ইসলামে সম্পদ বণ্টনের মূলনীতি
- ড. ইকবাল কবীর মোহন
- ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
(গত দিনের পর)
সম্পদ পুঞ্জীভূত করাকে নির্মূল করা : ইসলামী বিধান মতে, সম্পদ বণ্টনের তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো, সম্পদকে গুটিকতেক মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত না রেখে সম্ভব অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন লোকের মাঝে তাকে ছড়িয়ে দেয়া, যাতে বাস্তবিকপক্ষে, সমাজের ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধানকে যতটা সম্ভব দূর করা যেতে পারে। সম্পদের যে প্রাথমিক উৎস তার ওপর একচেটিয়া কারো নিয়ন্ত্রণ ইসলাম পছন্দ করে না, বরং সমাজের প্রতিটি মানুষ যাতে কোনো সম্পদ থেকে উপকৃত হতে পারে তার ব্যবস্থা করে ইসলাম। যেমন খনিজ, বন-বনানী, আবাদহীন খালি জমি, নদী, সাগর ইত্যাদি সম্পদের প্রাথমিক উৎস। প্রতিটি মানুষ তার সামর্থ্য ও শ্রম দ্বারা এসব সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে, এগুলোর ওপর কারো একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তার রাসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রাসূলের, তার আত্মীয়-স্বজনের, ইয়াতিমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্য যাতে ধন-সম্পদ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী কেবল তাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়।’ (সূরা হাশর; ৫৯ : ৭)
তবে যেখানে সম্পদ উৎপাদনে মানুষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয় এবং মানুষ তার শ্রম, মেধা ও মনন দিয়ে কোনো জিনিস বা পণ্য উৎপাদন করে, ইসলাম তার মেধা ও শ্রমকে যথাযথ মূল্য দেয় এবং উৎপাদিত পণ্যের ওপর তার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। প্রত্যেকে তার বিনিয়োজিত শ্রম ও যোগ্যতা অনুসারে তার প্রাপ্য পাওয়ার অধিকার রাখে। এ ব্যাপারে আল-কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে : ‘আমিই বণ্টন করে রেখেছি তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে এবং তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, যাতে একে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে।’ (সূরা : যুখরুফ, ৪৩ : ৩২)
অর্থসম্পদ লাভের ভ্রান্ত উপায় ও পন্থা নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে আল্লাহ বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদও জমিয়ে রাখাকে তীব্রভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে মানুষের দোষ প্রচার করে এবং গালাগাল করে। যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করেছে এবং গুনে গুনে রেখেছে। সে মনে করে তার অর্থ-সম্পদ চিরদিন তার কাছে থাকবে। কখনো নয়। সে তো চূর্ণবিচূর্ণকারী স্থানে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (সূরা : হুমাযা, ১০৪ : ১-৪)
‘সেইসব লোককে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও, যারা সোনারূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, অথচ তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।’ (সূরা: তওবা, ৯ : ৩৪)। ‘যারা আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহের ক্ষেত্রে কার্পণ্য করে, তারা যেন মনে না করে যে, এটা তাদের পক্ষে ভালো। না বরঞ্চ এটা তাদের জন্য অত্যন্ত খারাপ। তারা কৃপণতা করে যা কিছু সঞ্চয় করেছে, কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলার রশি হয়ে দাঁড়াবে।’ (সূরা আলে-ইমরান, ৩ : ১৮০)
উপরে সম্পদ বণ্টনের যে তিনটি ইসলামী নীতি ও লক্ষ্য বর্ণনা করা হলো, তার প্রথমটি ইসলামী অর্থনীতির সাথে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির তফাৎকে নির্দেশ করে, তৃতীয়টি পুঁজিবাদের সাথে ইসলামী অর্থব্যবস্থার ফারাক স্পষ্ট করে এবং দ্বিতীয়টি উভয় ব্যবস্থার সাথে ইসলামী ব্যবস্থার পার্থক্যকে নির্দেশ করে।
অর্থব্যবস্থায় অপব্যয় ও অপচয় রোধ করা : যথার্থ উপায়ে বা বৈধ পথে সম্পদ অর্জন করাই শুধু ইসলামী অর্থনীতির কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য নয়, বরং এই অর্থ অপচয় ও অপব্যয় রোধও ইসলামের লক্ষ্য। অর্থকে অবৈধ উপায়ে উড়িয়ে দেয়া, কিংবা বিলাসিতা, আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ উপভোগে ব্যয় করা এবং দিন দিন জীবনযাপনের মান বাড়ানোর একমাত্র ধান্ধায় বল্গাহীন অর্থ ব্যয় করাকে ইসলাম তীব্রভাবে নিন্দা করেছে। আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘অর্থ ব্যয়ে সীমালঙ্ঘন কর না। আল্লাহ অপব্যয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনআম, ৬ : ১৪১)। ‘অপব্যয় কর না। অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার মনিবের চরম অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি-ইসরাইল, ১৭ : ২৬-২৭)
তবে ব্যয়ের বেলায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। অপব্যয় যেমন করবে না, তেমনি খরচের বেলায় মানুষ কৃপণতাও করবে না। কেননা, মানুষের অর্থ-সম্পদে তার পরিবার-পরিজন এবং অন্যদের অধিকার রয়েছে। তাই সবার অধিকারের প্রতি খেয়াল রাখতে গিয়ে তাকে পরিমিত ব্যয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কৃপণতা করা যাবে না। কেননা, আল্লাহ কৃপণতা পছন্দ করেন না। আল্লাহ বলেন, ‘আর নিজের হাতকে (কৃপণতা করে) গলায় বেঁধে রেখো না, আবার সম্পূর্ণ প্রসারিতও করে দিও না। এমনটি করলে তোমরা তিরস্কৃত হবে এবং খালি হাতে বসে পড়বে।’ (সূরা বনি-ইসরাইল, ১৭ : ২৯)। ‘এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারাই) যারা ব্যয় করার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনও করে না, আবার কৃপণতাও করে না, বরঞ্চ তারা উভয় চরম পন্থার মধ্যবর্তীতে অবস্থান করে।’ (সূরা ফোরকান, ২৫ : ৬৭)
পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম সম্পদ অর্জন এবং ব্যবহার বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে ইনসাফপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত বিধান দিয়েছে তা ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক বিষয়। মানুষের জন্য একটি কল্যাণমূলক এবং সুষম অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং এর মাধ্যমে মানুষকে জুলুম, শোষণ ও যাবতীয় প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য ইসলামে সম্পদ আহরণ ও বণ্টনের মূলনীতি অবশ্যই মেনে চলা উচিত।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি.
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা