০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ৮ রজব ১৪৪৬
`

ওলামাদের অনৈক্য : কারণ ও সমাধান

-

আলেম-ওলামাদের ঐক্যের বিকল্প নেই, ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। আলেম-ওলামা ঐক্যবদ্ধ হলে মুসলিম সমাজও এক হয়ে যাবে, সমাজে শান্তি আসবে। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে (দ্বীন ইসলাম) দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভেদ করো না। স্মরণ করো যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে তখন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তোমাদের অন্তরসমূহ একে অপরের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছ। তোমরা তো ছিলে অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের মুক্ত করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর বিধানসমূহ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হও’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩)।
আলেম-ওলামাদের অনৈক্যের মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে একে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ। তারা একে অন্যের জনপ্রিয়তাকে মানতে নারাজ। নিজেদের বিবাদ, বিশৃঙ্খলা, পরস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সামান্য স্বার্থের কারণে তারা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, প্রত্যেকেই এক একজন নেতা হয়ে নামে-বেনামে অসংখ্য দল ও উপদল গড়ে তুলে। আবার তারাও হীন স্বার্থ, পদ-পদবি ও পার্থিব বিষয়কে কেন্দ্র করে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে। আর অল্প সময়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, তাদের দল ও ঐক্য। ফলে তাদের অনৈক্য, দলাদলি, গ্রুপিং ইসলাম বিরোধীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
কুরআনুল কারিমে এসেছে- ‘নিশ্চিত এই তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহিদের উম্মাহ) এবং আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমাকে ভয় করো। এরপর তারা নিজেদের দ্বীনের মধ্যে বিভেদ করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। প্রত্যেক দল (নিজেদের খেয়ালখুশি মতো) যে পথ গ্রহণ করল তাতেই মত্ত রইল। সুতরাং (হে পয়গম্বর!) তাদেরকে এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত মূর্খতায় ডুবে থাকতে দিন’ (সূরা মুমিনুন: ৫২-৫৩)।
কুরআনুল কারিমে আরো এসেছে- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। পরস্পর বিবাদ করো না, তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চিত জেনে রেখো, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’ (সূরা আনফাল -৪৬)।
কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যে যেন এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে। আর এরাই তো সফলকাম।’
‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল এবং মতভেদ করেছিল তাদের নিকট সুস্পষ্ট বিধানসমূহ পেঁৗছার পর। এদের জন্যই রয়েছে ভীষণ শাস্তি’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪-১০৫)।
একজন আলেম যদি সত্য কথা, কুরআন-হাদিসের কথা বলেন, তাহলে সেটি সবার মেনে নিতে হবে। তবে ঐক্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও অন্যের কথা শোনার মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। একই সাথে অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখতে হবে। এতে হতে পারে আলেম সমাজের ঐক্য।
কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যাকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারীও যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যে নারীকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। ঈমানের পর ফিসকের নাম যুক্ত হওয়া কত মন্দ! যারা এসব থেকে বিরত হবে না তারাই জালেম।’
‘হে মুমিনগণ! অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারো গোপন ত্রুটি অনুসন্ধান করবে না এবং একে অন্যের গিবত করবে না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটি তো তোমরা ঘৃণা করে থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় তিনি বড় তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু’ (সূরা হুজুরাত : ১১-১২)।
হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা। তোমরা অঁাড়ি পেতো না, গোপন দোষ অন্বেষণ করো না, স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, সম্পর্কচ্ছেদ করো না, পরস্পর কথাবার্তা বন্ধ করো না, একে অপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিও না, দাম-দস্তুরে প্রতারণা করো না এবং নিজের ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না।
হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহ যেমন আদেশ করেছেন, সবাই তোমরা আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও’ (বুখারি : ৫১৪৩, ৬০৬৪, ৬০৬৫; মুসলিম : ২৫৬৩/২৮, ২৯, ৩০ ও ২৫৬৪/৩২, ৩৩)।
হাদিস শরিফে আরো এসেছে, হজরত আবু বারজা আল আসলামি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, ‘ওহে যারা মুখে মুখে ঈমান এনেছ কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি তারা শোনো, মুসলমানের গিবত করো না এবং তাদের দোষত্রুটি অন্বেষণ করো না। কারণ যে তাদের দোষ খুঁজবে স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ খুঁজবেন। আর আল্লাহ যার দোষ খুঁজবেন তাকে তার নিজের ঘরে লাঞ্ছিত করবেন’ (মুসনাদে আহমাদ-১৯৭৭৬; আবু দাউদ-৪৮৮০)।
রাসূল সা: অন্য এক হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিম সে, যার মুখ ও হাত থেকে সব মুসলিম নিরাপদ থাকে’ (বুখারি-১০)।
আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখরা রাষ্ট্রের সব স্তরেই দায়িত্ব পালন করবেন। কেউ থাকবেন জিহাদের ময়দানে, কেউ দাওয়াতের ময়দানে। আলেম-ওলামাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য, আত্মশুদ্ধি তাহলেই হতে পারে আলেম-ওলামাদের মধ্যে ঐক্য।
লেখক : সংগঠক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement