২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`

ইনসাফ কায়েমে মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শ

-

ইনসাফ ও ন্যায়বিচার এক মহৎ গুণ। ন্যায়বিচার ব্যক্তিকে সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয়পাত্র করে তোলে। শাসক বা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য ইনসাফ অপরিহার্য বিষয়। ইনসাফবিহীন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান সৎ ও প্রকৃত শাসক হতে পারে না। আমাদের প্রিয় নবী সা: ছিলেন ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের মূর্ত প্রতীক। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইনসাফের সুদীপ্ত আলো ছিল চির ভাস্বর, চির উজ্জ্বল ও চির বিরাজমান। তিনি নিজে ইনসাফ কায়েম করে গেছেন এবং তাঁর অনুসারীদের ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদেশ করেছেন। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবী ও তদীয় উম্মতকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আদেশ করেছেন। তিনি নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগেও ইনসাফ কায়েম করেছেন, পরেও। বন্ধু-শত্রু, দোস্ত-দুশমন ও মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দুশমন বা অমুসলিম বলে কারো সাথে বেইনসাফি করেননি। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনেও ইনসাফ কায়েম থেকে বিন্দুপরিমাণ পিছপা হননি।
প্রাক-নবুওয়াত জীবনে ইনসাফ : নবীজী সা: শৈশবে দুধমাতা হালিমা সাদিয়ার স্তনপান করেন। তিনি সবসময় তার ডান স্তন থেকে দুধ পান করতেন। দুধভ্রাতা আবদুল্লাহর জন্য বাম স্তন রেখে দিতেন। প্রাক-নবুওয়াত যুগে সমাজে ইনসাফ কায়েমের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন হিলফুল ফুজুল নামে একটি যুবসঙ্ঘ। যার কর্মসূচি ছিল এতিম-অনাথ ও বিধবাদের সহায়তা করা। বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো। নবীজীর ইনসাফের প্রতি শতভাগ আস্থা ছিল কুরাইশদের। তাই কাবার দেয়ালে হজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে যখন মতবিরোধ হয়, তখন নবীজী সা:-কে তারা বিচারক হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা সবাই একবাক্যে মেনে নেয়ার কথা প্রকাশ করে। অবশেষে তাঁর ইনসাফপূর্ণ ফয়সালা নির্দ্বিধায় মেনে নেয়।
পবিত্র কুরআনে ইনসাফ : পবিত্র কুরআনের ঘোষণা- ‘নিশ্চয় আল্লাহ আদেশ করেন ইনসাফ, মঙ্গলসাধন ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার।...’ (সূরা নাহল-৯০)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘(আপনি বলুন) এবং আমাকে আদেশ করা হয়েছে তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে।...’ (সূরা শূরা-১৫)
আরো ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে, তোমরা আমানতগুলো তার পাওনাদারদের পৌঁছে দাও এবং যখন লোকদের মধ্যে বিচার করো তখন ইনসাফের সাথে বিচার করো।...’ (সূরা নিসা-৫৮) এ ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ইনসাফ কায়েমের হুকুম করা হয়েছে।
হাদিসের আলোকে ইনসাফ : রাসূলুল্লাহ সা:-এর ইনসাফের ঘটনা হাদিস গ্রন্থগুলোয় অসংখ্য। তন্মধ্যে কয়েকটি হলো :
হজরত জাবির বিন আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: যখন জিরানায় গণিমতের মাল বণ্টন করছিলেন, তখন জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বলল, ইনসাফ করুন। রাসূল সা: বললেন, অবশ্যই আমি হতভাগা যদি আমি ইনসাফ না করি।’ (বুখারি-৩১৩৮, মুসলিম-১০৬৩)
হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, হোনাইন বিজয়ের দিনে রাসূল সা: গণিমতের মাল বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু লোককে প্রাধান্য দিলেন। অতএব, আকরা বিন হাবিসকে ১০০ উট দিলেন। উওয়ায়নাকেও দিলেন সমপরিমাণ এবং আরবের কতিপয় সম্মানিত ব্যক্তিকে সেদিন গণিমতের মালে প্রাধান্য দিলেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহর শপথ! এই গণিমতের মাল বণ্টনে ইনসাফ করা হয়নি এবং এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন উদ্দেশ্য করা হয়নি। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি নবীজীর কাছে এ ব্যাপারে খবর দেবো। অতঃপর আমি নবী সা:-এর কাছে এলাম ও বিষয়টি বর্ণনা করলাম। তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যদি ইনসাফ না করেন তাহলে কে ইনসাফ করবে! আল্লাহ মুসার প্রতি রহম করুন। তাঁকে এর চেয়েও বেশি কষ্ট দেয়া হয়েছে। আর তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন।’ (বুখারি-৩১৫০, মুসলিম-১০৬২)
সাহাবিদের ব্যাপারে ইনসাফ : রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন ন্যায়বিচারের উৎস। জীবনভর তিনি আপন-পর নির্বিশেষে সর্বক্ষেত্রে ইনসাফ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
হজরত আমের রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি নোমান বিন বশির রা:-কে বলতে শুনেছি, তখন তিনি মিম্বারের ওপরে ছিলেন তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে একদা কিছু উপঢৌকন দিলেন। তখন আমর বিনতে রাওয়াহা বললেন, আমি এতে সন্তুষ্ট হবো না, যতক্ষণ না রাসূল সা:-কে এ ব্যাপারে সাক্ষ্য করা হবে! তখন আমার পিতা রাসূলুল্লাহ সা:-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমর বিনতে রাওয়াহা থেকে আমার পুত্রকে কিছু উপহার দিয়েছি। এখন আমর বলছে আপনাকে যেন সাক্ষী রাখি! রাসূল সা: বললেন, ‘তুমি কি তোমার সব সন্তানকে এভাবে দিয়েছ?’ তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো এবং সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করো!’ বর্ণনাকারী বলেন, তিনি ফিরে এলেন এবং তার উপহার ফেরত আনলেন। (তিরমিজি-১৩২৮)
স্ত্রীদের সাথে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ : নবীজী সা: ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের স্তম্ভ। ন্যায়বিচার ছিল তাঁর স্বভাবজাত বিষয়। উম্মাহাতুল মুমিনিনের মধ্যে তাঁর ন্যায়বিচার উম্মতের নারীদের জন্য উত্তম আদর্শ। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি (উরওয়া বিন যুবায়েরকে লক্ষ্য করে) বলেন, হে আমার ভগ্নিপুত্র! রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের কাছে অবস্থানের পালা বণ্টনের ক্ষেত্রে কারো ওপর কাউকে প্রাধান্য দিতেন না। এমন দিন কমই ছিল যেদিন তিনি আমাদের সবার কাছে গমন করতেন না। অতএব তিনি তাঁর সব স্ত্রীর কাছে আগমন করতেন স্পর্শ করা ব্যতীত। এভাবে যার পালা তার কাছে যেতেন এবং তার কাছে রাত্রিযাপন করতেন। (আবু দাউদ-১২৩৫)
হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: পালা বণ্টন করতেন ও ইনসাফ করতেন এবং বলতেন, হে আল্লাহ! এটি আমার (পালা) বণ্টন, যার সামর্থ্য আমি রাখি। অতএব, আমাকে তিরস্কার করবেন না যার সামর্থ্য আপনি রাখেন, আমি রাখি না।’ (আবু দাউদ-১২৩৪, তিরমিজি-১১৪০, নাসায়ি-৭/৬৪, ইবনে মাজাহ-১৯৭১)
হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: যখন সফর করতেন, স্ত্রীদের মধ্যে লটারি দিতেন।’ (বুখারি-৫২১১, মুসলিম-২৪৪৫)
অমুসলিমদের সাথে ইনসাফ : তিনি কথাবার্তা, চালচলন ও অন্যান্য বিষয়ে মুসলিম-অমুসলিমদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। অর্থাৎ মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো ঘটনা ঘটলে তার সত্য ও ন্যায়ের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেন এবং নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মুসলিমের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করে, তাহলে সে আল্লাহর সমীপে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন।’ আশআস রা: বলেন, আল্লাহর কসম। এটি আমার সম্পর্কেই ছিল। আমার ও এক ইহুদি ব্যক্তির মধ্যে যৌথ মালিকানায় একখণ্ড জমি ছিল। সে আমার মালিকানার অংশ অস্বীকার করে বসল। আমি তাকে নবী স:-এর কাছে নিয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে বললেন, ‘তোমার কোনো সাক্ষী আছে কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি ইহুদিকে বললেন, তুমি কসম করো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সে তো কসম করবে এবং আমার সম্পত্তি নিয়ে নেবে। তখন আল্লাহ তায়ালা (এ আয়াত) নাজিল করেন, ‘যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে...।’ (সূরাআলে ইমরান-৭৭, বুখারি-২২৫৬)
শেষ কথা : রাসূল সা: আমরণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। তিরোধানের আগে ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী একদল অনুসারী তৈরি করে গেছেন, যারা মানবসভ্যতার ইতিহাসে ইনসাফ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতুল আবরার দারুল উলুম আল-ইসলামিয়া, উরশিউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া


আরো সংবাদ



premium cement
দামুড়হুদা সীমান্ত থেকে প্রায় ৩৪ লাখ টাকার রুপা উদ্ধার চিরিরবন্দরে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক ব্যক্তি নিহত ভাষার বইয়ের ওপর অনলাইন কন্টেন্ট ও লেকচার তৈরি করবে সরকার ‘একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে’ ২৪ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর একুশের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে : প্রধান বিচারপতি মির্জাগঞ্জ প্রেস ক্লাবের কমিটি গঠন আত্মবিশ্বাসী আফগানিস্তানের সামনে দক্ষিণ আফ্রিকা লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে হিজবুল্লাহর স্থাপনায় ইসরাইলের বিমান হামলা বিমানবন্দর থেকে ৪৫ বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠালো মালয়েশিয়া চাঁদপুরে আগুনে পুড়ল ১২ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আহত ১০

সকল