২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নিখিল বিশ্ব ৬ দিনে সৃষ্টি

-

নিখিল বিশ্বকে আল্লাহ পাক ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই বিষয়টি কুরআনে একাধিকবার তিনি বলেছেন। সূরা আল আরাফ-৫৪, সূরা ইউনুস-৩, সূরা হুদ-৭, সূরা আল ফুরকান-৫৯, সাজদাহ-৪, ক্বাফ-৩৮ এবং হাদিদ-৪ এই সাতটি স্থানে ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি পরিয়ে দেন রাতের উপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌড়ে রাতের পেছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র দৌড় স্বীয় আদেশের অনুগামী। শুনে রেখো, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ, বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক (সূরা আরাফ-৫৪)।
নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহ যিনি তৈরি করেছেন আসমান ও জমিনকে ছয় দিনে, অতঃপর তিনি আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি কার্য পরিচালনা করেন। কেউ সুপারিশ করতে পারবে না তবে তাঁর অনুমতি ছাড়া ইনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তাঁরই ইবাদত করো। তোমরা কি কিছুই চিন্তা করো না’ (সূরা ইউনুস-৩)?
তিনিই আসমান ও জমিন ছয় দিনে তৈরি করেছেন, তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে, তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে ভালো কাজ করে। আর যদি আপনি তাদেরকে বলেন যে, ‘নিশ্চয় তোমাদেরকে মৃত্যুর পরে জীবিত উঠানো হবে, তখন কাফেররা অবশ্য বলে, এটা তো স্পষ্ট জাদু’ (সূরা হুদ-৭)!
‘তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। তিনি পরম দয়াময়। তাঁর সম্পর্কে যিনি অবগত, তাকে জিজ্ঞেস করো’ (সূরা ফুরকান-৫৯)।
‘আল্লাহ যিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে বিরাজমান হয়েছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই। এর পরও কি তোমরা বুঝবে না’ (সূরা সাজদা-৪)?
‘আমি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি এবং আমাকে কোনোরূপ ক্লান্তি স্পর্শ করে না’ (সূরা ক্বাফ-৩৮)।
‘তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, অতঃপর আরশের ওপর সমাসীন হয়েছেন। তিনি জানেন যা ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা ভূমি থেকে নির্গত হয় এবং যা আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ও যা আকাশে উত্থিত হয়। তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাকো। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা দেখেন’ (সূরা হাদিদ-৪)।
সূরা ফুসসিলাতের এই চারটি (৯-১২) আয়াতের দিন সংখ্যা নিয়ে অনেকে সংশয়ে পড়েন। মূলত এখানে শেষ দুই প্রথম দুইয়ের ভেতর ধরলে সমস্যা থাকে না এবং এটিই সঠিক ব্যাখ্যা।
‘বলুন, তোমরা কি সে সত্তাকে অস্বীকার করো যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে এবং তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ স্থীর করো? তিনি তো সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা। তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন- পূর্ণ হলো জিজ্ঞাসুদের জন্য। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধূম্রকুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম। অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে দুই দিনে সপ্ত আকাশ করে দিলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তার আদেশ প্রেরণ করলেন। আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুশোভিত ও সংরক্ষিত করেছি। এটি পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা।’
এটি অনস্বীকার্য যে, কোনো কিছু সৃষ্টির জন্য আল্লাহ পাকের ছয় দিন কেন এক লহমার সময় নেয়ারও প্রয়োজন নেই। তিনি না সময়ের মুহতাজ না পরিকল্পনার মুখাপেক্ষী। তার স্বভাব হলো, তিনি বলেন তো সাথে সাথে হয়ে যায়। অনেক মুফাসসির বলেছেন- তিনি ‘কুন’ শব্দ দ্বারা হুকুম করারও দরকার পড়ে না।
তবু তিনি ছয় দিন কেন নিয়েছেন? কুরআন ব্যাখ্যাকারও এর দুটি সম্ভাব্য জবাব দাঁড় করিয়েছেন। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ হজরত সাইদ ইবনে জুবায়ের রা: এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার মহাশক্তি নিঃসন্দেহে এক নিমেষে সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু মানুষকে বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনায় ধারাবাহিকতা ও কর্মপক্বতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এতে ছয় দিন ব্যয় করা হয়েছে (তাফসিরে মাজহারি)।
কেউ কেউ বলেছেন, এটি করেছেন তাঁর ফেরেশতাদের দেখানোর জন্য। হতে পারে পৃথিবী সৃষ্টির আগেই আল্লাহপাক ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে তিনি ধীরতা করেছেন। এটি যেন তাদের উপলব্ধি হয় যে, তাদের মালিকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কত বিশাল ও ব্যাপক।
আবার কারো কারো ব্যাখ্যা হলো- আল্লাহ ইচ্ছা করে সময় নিয়েছেন তাঁর প্রিয় বান্দাদের তাঁর একটি মহত্তম গুণ প্রকাশ করতে। তা হলো দ্রুত করার সুযোগ থাকলেও মহান আল্লাহ, খোদ স্রষ্টা নিজেই পরিকল্পনার কৌশলটা এভয়েড করেননি। কোথায় সাগর হবে, কোথায় পাহাড়, কোথায় মানুষের বসতি, কোথায় প্রাণীদের অভয়ারণ্য এসব নিজে ধীরে সুস্থে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তবেই সাজিয়েছেন।
ত্বরা প্রবণতা আল্লাহর পছন্দনীয় নয়। মানুষের কোনো বিষয়ে দ্রুততার বিষয়ে আল্লাহ সমালোচনা করেছেন, ‘মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততাপ্রিয়’ (সূরা ইসরা-১১)।
ফাজালা ইবনে উবাইদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা: বসে ছিলেন। এমন সময় একজন লোক এলো এবং নামাজ আদায় করল। এরপর সে বলল, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমার প্রতি দয়া করুন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হে নামাজি! তুমি তাড়াহুড়ো করলে। নামাজ শেষে যখন তুমি বসবে, তখন তুমি আল্লাহর উপযুক্ত হামদ এবং আমার প্রতি দরুদ পাঠ করবে। অতঃপর তুমি দোয়া করবে’ (সুনানে তিরমিজি-৩৪৭৬)।
যাই হোক, বলছিলাম। আল্লাহর সৃষ্টি কুশলতা প্রসঙ্গে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকর্মটি আরম্ভ করেছিলেন রোববারে আর শেষ করেছিলেন সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন জুমাবারে। সৃষ্টি শেষের আনন্দ প্রকাশের জন্যই হতে পারে জুমার দিন বিশ্বাসীদের কাছে পবিত্র একটি সওয়াবের ও উৎসবের দিন। তাফসিরে আহসানুল বয়ানে সূরা আরাফের ৭ : ৫৪ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- এই ছয় দিন হলো রোববার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। শনিবার দিন সম্পর্কে বলা হয় যে- এ দিনে কোনো কিছু সৃষ্টি করা হয়নি।
শুধু সৃষ্টি করেই আল্লাহ ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে তিনি প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণও করে চলেছেন। সব সৃষ্টির ওপর তিনি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও রেখেছেন। ফলে গোটা সৃষ্টিকুল অবিরাম সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, কোথাও কোনো হইহাঙ্গামা নেই। আসমান, জমিন ও তদস্থিত সব কিছু তাঁর হুকুম মেনে চলছে।
তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি রাতকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং দিবসকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিযুক্ত করেছেন প্রত্যেকেই বিচরণ করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত। জেনে রাখুন, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ (সূরা জুমার-৫)।
তারা কি আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন তালাশ করছে? আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁরই অনুগত হবে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবে’ (সূরা আলে ইমরান-৮৩) সুবহান আল্লাহ।
লেখক : সাবেক অতিরিক্ত এমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড


আরো সংবাদ



premium cement