৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৫
`

নামাজ আল্লাহর সাথে মেরাজ সমতুল্য

-

মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়কর ঘটনা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ঊর্ধ্বালোকে গমন, যা লাইলাতুল মেরাজ বা শবেমেরাজ নামে পরিচিত। মেরাজ আরবি শব্দ। মূল শব্দ ‘উরুজ’ অর্থাৎ উত্থান। সাধারণ অর্থে ঊর্ধ্বারোহণ বা সিঁড়ি বা সোপান। অন্য অর্থ ঊর্ধ্বালোকে আরোহণ বা মহামিলন। এটি একটি অলৌকিক ঘটনার স্পষ্ট ইঙ্গিত, যার সাথে রয়েছে ঈমানের গভীরতম সম্পর্ক। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনের অন্যতম ঘটনা হলো ‘মেরাজ’। ইসলামী পরিভাষায় মেরাজ হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: কর্তৃক সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল আ: ও হজরত মিকাইল আ: সমভিব্যহারে মহান রাব্বুল আলামিনের সাথে দিদার লাভ। নবীজী সা: আল্লাহর অশেষ রহমতে ঊর্ধ্বাকাশে আরশে আজিমে ভ্রমণ করেছেন- এই বিশ্বাস রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।
হিজরতের আগে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে নবীজী সা: আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন।
সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ৬৩ বছর জীবনের অসংখ্য ও অগণিত বিশেষত্বের মধ্যে সবচেয়ে গৌরবমণ্ডিত, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, গৌরবোজ্জ্বল ও চমকপ্রদ ঘটনা হলো মেরাজ বা ঊর্ধ্বজগত ভ্রমণ। রাসূল সা:-এর জীবনের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হলো মেরাজ। মেরাজের বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজতে যাওয়া অবান্তর চিন্তামাত্র। কারণ যুক্তি ঈমানের ভিত্তি নয়; বরং ঈমানই যুক্তির ভিত্তি। যুক্তির ক্ষমতা যেখানে শেষ, ঈমানের যাত্রা সেখান থেকে শুরু। মেরাজ মূলত একটি মোজেজা। মেরাজ বিশ্বের ইতিহাসে শুধু সাধারণ ঘটনা নয়; বরং মানবতার মুক্তির দূত নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনে একটি অত্যাশ্চর্য ও বিস্ময়কর অধ্যায়।
ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র শবেমেরাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবোধসম্পন্ন। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ৫০ বছর বয়সে অর্থাৎ নবুয়াতের দশম বর্ষে, হিজরতের দেড় বছর আগে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে লাইলাতুল মেরাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে।
মেরাজের প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ মক্কা নগরের কাবা শরিফে বা মসজিদুল হারামের হাতিম থেকে পবিত্র জেরুসালেমের মসজিদুল আকসা অবধি বোরাকে আরোহণ ও অবতরণ করা পর্যন্ত ইহলোক ভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয়। এখান থেকেই নূরের চলন্ত সিঁড়িতে মহাকাশ তথা ঊর্ধ্বালোকে সফরকে ‘মেরাজ’ বলে। সামগ্রিকভাবে এ নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ শবেমেরাজ নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন শীর্ষস্থানীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা পবিত্র কুরআনে একাধিক সূরায় ও হাদিসে লাইলাতুল মেরাজের বর্ণনা রয়েছে।
বর্ণনায় জানা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মহানবী সা:-কে কাবা শরিফসংলগ্ন স্থান হাতিমের কাছে নিয়ে আসা হয়। এরপর জমজমের কাছে নিয়ে তাঁর সিনা চাক বা বক্ষ বিদারণ করা হয়। তারপর যথাসময়ে পানি দ্বারা ধৌত করে ঈমান ও হিকমত দ্বারা পরিপূর্ণ ও শক্তিশালীকরত পুনরায় যথাস্থানে সংস্থাপন করা হয়। এরপর রাসূল সা: অজু করে হাতিমের কাছে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। পরে বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি বেহেশতি যান ‘বোরাকে’ নবীজীকে আরোহণ করানোর সাথে সাথেই তা দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে। এক হাজার মাইল দূরত্বে প্রথমে মদিনা মুনাওয়ারা পরে সিনাই পর্বত, তারপর হজরত ঈসা আ:-এর জন্মস্থান ‘রায়তে লাহম’ হয়ে চোখের পলকে জেরুসালেমের মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছান। এখানে সব নবী-রাসূল নবীজীকে প্রাণঢালা স্বাগতম ও অপূর্ব সংবর্ধনা জানান। হজরত জিবরাইল আমিন আজান ও ইকামত দেন। নবী-রাসূলদের মুকুটমণি রাসূল সা: সেখানে আম্বিয়া কেরামের সাথে দুই রাকাত নামাজের জামাতে ইমামতি করেন। তিনি হলেন ইমামুল মুরসালিন অর্থাৎ সব নবী-রসূলের ইমাম। নামাজের পর জিবরাইল আ: উপস্থিত সবার সাথে রাসূলুল্লাহ সা:-এর পরিচয় করিয়ে দেন।
নৈশভ্রমণের প্রথমাংশ সমাপ্ত হওয়ার পর নবী করিম সা: পুনরায় বোরাকে আরোহণ করলে তা দ্রুতগতিতে ঊর্ধ্বালোকে যাত্রা শুরু করে। প্রথম আসমানে হজরত আদম আ:, দ্বিতীয় আসমানে হজরত ঈসা আ: ও ইয়াহিয়া আ:, তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ আ:, চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস আ:, পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন আ:, ষষ্ঠ আসমানে হজরত মূসা আ: এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম আ:-এর সাথে মহানবী সা:-এর সাক্ষাৎ হয় এবং পরস্পর শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় হয়।
সপ্তম আসমানে অবস্থিত আসমানি কাবাগৃহ বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশতাকে নামাজ আদায় করতে দেখেন। এরপর তিনি জিবরাইল আ:-এর সাথে বেহেশত ও দোজখ পরিদর্শন করেন। এভাবে সপ্তম আসমান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত এসে সফরসঙ্গী হজরত জিবরাইল আ:, হজরত মিকাইল আ: ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর ঐশী বাহন বোরাকের গতি স্থির হয়ে যায়। জিবরাইল আ: এখানে থমকে দাঁড়িয়ে মহানবী সা:-কে বললেন, সামনে অগ্রসর হওয়ার আর কোনো ক্ষমতা তার নেই। এখানেই রাসূলুল্লাহ সা: ফেরেশতা জিবরাইল আ:-কে তার স্বরূপে দেখতে পান। সিদরাতুল মুনতাহায় মহানবী সা: চারটি প্রবহমান নদী দেখতে পেলেন। দু’টি ভেতরের দিকে প্রবাহিত ও দু’টি বাইরে। মহানবী সা: নদীগুলোর নাম সম্পর্কে হজরত জিবরাইল আ:-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ভেতরের দু’টি বেহেশতের সালসাবিল ও কাউসার নদী। আর বাইরের দু’টি মিসরের নীল ও ইরাকের ফোরাত নদী।
নবীজীর বাহনের এখানে (সিদরাতুল মুনতাহা) পরিবর্তন হয়। ‘রফরফ’ নামক বিশেষ স্বর্গীয় বাহনে আরোহণ করে রাব্বুল আলামিনের অসীম কুদরতে কল্পনাতীত দ্রুত বেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মুয়াল্লার (আরশে আজিম) সন্নিকটে পৌঁছায়ে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন মহানবী সা:। নূর আর নূরের সৌরভের মহাসমারোহে তিনি অভিভূত হয়ে যান। এখানেই আল্লাহ তায়ালার সাথে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর দিদার লাভ ও কথোপকথন হয়। হজরত মুহাম্মদ সা: একমাত্র মহামানব যিনি আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ সা: করুণা ও শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পুরস্কার হিসেবে আল্লাহর বান্দাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ওই রাত ও ঊষার সন্ধিক্ষণে আবার মক্কায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।
বর্ণনায় পাওয়া যায়, মেরাজের রাতে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হলেও পথে হজরত মূসা আ:-এর পরামর্শে আল্লাহর দরবারে সুপারিশক্রমে ১০ বারে কমতে কমতে পাঁচ ওয়াক্তে এসে দাঁড়ায়। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ৫০ ওয়াক্ত নামাজের সমান সওয়াবভুক্ত হিসেবে গৃহীত হয়। সুতরাং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পবিত্র শবেমেরাজের উপহার। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, নামাজ যেহেতু আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যের বাস্তবরূপ সেহেতু নামাজ আল্লাহর সাথে মেরাজ সমতুল্য।
নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায় এবং মুমিনরা আত্মিকভাবে আল্লাহর দিদার পেয়ে থাকে।
বস্তুত মহানবী সা:-এর মেরাজ একটি বিস্ময় সৃষ্টিকারী মোজেজা। এটির অনুপম শিক্ষা, বিভিন্ন দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। মহাবিশ্বে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টিরহস্য উদঘাটনের পরম সৌভাগ্য রাসূলুল্লাহ সা:-কে প্রদান করে মানব মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ তায়ালা মেরাজের মাধ্যমে নির্ধারণ করেছেন। এ রাতে বায়তুল মুকাদ্দাসে মহানবী সা:-এর ইমামতিতে হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে সব নবী-রাসূলের নামাজ আদায় করার মাধ্যমে নবীজীর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর নৈতিক, আদর্শিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার অনুসরণীয় বিশ্বজনীন স্বরূপটিই প্রমাণিত হয়। তাই পবিত্র মেরাজের শিক্ষা স্র্রষ্টার ইবাদত, সৃষ্টির সেবা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।


আরো সংবাদ



premium cement