কুরআনে বর্ণিত স্বৈরশাসকদের করুণ পরিণতি
- মুফতি তাজুল ইসলাম কাওসার
- ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মহান আল্লাহ যুগে যুগে স্বৈরশাসকদের পাকড়াও করেছে। তারা নিজেদের সব ক্ষমতার অধিকারী ভেবে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে জলিুম করেছিল। বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ তাদের এমন দৃষ্টান্ত পেশ করেছে, যাতে পরবর্তীগণ তা থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি কারুন, ফিরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মূসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা ভূমিতে দম্ভ করল, তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি পাথরবাহী প্রচণ্ড ঝড়, কাউকে আঘাত করেছিল বিকট শব্দ, কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো জুলুম করেননি; তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। (আনকাবুত ২৯ : ৩৯-৪০,) কুরআনে বর্ণিত পৃথিবীর ক্ষমতাধর কয়েকজন জালিম শাসকের জুলুম ও তাদের পরিণতি তুলে ধরা হলো।
ফেরাউন : ঐতিহাসিকগণ বলেন, কুরআনে বর্ণিত ফেরাউন বলতে দ্বিতীয় রামসিসকে বোঝানো হয়। তাফসিরে ইবনে কাসিরে তার পূর্ণ নাম ওয়ালিদ ইবনে মুসাইয়্যিব ইবনে রাইয়্যান বলা হয়েছে। এই জালিম শাসকের নাম পবিত্র কুরআনের ২৭ সূরায় ৭৪ বার বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ফেরাউনের আলোচনা যত এসেছে, অন্য কোনো নরপতি সম্পর্কে এত বেশি আলোচনা আসেনি। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, যুগে যুগে ফেরাউনরা আসবে এবং ঈমানদারদের উপরে তাদের জুলুমের ধারা ও বৈশিষ্ট্য একইরূপ। তবে পদ্ধতিগত পরিবর্তন হবে ।
স্বৈরশাসকগণ তাদের পদে অন্য কাউকে ভাবতেই পারে না। আল্লাহ বলেন, ফেরাউন পৃথিবীতে উদ্যত হয়েছিল। (সূরা : ইউনুস ৮৩) সে দাবি করেছিল, আমি তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা। (সূরা : নাযিয়াত- ২৪) অতএব আমি ব্যতীত তোমাদের কোনো উপাস্য আছে বলে আমি জানি না। (সূরা : কাসাস-৩৮)
ফেরাউনের ঔদ্ধত্য ও জুলুম : একবার ফেরাউন স্বপ্ন দেখে। পরে ব্যাখ্যাকারীর মাধ্যমে জানতে পারে, বনি ইসরাইল গোত্রে জন্মগ্রহণকারী এক পুত্রসন্তানের নেতৃত্বে ফেরাউনের রাজত্বের অবসান ঘটবে। তখন ফেরাউন গুপ্তচর লাগিয়ে দেয়, যেন কোনো পুত্রশিশুর জন্ম না হয়। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ফেরাউন জমিনে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সে তার অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের একটি শ্রেণীকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিল, যাদের পুত্রদের সে হত্যা করত ও নারীদের জীবিত রাখত। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। (সূরা : কাসাস ২৮ : ৪) বর্তমানে যেরকম একজন জালিম শাসকের অতিনিকটে কিছু চাটুকার নেতা থাকে ঠিক সেই সময় ফেরাউনের কাছেও কিছু চাটুকার নেতা ছিল । কুরআনের ভাষায়-
ফেরাউন সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ (ফেরাউনকে) বলল, আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে মুক্ত ছেড়ে দেবেন, যাতে তারা (অবাধে) পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদের বর্জন করতে পারে? সে বলল, আমরা তাদের পুত্রদের হত্যা করব এবং তাদের নারীদের জীবিত রাখব, আর তাদের ওপর আমাদের পরিপূর্ণ ক্ষমতা আছে। (সূরা : আরাফ ৭ : ১২৭)
ফেরাউন ও সৈন্যদের পরিণতি : ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখো, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা : কাসাস ২৮ : ৩৯-৪০)
আমি বনী ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফিরাউন ও তার বাহিনী জুলুম ও সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাৎধাবন করল। পরিশেষে যখন সে ডুবে মরার সম্মুখীন হলো, তখন বলতে লাগল, আমি স্বীকার করলাম, বনি ইসরাইল যেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমিও অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (উত্তর দেয়া হলো) এখন ঈমান আনছ? অথচ এর আগে তো তুমি অবাধ্যতা করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীকালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। (কেননা) আমার নিদর্শন সম্পর্কে বহু লোক গাফেল হয়ে আছে। (সূরা : ইউনুস ১০ : ৯০-৯২)
লোহিত সাগরসংলগ্ন তিক্ত হ্রদে ফেরাউন সৈন্যসহ ডুবে মরে, যার মমি ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে জাবালে ফেরাউন নামে একটি ছোট পাহাড় আছে। এখানেই ফেরাউনের লাশ প্রথম পাওয়া যায় বলে জনশ্রুতি আছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে, থেপ্স নামক স্থানে সমাধি মন্দিরে ১৮৯৬ সালে একটি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ স্যার ক্র্যাফো ইলিয়াট মমিকরণের কলাকৌশল অনুসন্ধান করেন। এভাবে তিনি ৪৪টি মমি পরীক্ষা করে অবশেষে ১৯০৭ সালে তিনি ফেরাউনের লাশ শনাক্ত করেন। ওই সময় তার লাশের ওপর লবণের এমন স্তর জমেছিল যে যা দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়। এ কারণ, অন্য কোনো মমির দেহে অনুরূপ লবণ পাওয়া যায়নি। ওই লবণের স্তর যে সাগরের লবণাক্ত পানি তা পরিষ্কার হয়ে যায়। ৩ হাজার ১১৬ বছরের অধিককাল ফেরাউনের লাশ সংরক্ষিত থাকে। কুরআনের একটি আয়াতেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমার দেহ সংরক্ষণ করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীকালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো...।’ (সূরা ইউনুস : ৯২, আলা-জাওয়াহির ফি তাফসিরুল কুরআন কারিম দ্র: ৬/৮৪ পৃষ্ঠা)
কারুন ও তার পরিণতি : কারুন ছিল মূসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি।
কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল। আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলো বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। স্মরণ করো, তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না, নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না। ... সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি। সে কি জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতেও তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং লোকবলেও বেশি ছিল? অপরাধীদের তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না। পরিণামে আমি তাকে তার প্রাসাদসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। তার সপক্ষে এমন কোনো দল ছিল না যারা আল্লাহর শাস্তি থেকে তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে। ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সব লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকিদেরই অনুকূলে থাকবে। (সূরা : কাসাস ২৮ : ৭৬,৭৮,৮১,৮৩)
নমরুদের পরিণতি : পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতাপশালী শাসকদের একজন হলো নমরুদ। প্রায় পুরো পৃথিবী শাসনকারী চারজন পরাক্রমশালী শাসকের একজন মনে করা হয় তাকে। পৃথিবীতে সে-ই প্রথম নিজেকে খোদা দাবি করে। প্রজাদের সে নিজের উপাসনা করতে বাধ্য করে। হজরত ইবরাহিম আ: তাকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিলে বেশ ক্ষিপ্ত হয় এবং তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেয়। কিন্তু ইবরাহিম আ:-এর জন্য আগুন শীতল হয়ে যায় এবং তিনি বেঁচে যান। নমরুদের ঔদ্ধত্য এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, সে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা ক্ষুদ্র মশা দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে তার অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘনের পরিণতির কথা এসেছে। ইরশাদ হয়েছে-
তুমি কি ঐ ব্যক্তির অবস্থা চিন্তা করনি, যাকে আল্লাহ রাজত্ব দান করার কারণে সে নিজ প্রতিপালকের (অস্তিত্ব) সম্পর্কে ইবরাহিমের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়? যখন ইবরাহিম বলল, তিনি আমার প্রতিপালক যিনি জীবনও দান করেন এবং মৃত্যুও ঘটান। তখন সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহিম বলল, আচ্ছা, আল্লাহ তো সূর্যকে পূর্ব থেকে উদিত করেন, তুমি তা পশ্চিম থেকে উদিত কর তো! এ কথায় সে নিরুত্তর হয়ে গেল। আর আল্লাহ এরূপ জালিমদের হেদায়াত করেন না। (সূরা : বাকারা ২ : ২৫৮)
পৃথিবীতে আল্লাহর সাথে প্রথম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকারী ছিল নমরুদ। সে-ই আসমান অভিমুখে টাওয়ার নির্মাণ করেছিল। আল্লাহ তাকে শায়েস্তা করার জন্য একটি মশা পাঠান। সেটি তার নাকে প্রবেশ করে। মশার জ্বালা থেকে বাঁচার জন্য তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হতো। তার রাজত্ব ছিল চারশত বছর। সে যেমন চারশত বছর পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল তেমনি আল্লাহ তাকে চারশত বছর এই আজাবে রাখেন। এরপর সে মৃত্যুবরণ করে। (তাফসিরে ইবনে কাসির ২/৮৭৮)
বাস্তবিকই আল্লাহর পাকড়াও অতি মর্মন্তুদ, বড় কঠিন! যে ব্যক্তি আখেরাতের শাস্তিকে ভয় করে, তার জন্য এসব বিষয়ের মধ্যে বিরাট শিক্ষা রয়েছে। তা হবে এমন দিন, যার জন্য সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে এবং তা হবে এমন দিন, যা সবাই চাক্ষুষ দেখতে পাবে। আমি নির্দিষ্ট কিছু কালের জন্য তা স্থগিত রেখেছি মাত্র। (হূদ ১১: ১০২-১০৪)
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদের সূরা আল ইমরানের ১৭৮ নম্বর আয়াতে বলেন-অবিশ্বাসীরা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, আমি তাদের যে সুযোগ দিয়েছি, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুত, আমি তাদের এজন্য সুযোগ দিয়েছি, যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়। আর তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।
লেখক : প্রবন্ধকার ও আলেম
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা