১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩ মাঘ ১৪৩১, ১৬ রজব ১৪৪৬
`

আল্লাহর দিকে ফিরে এলে

-

আল্লাহর দিকে ফিরে এলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগৎ সমৃদ্ধশালী হয়। অনেকের ধারণা, যারা আল্লাহভীতি, সততা, সাধুতা ও দায়িত্বানুভূতির পথ অবলম্বন করে তারা আখিরাতের জীবন লাভ হলেও হতে পারে কিন্তু দুনিয়ার জীবন একেবারেই বরবাদ হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে এ মন্ত্র কেবল শয়তান দুনিয়ার মোহে মুগ্ধ অজ্ঞ-নির্বোধের কানে ফুঁকে দেয়। এ সঙ্গে তাকে এ প্ররোচনাও দেয় যে, এ ধরনের আল্লাহভীরু ও সৎলোকদের জীবনে দারিদ্র্য, অভাব ও অনাহার ছাড়া আর কিছুই নেই। আল্লাহ তায়ালা এ ধারণার প্রতিবাদ করে বলেন- ‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন। তবে যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ দিনের আজাবের ভয় করছি।’ (সূরা হুদ-৩)
অর্থাৎ এ সঠিক পথ অবলম্বন করলে তোমাদের শুধু আখিরাতেই নয়, দুনিয়াও সমৃদ্ধ হবে। আখিরাতের মতো এ দুনিয়ায় যথার্থ মর্যাদা ও সাফল্যও এমনসব লোকের জন্য নির্ধারিত যারা আল্লাহর প্রতি যথার্থ আনুগত্যসহকারে সৎ জীবনযাপন করে, যারা পবিত্র ও ত্রুটিমুক্ত চরিত্রের অধিকারী হয়, যাদের ব্যবহারিক জীবনে ও লেনদেনে কোনো ক্লেদ ও গ্লানি নেই, যাদের ওপর প্রতিটি বিষয়ে ভরসা কার যেতে পারে, যাদের থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি কল্যাণের আশা পোষণ করে এবং কোনো ব্যক্তি বা জাতি যাদের থেকে অকল্যাণের আশঙ্কা করে না।
আল কুরআনের দৃষ্টিতে দুনিয়ার জীবনসামগ্রী দুই প্রকারের। একপ্রকারের জীবনসামগ্রী আল্লাহবিমুখ লোকদেরকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করার জন্য দেয়া হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে তারা নিজেদেরকে দুনিয়া পূজা ও আল্লাহ বিস্মৃতির মধ্যে আরো বেশি করে হারিয়ে যায়। আপাত দৃষ্টিতে এটি নিয়ামত ঠিকই কিন্তু গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে এটি আল্লাহর লানত ও আজাবের পটভূমিই রচনা করে। আল কুরআনে এটি প্রতারণার সামগ্রী নামেও একে উল্লেøখ করে। আর দ্বিতীয় প্রকারের সামগ্রী মানুষকে আরো বেশি সচ্ছল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তাকে তার আল্লাহর আরো কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত করে। এভাবে সে আল্লাহর, তাঁর বান্দাদের এবং নিজের অধিকার আরো বেশি করে আদায় করতে সক্ষম হয়। আল্লাহর দেয়া উপকরণাদির সাহায্যে শক্তি সঞ্চয় করে সে দুনিয়ায় ভালো, ন্যায় ও কল্যাণের উন্নয়ন এবং মন্দ, বিপর্যয় ও অকল্যাণের পথ রোধ করার জন্য এর বেশি প্রভাবশালী ও কার্যকর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ হচ্ছে কুরআনের পরিভাষায় উত্তম জীবনসামগ্রী; অর্থাৎ এমন উন্নত পর্যায়ের জীবনসামগ্রী যা নিছক দুনিয়ার আয়েশ আরামের মধ্যে খতম হয়ে যায় না; বরং পরিণামে আখিরাতেরও শান্তির উপকরণে পরিণত হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পুরুষ বা নারী যে-ই সৎকাজ করবে, সে যদি মুমিন হয়, তাহলে তাকে আমি দুনিয়ায় পবিত্র পরিচ্ছন্ন জীবন দান করব এবং (আখিরাতে) তাদের প্রতিদান দেবো তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুসারে।’ (সূরা আন নাহল-৯৭) এ আয়াতেও মুমিন ও কাফের উভয় দলের এমন সব সঙ্কীর্ণচেতা ও বেখবর লোকদের ভুল ধারণা দূর করা হয়েছে, যারা মনে করে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতার পথ অবলম্বন করলে মানুষের পরকালে সাফল্য অর্জিত হলেও তার পার্থিব জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের জবাবে আল্লাহ বলছেন, ‘তোমাদের এ ধারণা ভুল। এ সঠিক পথ অবলম্বন করলে শুধু পরকালীন জীবনই সুগঠিত হয় না, দুনিয়াবি জীবনও সুখী-সমৃদ্ধশালী হয়। যারা প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ও সৎ তাদের তাদের পার্থিব জীবন ও বেঈমান ও অসৎকর্মশীল লোকদের তুলনায় সুস্পষ্টভাবে ভালো ও উন্নত হয়। নিজেদের নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের কারণে তারা যে প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে তা অন্যরা লাভ করতে পারে না। যেসব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও উত্তম সাফল্য তারা লাভ করে থাকেন তাও অন্যরা লাভ করতে পারে না। কারণ অন্যদের প্রতিটি সাফল্য হয় নোংরা ও ঘৃণিত পদ্ধতি অবলম্বনের ফসল। সৎ লোকেরা ছেঁড়া কাঁথায় শয়ন করেও যে মানসিক প্রশান্তি ও চিন্তার স্থৈর্য লাভ করেন তার সামান্যতম অংশও প্রাসাদবাসী বেঈমান দুষ্কৃৃতিকারী লাভ করতে পারে না।
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি এই যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবনসামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন।’ অর্থাৎ দুনিয়ায় তোমাদের অবস্থান করার জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে সে সময় পর্যন্ত তিনি তোমাদের খারাপভাবে নয় ভালোভাবেই রাখবেন। তাঁর নিয়ামতগুলো তোমাদের ওপর বর্ষিত হবে। তাঁর বরকত ও প্রাচুর্য লাভে তোমরা ধন্য হবে। তোমরা সচ্ছল ও সুখী-সমৃদ্ধ থাকবে। তোমাদের জীবন শান্তিময় ও নিরাপদ হবে। তোমরা লাঞ্ছনাম হীনতা ও দ্বীনতার সাথে নয়; বরং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করবে।
যে ব্যক্তি চরিত্রগুণে ও নেক আমলে যত বেশি এগিয়ে যাবে আল্লাহ তাকে ততই বড় মর্যাদা দান করবেন। আল্লাহর দরবারে কারোর কৃতিত্ব ও সৎকাজকে নষ্ট করা হয় না। তাঁর কাছে যেমন অসৎকাজ ও অসৎবৃত্তির কোনো মর্যাদা নেই তেমনি সৎকাজ ও সৎবৃত্তিরও কোনো অমর্যাদা হয় না। এটি মহান আল্লাহর রাজ্যের রীতি নয়। যে ব্যক্তিই নিজের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে যেরূপ মর্যাদার অধিকারী প্রমাণ করবে তাকে আল্লাহ সে মর্যাদা অবশ্যই দেবেন। তাদের মর্যাদা তাদের সর্বোত্তম কর্মের প্রেক্ষিতে নির্ধারিত হবে। অন্য কথায়, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় ছোট-বড় সব রকমের সৎকাজ করে থাকবে তাকে তার সবচেয়ে বড় সৎকাজের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চতর মর্যাদা দান করা হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জনপদের লোকেরা যদি ঈমান আনত এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতগুলোর দুয়ার খুলে দিতাম।’ (সূরা আরাফ-৯৬) আসমান ও জমিনের সব বরকত খুলে বলতে সব রকম কল্যাণ সব দিক থেকে খুলে দেয়া। তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সময়ে আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হতো, আর জমিন থেকে যেকোনো বস্তু তাদের মনমতো উৎপাদিত হতো এবং সেসব বস্তু দ্বারা তাদের লাভবান হওয়া এবং সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দেয়া হতো। তাতে তাদেরকে এমন কোনো চিন্তাভাবনা কিংবা টানাপড়েনের সম্মুখীন হতে হতো না। দুনিয়ায় বরকতের বিকাশ ঘটে বিভিন্নভাবে। কখনো মূল বস্তুটি প্রকৃতভাবেই বেড়ে যায়। কখনো মূল বস্তুটি ব্যতিরেকে এমন মূল্যবান জিনিস তাকে দেয়া হয়, যা তার অত্যন্ত কাক্সিক্ষত এবং সেটি কখনো সে চায়নি। কখনো বর্তমান সম্পদ বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে বরকত দেয়া হয়। সে সময় সে অল্প টাকা দিয়ে যেই কাজ সম্পাদন করতে পারে অন্যজন তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সম্পদ দিয়েও তা সম্পাদন করতে পারে না। এই জন্য আল্লাহর রাসূল দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফিমা আতাইতা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে যা দিয়েছ তাতে বরকত দান করো। মনে করুন, আপনারা দু’জন ঘর থেকে বের হলেন, দরজার কাছে দু’জনই পায়ে আঘাত পেলেন এবং দু’জনই ডাক্তারি পরীক্ষা করে দেখলেন, একজন সামান্য আঘাত পেয়েছে এবং প্রাথমিক চিকিৎসায় সেরে উঠলেন। অন্যজন মারাত্মক আঘাত পেয়ে অপারেশন করে দীর্ঘ দিন পরে সেরে উঠলেন। একজনের মাত্র কয়েক টাকা খরচ হলো, অন্যজনের লাখ লাখ টাকা ও সময় খরচ হয়ে গেল। এগুলোই হলো বরকতের বিভিন্ন ধরন।
তবে তাদেরকে রকমারি দুর্যোগ, দুর্বিপাক ও বিপদের মুখেও ঠেলে দেয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বাণিজ্যিক ক্ষয়ক্ষতি, সামরিক পরাজয় ও এ ধরনের আরো নানান দুর্ভোগ চাপিয়ে দেয়া হয় যাতে তাদের মন নরম হয়, অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্যের দৃপ্ত গ্রীবা নত হয়, শক্তিমত্ততা ও ধনলিপ্সা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। নিজের উপায়-উপকরণ, শক্তি ও যোগ্যতার ওপর নির্ভরতা ভেঙে পড়ে এবং তারা যাতে অনুভব করতে পারে যে, ওপরে অন্য কোনো শক্তিধর সত্তা আছে এবং তাঁরই হাতে রয়েছে তাদের ভাগ্যের লাগাম। এভাবে উপদেশের বাণী শোনার জন্য তাদের কান খুলে যাবে এবং নিজেদের প্রভু পরওয়ারদিগারের সামনে সবিনয়ে শির আনত করার জন্য তারা প্রস্তুত হয়ে যাবে। এ জন্য একটি হাদিস থেকে জানা যায় যে, ‘বিপদ-মুসিবত তো মুমিনকে পর্যায়ক্রমে সংশোধন করতে থাকে, অবশেষে যখন সে এ চুল্লি থেকে বের হয়, তখন তার সমস্ত ভেজাল ও খাদ পুড়ে সে পরিচ্ছন্ন ও খাঁটি হয়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু মুনাফিকের অবস্থা হয় ঠিক গাধার মতো। সে কিছুই বোঝে না, তার মালিক কেন তাকে বেঁধে রেখেছিল, আবার কেনই বা তাকে ছেড়ে দিলো।’


আরো সংবাদ



premium cement