মানুষের মধ্যে শয়তান
- জাফর আহমাদ
- ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শয়তানের কতগুলো প্রবেশদ্বার আছে, যেগুলোর মাধ্যমে সে খুব সহজেই মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং অত্যন্ত সুকৌশলে ও ধূর্ততার সাথে তার কার্যসিদ্ধি করে সটকে পড়ে। প্ররোচনা থেকে বাঁচার জন্য এই প্রবেশদ্বারগুলো চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে।
মেয়ে মানুষ : এমন মেয়ে মানুষ যিনি আপনার স্ত্রীও নয় বা মুহররমাত নন। তার সাথে অবাধে চলাফেরা ও ওঠাবসা করা অত্যন্ত ভয়াবহ কাজ। শয়তান যেকোনো সময় আপনার বিপদ ডেকে আনতে পারে।
খারাপ মানুষের সঙ্গ : আবহমান বাংলার একটি প্রবাদ পথে-ঘাটে ও মানুষের মুখে মুখে উড়ে বেড়ায়, তা হলো, ‘সৎ সঙ্গ সর্গবাস, অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ’। খারাপ মানুষের সংস্পর্শে মানুষ খারাপ পথে পা বাড়ায়। নবী সা: মুসনাদে আহমাদ ও নাসাঈ-এর এক হাদিসে বলেছেন, ‘হে আবু যার! মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যেও কি আবার শয়তান হয়? বললেন হ্যাঁ।
রাগের মুহূর্ত : মানুষ হিসাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আবেগ-অনুভূতি, মানব-অভিমান ও রাগ-বিরাগ সবই থাকতে পারে। কিন্তু ইসলামে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ কর্মসূচিও দিয়েছে। রাগ করবেন না। রাগ মানুষের স্বাস্থ্য, ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক সম্পর্ককে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাগের সময় শয়তান তার মধ্যে প্রবেশ করে এবং তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয়। ফলে তার দ্বারা যেকোনো মারাত্মক হীনতর কাজ সংঘটিত হয়ে যেতে পারে। শয়তান তার অগ্নিমূর্তিতে আরো বেশি করে আগুন ঢেলে দেয়। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি নবী সা:-কে বলল : আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন : তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার তা বললেন, নবী সা: প্রত্যেকবারই বললেন : রাগ করো না। (বুখারি-৬১১৬) আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয় বরং সেই আসল বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। (বুখারি-৬১১৪, মুসলিম-২৬০৯, আহমাদ-৭২২৩) রাগ এমন একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা পরিত্যগ করতে পারলে জীবনের অধিকাংশ মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা যায়। কারণ একজন মানুষের জীবন আনন্দ-বেদনার সমন্বয়ে গঠিত। রাগ পরিহার করতে পারলে মানুষের জীবনের অর্ধেক অমঙ্গল এড়ানো সম্ভব। রাগ সব মন্দ কাজকে একত্রিত করে।
জ্ঞানহীনতা : অপ্রতুল জ্ঞান অথবা জ্ঞানশূন্যতা শয়তানের জন্য বিশাল রাজপথ। এই পথে সে সহজেই মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং তাকে বিপথগামী অমানুষে পরিণত করে। তাই বলা হয় জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান থাকলে শয়তান তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না এবং তাকে দিয়ে খারাপ কাজ করাতে পারে না।
লোভ : লোভ-লালসা কোনো মুমিন-মুসলমান তো দূরের কথা সাধারণ কোনো মানুষেরও বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব হতে পারে না; বরং এটি নিকৃষ্ট জীব কুকুরের বৈশিষ্ট্য। মানুষের মধ্যে যারা প্রবৃত্তির লালসার সামনে নতজানু হয় এবং প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়, তাদের আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ঘৃণিত প্রাণীর সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি চাইলে ওই আয়াতগুলোর সাহায্যে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম কিন্তু সে তো দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে রইল এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। কাজেই তার অবস্থা হয়ে গেল কুকুরের মতো, তার ওপর আক্রমণ করলেও সে জিভ ঝুলিয়ে রাখে আর আক্রমণ না করলেও জিভ ঝুলিয়ে রাখে। যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদের দৃষ্টান্ত এটাই। তুমি এ কাহিনী তাদের শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তাভাবনা করবে।’ (সূরা আরাফ-১৭৬) এই লালসার সূত্র ধরে শয়তান তার মধ্যে প্রবেশ করে। শয়তান লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। আব্বাস ইবনে সাহল ইবনে সাদ রা: থেকে বর্ণনা করেন। আমি ইবনে যুবায়ের রা:-কে মক্কায় মিম্বরের ওপর তার খুতবার মধ্যে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, হে লোকেরা! নবী সা: বলতেন, যদি বনি আদমকে স্বর্ণে ভরা এক পাহাড় মাল দেয়া হয়, তথাপিও সে দ্বিতীয়টার জন্য লালায়িত হয়ে থাকবে। আর তাকে দ্বিতীয়টি যদি দেয়া হয়, তাহলে সে তৃতীয়টার জন্য লালায়িত থাকবে। বনি আদমের পেট মাটি ছাড়া ভরতে পারে না। তবে যে তওবা করবে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।
কঠিন পরিস্থিতির মুহূর্তে : মানুষের জীবন বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে অতিবাহিত হয়। দুঃখ-বেদনা ও সুখ-সমৃদ্ধি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে শয়তান তাকে বিভিন্নভাবে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু যারা আল্লাহকে রব হিসাবে কবুল করেছে, তাঁর ওপর পূর্ণ তায়াক্কুল রাখে এবং দৃঢ় বিশ^াস পোষণ করে যে, কষ্টের পর সহসাই সমৃদ্ধি ফিরে আসবে।
হতাশার সময় : হতাশা বা নিরাশা এমন এক ক্ষতিকর বদগুণ যা মানুষের সব প্রকার যোগ্যতাকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। শয়তান তাকে বিভিন্ন কুবুদ্ধি দিতে থাকে। হতাশা মানুষের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক শক্তিকে এমনভাবে দুর্বল করে দেয় যে, সব রক্ষত্রে সে একজন অযোগ্য ও অকর্মণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়। হতাশাগ্রস্ত এই ব্যক্তিটি পরিবারের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে যেমনভাবে বিনষ্ট করে, তেমনি সমাজ ও পেশাগত জীবনে একজন অযোগ্য, অকর্মণ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। হতাশা এমনভাবে ঘিরে ধরে যে ঢিলেমি তাকে সামনে চলার সব পথ রুদ্ধ করে দেয়। হতাশার আরেকটি বড় প্রভাব হলো, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি সব কাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ইতিবাচকতা তার আজন্মের শত্রুতে পরিণত হয়। এ ধরনের ব্যক্তি নেতিবাচক মনোভাব প্রচ্ছন্ন ও অপ্রচ্ছন্ন দু’ভাবে প্রকাশ করে। একটি ভালো কাজের প্রতি সবাই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে; কিন্তু ওই ব্যক্তি যে হতাশা রোগে আক্রান্ত, সে তার মনোভাব এমনভাবে প্রকাশ করবে, প্রাথমিকভাবে বুঝা যাবে না সে নেতিবাচক নাকি ইতিবাচক। কিন্তু একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, প্রচ্ছন্নভাবে সে নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করেছে। এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেরা তো সফলতার মুখ দেখতে পা-ই না, অধিকন্তু তারা অন্যের সফলতাকেও সহ্য করতে পারে না।
কোনো মুমিন কখনো হতাশ হতে পারবে না। কারণ শয়তানের অপর নাম ইবলিস। ইবলিস মানে হতাশ। তাই কোনো মুমিন হতাশ হওয়ার সাথে সাথে তিনি ইবলিশ হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং খুব দ্রুত তাকে তাওবা করে আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে ফিরে আসতে হবে। পূর্ণ আশা নিয়ে আল্লাহর রাহিম, আল্লাহ রাহমান, গাফুর, রাউফুম বিল ইবাদ, আল্লাহ কারিম, আফুয়ুসহ তাঁর দয়া ও করুণায় পরিপূর্ণ তাঁর গুণাবলির সীমায় প্রবেশ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘(হে নবী!) বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজের ওপর জুলুম করেছ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা জুমার-৫৩)
অহঙ্কার : অহঙ্কার করবেন না। অহঙ্কার একমাত্র আল্লাহর অধিকার। মানুষ কখনো অহঙ্কার করতে পারে না। যদি কেউ অহঙ্কার করে তবে সে যেন আল্লাহর অধিকার নিয়ে টানাটানি করে। মনে রাখবেন, অহঙ্কার শয়তানের কাজ। কারণ অহঙ্কার পৃথিবীর প্রথম গুনাহ। আর এটি প্রথম সংঘটিত হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কীট ইবলিস কর্তৃক। অহঙ্কারের মাধ্যমেই শয়তান সর্বপ্রথম গুনাহর খাতায় নাম লিখিয়েছিল এবং এটিই সর্বপ্রথম আল্লাহর হুকুমকে মানতে অবাধ্য করেছিল। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি ফিরিশতাদেরকে বলেছিলাম : আদমকে সেজদা করো। সবাই সেজদা করল। কেবল ইবলিস করল না। সে অস্বীকার ও অহঙ্কার করল। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ সূরা আরাফে বলা হয়েছে- ইবলিস বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুন থেকে এবং তাকে (আদমকে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।’
ধৈর্যচ্যুতি : আপদ-বিপদ আপতিত হলে, শয়তান তাকে বিভিন্ন ধরনের কুপ্রস্তাব দিতে থাকে। ফলে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং বিভিন্ন খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ধৈর্য ধারণের সদুপদেশ দান করেছেন এবং ধৈর্যশীলদের জন্য অপরিমিত পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
হাদিসে ধৈর্যকে আলো হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। (বুখারি-২২৩, মুসলিম-৩৫১৭, ইবনে মাজাহ-২৮০, আহমাদ : ২২৩৯৫, ২২৪০২১) এই আলোর মাধ্যমে সে সাফল্যের রাজপথ দেখতে পায়। বিপদের রাত যত গভীর হয় প্রভাত বা সাফল্যের আলো তত কাছে চলে আসে। তাই বিপদের সময় শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি আশ্রয় চাইতে হবে।
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা