ইসলামে সম্পদ বণ্টনের মূলনীতি
- ড. ইকবাল কবীর মোহন
- ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সম্পদ আহরণ ও বণ্টনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটি অর্থনীতির মৌলিক বিষয়। সম্পদ আহরণ ও বণ্টনে সুষম নীতিমালা গ্রহণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম লক্ষ্য। প্রচলিত অর্থনীতি এ বিষয়ে অনেক অগ্রসর হলেও সম্পদ সমবণ্টনের বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দুনিয়ায় সম্পদ বণ্টন নিয়ে অনেক অশান্তির জন্ম হয়েছে। যুগে যুগে সম্পদ বণ্টন নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ইসলাম এ বিষয়ে অতি সুন্দর নীতিমালা নির্ধারণ করেছে। ইসলামী অর্থনৈতিক আদর্শ সম্পদ আহরণ ও বণ্টনে সাম্য ও ন্যায্যতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আমরা যদি কুরআনে ঘোষিত নীতিমালা বিবেচনা করি, তা হলে সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতিতে আমরা অনেক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য জানতে পারি। আর এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ইসলাম দিয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা।
একটি বাস্তবসম্মত অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা : সম্পদ বণ্টনের ইসলামী নীতির প্রথম লক্ষ্য হলো, এর মাধ্যমে দুনিয়াতে এমন একটি নিরপেক্ষ এবং বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা, যার ফলে যে কেউ কোনো বাধা ছাড়াই তার শক্তি-সামর্থ্য, ইচ্ছা ও পছন্দমতো স্বাভাবিকভাবে কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে পারে এবং এতে সে সফলকাম হতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ বণ্টনে অনেক সময় বাইরের পরিবেশ বা শক্তি এটিকে সমতা বা বাস্তবভিত্তিক সম্পন্ন করতে দেয় না। ইসলাম এ ক্ষেত্রে কোনো অপপ্রয়োগের সুযোগ রাখেনি। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে বলেছেন : ‘তোমার রবের রহমত কি এরা বণ্টন করে? আমিই বণ্টন করে রেখেছি তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে এবং তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, যাতে একে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে।’ (সূরা যুখরুফ, ৪৩ : ৩২)।
সম্পদ ব্যক্তি তার খেয়াল-খুশিমতো উপার্জন ও ভোগ করতে পারে না। ইসলাম অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনে উৎসাহিত করে এবং পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে ব্যবসা করার তাগিদ দেয়। আর এই নীতি বাস্তবসম্মত একটি অর্থব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা অবৈধ পন্থায় একে অপরের অর্থসম্পদ ভোগ-ভক্ষণ কর না। তবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে তোমাদের মাঝে লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য হতে পারে।’ (সূরা আন-নিসা, ৪ : ২৯)
একটি বাস্তসম্মত অর্থব্যবস্থার জন্য আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন। কেননা, সুদ জুলুমের অন্যতম হাতিয়ার এবং সুদ অন্যায়-অবিচার এবং শোষণের পথকে প্রসারিত করে। সুদের ফলে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায় এবং সামাজিক কল্যাণ ও অগ্রগতির পথ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই আল্লাহ সুদকে অবৈধ বলেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং অবৈধ করেছেন সুদ।’ (সূরা আল-বাকারা, ২ : ২৯)
ইসলাম এমন এক অর্থ ও লেনদেনের নীতি মেনে চলে যেখানে লেনদেন হতে হবে লিখিত এবং সাক্ষী দ্বারা নিশ্চিত। যাতে অর্থনৈতিক লেনদেন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের মতভেদ বা বিরোধের সৃষ্টি না হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা পরস্পরের মধ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য লেনদেনের (ঋণ দেয়া নেয়ার) ফয়সালা করবে, তখন তার দলিল দস্তাবেজ লিখে নাও। যদি তোমরা ভ্রমণরত থাক আর (ঋণ লেনদেনের দলিল দস্তাবেজ লেখার জন্য) কোনো লেখক না পাও, তবে সাথে সাথে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় এমন বস্তুবন্ধক রেখে কার্য সম্পাদন কর।’ (সূরা আল-বাকার, ২ : ২৮২-২৮৩)
প্রত্যেককে সঠিকভাবে তার প্রাপ্য দেয়া : সম্পদ বণ্টনে ইসলামী নীতির দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, প্রত্যেককে তার ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করা। অন্যান্য অর্থপদ্ধতির চেয়ে ইসলামে সম্পদের এ অধিকার খানিকটা ভিন্ন। বস্তুবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ লাভের একটাই উপায় এবং তা হলো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করা। অর্থাৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেসব উপাদান ক্রিয়াশীল, কেবল তারাই সম্পদে ভাগ বসাতে পারে, অন্য কেউ নয়। বিপরীতপক্ষে, এ ক্ষেত্রে ইসলামের নীতিমালা হচ্ছে, সম্পদের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা নিজে এবং সম্পদ কিভাবে ব্যবহার হবে তার নীতি তিনিই একা নির্ধারণ করেন। তাই ইসলামী নীতি অনুসারে সম্পদ সৃষ্টির সাথে যারা জড়িত তারাই কেবল সম্পদে তাদের অধিকার রাখেন এমন নয়, বরং যাদের সাহায্য করাকে আল্লাহ তাদের ওপর বাধ্যতামূলক করেছেন তারাও এ সম্পদে অধিকার রাখেন।
মানুষের সম্পদে যাদের অধিকার আছে তাদের কয়েকজন হলেন-দরিদ্র, অসহায়, অভাবী, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। সম্পদ যারা গড়েন প্রথমে তারা তাদের অংশ পাওয়ার পর অন্যরা, যাদের সম্পদ দান করার কথা আল্লাহ বলেছেন, তাদের সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ দিতে হবে। এটা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সম্পদশালী মানুষের প্রতি তাঁর নির্দেশ। মহাগ্রন্থ কুরআনের ভাষ্য হচ্ছে : ‘আর তাদের সম্পদে হক নির্ধারিত আছে প্রার্থী-অপ্রার্থী (যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতের) নির্বিশেষে সবার।’ (সূরা মা’আরিজ, ৭০ : ২৪-২৫)
তাই এ কথা স্পষ্ট যে, সম্পদ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পদের মালিক (আহরণকারী হিসেবে) একাই সম্পদে তার অধিকার রাখে না, এই সম্পদে অভাবী ও দরিদ্র মানুষের হকও নির্ধারিত আছে। দুনিয়ায় সব মানুষের ধন-সম্পদ সমান নয়। এখানে একজনকে অপরজনের ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। যার সম্পদ নেই, তাকে সম্পদ দেয়ার জন্য সম্পদশালীদের দায়িত্ব রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের কিছু লোককে অপর কিছু লোকের তুলনায় অধিক জীবিকা দিয়েছেন। যাদের বেশি দেয়া হয়েছে, তারা তাদেরই এই জীবিকা এই ভয়ে তাদের অধীনস্থ ভৃত্যদের প্রতি প্রত্যাবর্তন করাতে চায় না যে, এই জীবিকার ক্ষেত্রে তারা উভয়ই সমান সমান অংশীদার হয়ে যাবে। তা হলে কী আল্লাহর অনুগ্রহই তারা অস্বীকার করছে।’ (সূরা আন-নাহল, ১৬ : ৭১)
‘তোমাদের একজনের চেয়ে আরেকজনকে আল্লাহ যা কিছু বেশি দিয়েছেন, তোমরা তার জন্য লোভ কর না। যা পুরুষরা উপার্জন করেছে, সে অনুযায়ী তাদের অংশ রয়েছে আর যা নারীরা উপার্জন করেছে, সে অনুযায়ী তাদের অংশ নির্দিষ্ট। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রার্থনা কর। অবশ্য আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞান রাখেন।’ (সূরা আন-নিসা, ৪ : ৩২)
ইসলামী অর্থনীতি সমাজের সবার কল্যাণের জন্য কাজ করে। সমাজে যেমন রয়েছে ধনী, সচ্ছল মানুষ, তেমনি রয়েছে অসহায়, ফকির, মিসকিন ও ঋণগ্রস্ত মানুষ। সমাজে আর্থিকভাবে অসহায় ও দুর্বল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের অর্থনৈতিক বিধান উৎকৃষ্ট উদাহরণ স্থাপন করেছে। এ জন্য মহান আল্লাহ জাকাতের বিধান দিয়েছেন। যাতে সম্পদ ধনীদের কাছ থেকে গরিব ও অসহায় মানুষের কাছে স্থানান্তরিত হতে পারে। এ জন্য আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘এসব সদকা (জাকাত) তো আসলে ফকির ও মিসকিনদের জন্য, ওইসব লোকদের জন্য যারা সদকা (জাকাতের) কাজে নিযুক্ত, আর তাদের জন্য যাদের মন জয় করা দরকার। (তা ছাড়া এসব) দাসমুক্ত করা, ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করা, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের খেদমতে ব্যবহার করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা ফরজ। আর আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং তিনি পরম জ্ঞান-বুদ্ধির মালিক।’ (সূরা তওবা, ৯ : ৬০) (চলবে)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা