১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`

মহানবী সা:-এর আদর্শ

-

(গতকালের পর)
মুহাম্মদ সা: ছিলেন সর্বাধিক কোমল প্রাণের অধিকারী এবং নিরহঙ্কারী। বিনয় ও নম্রতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। মুহাম্মদ সা: ছিলেন সর্বাধিক লাজুক প্রকৃতির। লজ্জাশীলতা ও আত্মসম্মান এত প্রবল ছিল যে, দৃষ্টি সর্বদা নিচু করে রাখতেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ সা: ছিলেন পর্দানসিন কুমারী মেয়ের চেয়েও অধিক লজ্জাশীল। কোনো কিছু তার পছন্দ না হলে চেহারা দেখে বোঝা যেত।’ (বুখারি)
তিনি নিজের জীবন থেকে তিনটি বিষয়কে সম্পূর্ণ দূর করে দিয়েছিলেন। যেমন- পরস্পর কূটতর্ক করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা এও লক্ষ্যহীন কোনো কিছুর পেছনে লেগে থাকা। অন্য লোকদের ক্ষেত্রেও তিনি তিনটি বিষয়ে সংযমী ছিলেন। কাউকে মন্দ বলতেন না, কাউকে দোষারোপ করতেন না এবং কারো অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকতেন না। যে কথা মানুষের কল্যাণকর তা-ই বলতেন। মোটকথা, সর্বোত্তম আদর্শের সমাহার ছিল তাঁর জীবনে। মুহাম্মদ সা: নিজে যেমন উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিলেন ঠিক তেমনি অন্যদের উত্তম চরিত্রবান হওয়ার নির্দেশনা দিতেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনদের মধ্যে তার ঈমান পরিপূর্ণ, যার চরিত্র সর্বোৎকৃষ্ট এবং যে তার স্ত্রী-পরিবারের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল।’ (তিরমিজি-২৬১২)
বস্তুত বিশ্বের সব মানুষের আদর্শ হিসেবে তিনি পৃথিবীতে আবিভূর্র্ত হয়েছিলেন। মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শ ছিল সবার জন্য অনুকরণীয় ও অতুলনীয়। শিক্ষিত ও উন্নত জাতির জন্য এমন আদর্শের প্রয়োজন, সর্বজনীন। সুতরাং মুসলিম নারী-পুরুষ সবাইকে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শের অনুসারী হতে হবে। পৃথিবীর সব মানুষ ও সব কিছুর ওপর তাঁর আদর্শকে স্থান দিয়ে সেই অনুযায়ী জীবন চালাতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে নবী, আপনি লোকদের বলে দিন, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে তোমরা আমাকে অনুসরণ করো। তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা আলে ইমরান-৩১)
তাই যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সা:-কে অনুসরণ করল সে মূলত আল্লাহকেই অনুসরণ করল। বস্তুত একমাত্র রাসূল সা:-এর আনুগত্য ও অনুকরণের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি, মুক্তি ও হেদায়েত পাওয়া সম্ভব। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো।’ (সূরা আনফাল-১) এতেই রয়েছে দুনিয়াবি শান্তি ও পরকালীন মুক্তি এবং নাজাত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘যারা আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হবে জান্নাতেও তারা রাসূলের সাথে থাকবে। তাদের ওপর আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। আর তারা হলেন নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দারা। সঙ্গী হিসেবে তারা কতই না চমৎকার।’ (সূরা নিসা-৬৯)
কাজেই আল্লাহর নির্দেশ পালন করার সঙ্গে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আদেশও পালন করতে হবে এবং নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে মুহাম্মদ সা:-এর সুন্নাত পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় উম্মতের প্রতি রাসূল সা:-এর সব নির্দেশ, সমর্থন, কর্ম ও আচরণকে আমরা সুন্নত বলে জানি। আর এই সুন্নাতগুলোকে নিজেদের জীবনে ধারণ ও পালন করার অর্থই হলো নবীর সুন্নাতের অনুসারী হওয়া বা এককথায় রাসূল সা:-এর অনুসারী হওয়া। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নাত অনুসরণ করবে। তোমরা তা কঠিনভাবে অঁাকড়ে ধরো এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরো। আর তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় সৃষ্টি করা থেকে সাবধান থাকো। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদয়াত এবং প্রত্যেক বিদয়াতই হলো ভ্রষ্টতা।’ (আবু দাউদ-৪৬০৭)
রাসূল সা: বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি ফেতনা-ফ্যাসাদের জামানায় সুন্নাতের ওপর অবিচল থাকবে, সে শত শহীদের সাওয়াব পাবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতের হেফাজত (পালন) করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে হিফাজত করবেন এবং চারটি জিনিস দ্বারা তাকে সম্মানিত করবেন। যথা- ১. সব নেককার লোকের অন্তরের মধ্যে তার মহব্বত সৃষ্টি করে দেবেন; ২. গুনাহগারদের অন্তরের মধ্যে তার ভয় ঢুকিয়ে দেবেন; ৩. রিজিকের প্রশস্ততা দান করবেন এবং ৪. দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করবেন।’ রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অনুসরণ করে, তারাই মূলত আমাকে ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালোবাসবে সে অবশ্যই আমার সাথে জান্নাতে প্রতিবেশী হবে।’ (আল হাদিস) সুতরাং তাঁকে ভালোবাসতে হবে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। যার ভেতর মুহাম্মদ সা:-এর ভালোবাসা থাকবে না, সে কোনো দিন প্রকৃত মুমিন হতে পারে না। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হবো।’ (বুখারি-১৫) পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয়।’ (সূরা আহজাব-৬) সাহাবিদের মনে ছিল রাসূল সা:-এর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা। তারা রাসূল সা:-কে মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাদের পুরো জীবনই ছিল নবী প্রেমের প্রতিচ্ছবি। ইবাদত-বন্দেগি, লেনদেন, চলাফেরা, আখলাক-চরিত্র থেকে শুরু করে জীবনের সর্বত্রই ছড়িয়েছিল তার সুন্নাতের জ্যোতি। নবী প্রেম তাদের জীবন-জগতকে করেছিল জ্যোতির্ময়। নবী প্রেমের যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করে গেছেন, মানব ইতিহাসে সেটির দৃষ্টান্ত নেই। রাসূল সা:-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসার ঘটনাবলি হাদিস, সিরাত ও ইতিহাসের কিতাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। রাসূল সা:-কে সাহাবায়ে কেরামের মতো ভালোবেসে আমরাও হতে পারি সৌভাগ্যশালী আলোকিত মানুষ।
লেখক : সম্পাদক, মাসিক সারস, পূর্ব রূপসা, খুলনা


আরো সংবাদ



premium cement