি ছিল মহানবী সা: কর্তৃক শিশুদেরকে ভালোবাসা ও স্নেহ করার অনন্য বহিঃপ্রকাশ। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, ‘দিনের এক প্রহরে আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে রওনা হলাম। তিনি আমার সাথে কথা বলেননি। আমিও তার সাথে কথা বলছিলাম না। অবশেষে বনি কাইনুকার বাজারে পৌঁছলেন। তারপর তিনি ফিরে চললেন ও ফাতিমা রা:-এর ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এখানে কি শিশু আছে? এখানে কি শিশু আছে?’ আমরা অনুমান করলাম, তার মা তাকে ধরে রেখেছেন গোসল করানো ও সুগন্ধী পরানোর জন্য। কিন্তু অল্পক্ষণের ভেতরেই হাসান দৌড়ে এলেন এবং তারা পরস্পরে গলায় জড়িয়ে ধরলেন। সে সময় রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তাকে পছন্দ করি, তুমিও তাকে পছন্দ করো। আর পছন্দ করো সেসব ব্যক্তিকে যারা তাকে পছন্দ করে।’ (মুসলিম-৬১৫১)

আনন্দ দেয়া : শিশুরা এমন লোকদের পছন্দ করে ও ভালোবাসে যারা তাদের সাথে খেলা করে ও আনন্দ দেয়। নববী দায়দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার প্রচুর ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও, দু’জাহানের বাদশাহ ও রাষ্ট্রনায়ক হওয়া সত্ত্বেও মহানবী সা: শিশুদের সাথে ক্রীড়া করতেন। তাদেরকে হাসাতেন ও আনন্দ দান করতেন। হজরত ইয়ালা বিন ম্রুা থেকে বর্ণিত- তারা মহানবী সা:-এর সাথে প্রদত্ত এক আহারের দাওয়াতে রওনা হন। তখন হোসাইন রা: গলির মধ্যে খেলাধুলা করছিলেন। এ সময় নবী করিম সা: লোকেদের অগ্রভাগে এগিয়ে গেলেন এবং তার দু’হাত বিস্তার করে দিলেন। বালকটি এদিক-ওদিক পালাতে থাকল ও মহানবী সা: তাকে হাসাতে হাসাতে ধরে ফেললেন। এরপর তিনি এক হাত ছেলেটির চোয়ালের নিচে রাখলেন ও অপর হাত মাথার তালুতে রাখলেন। অতঃপর তাকে চুমু দিলেন ও বললেন, ‘হোসাইন আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে। যে ব্যক্তি হোসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালোবাসেন। হোসাইন আমার নাতিদের একজন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৪৪) শিশুদের সাথে শিশুসুলভ দুষ্টুমি করে তাদের আনন্দ দান করা শরিয়তসমর্থিত হওয়ার বিষয়টি হাদিসে প্রমাণিত হয়। হজরত মাহমুদ ইবনে রাবি রা: বলেন, আমার মনে আছে, মহানবী সা: একবার বালতি থেকে পানি নিয়ে আমার মুখমণ্ডলের উপর কুলি করে দিয়েছিলেন, তখন আমি ছিলাম পাঁচ বছরের বালক।’ (বুখারি-৭৭)

(চলবে)
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১


আরো সংবাদ



premium cement
ইসরাইলকে অস্ত্র দিলো আমিরাতের বিনিয়োগ নেয়া সার্বিয়ার কোম্পানি অবসরের পরও ইংল্যান্ড দলের সাথে থাকবেন অ্যান্ডারসন জামিয়া পটিয়ার ৩ ছাত্রকে গ্রেফতারের নিন্দা ও প্রতিবাদ মহাপরিচালকের শারীরিকভাবে অসুস্থ, মানসিকভাবে অত্যন্ত সবল ও সুস্থ খালেদা জিয়া : ব্যক্তিগত চিকিৎসক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরএসও-আরসার সংঘর্ষে নিহত ১ আর্তমানবতার কল্যাণে জামায়াতের কর্মতৎপরতা অব্যাহত থাকবে : অ্যাডভোকেট জুবায়ের ফরিদপুরে বাস-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২ শ্রীমঙ্গলে চা ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক নিহত দেশে ডেঙ্গুতে আরো ১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৪৯ বগুড়ায় স্বামীর নির্যাতনের ভিডিও করার পর স্ত্রীর আতহত্যা : স্বামী আটক ১৩ বছর পর এমপির স্ত্রী হত্যার রহস্য উদঘাটন

সকল