১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

ইসলামে রাষ্ট্র গঠনের মূলনীতি

-

ইসলামে রাষ্ট্র গঠন একটি পূর্ণাঙ্গ ও ধর্মীয়ভিত্তিক প্রক্রিয়া, যা আল্লাহর বিধান, শরিয়াহ, কুরআন ও হাদিসের আলোকে পরিচালিত হয়। সাধারণত মনে করা হয় ইসলাম একটি ধর্ম মাত্র এবং ইসলামী শরিয়ত কেবলমাত্র নৈতিক চরিত্র ও আল্লাহর সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক স্থাপনের নিয়ম-বিধানই পেশ করে। এ ছাড়া মানবজীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ইসলামের কিছুই বলার নেই। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে ইসলাম একেবারেই নীরব এবং সে পর্যায়ে মুসলমানরা যে কোনো নীতি বা আদর্শ গ্রহণে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান তাই ইসলামে রয়েছে রাষ্ট্র গঠনের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা ।
ইসলামে রাষ্ট্র গঠনের মূলনীতিগুলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, যার মধ্যে রয়েছে :
১. আল্লাহর শাসন (তাওহিদ)
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান ভিত্তি হলো তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ। ইসলাম বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো শাসক বা সর্বশক্তিমান নেই। রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম আল্লাহর বিধান অনুসারে পরিচালিত হতে হবে। শাসক বা নেতারা কেবল আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন এবং তাদের শাসনব্যবস্থা আল্লাহর কুরআন ও হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
২. শরিয়াহ আইন
ইসলামী রাষ্ট্রে আইন ও বিচারব্যবস্থা শরিয়াহভিত্তিক (ইসলামী আইন) হবে। শরিয়াহ হলো কুরআন, হাদিস, ইজমা (উম্মতের ঐকমত্য) এবং কিয়াস (অনুরূপ সমস্যার জন্য যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত) দ্বারা প্রণীত আইন। এই আইন রাষ্ট্রের সব স্তরে কার্যকর হবে এবং এটি ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে পরিচালিত করবে। ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো আইন শরিয়াহর বিরুদ্ধে যেতে পারে না।
৩. ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা
ইসলামী রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলো ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা। কুরআনে বারবার ন্যায়বিচারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং শাসক বা সরকারকে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একটি ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জান, মাল, ঈমান ও সম্মান রক্ষা করা। আল্লাহ বলেন :
‘তোমরা পরস্পরের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকো’ (সূরা আশ-শুরা : ৩৮)।
৪. জনগণের মতামত (শূরা)
ইসলামী রাষ্ট্রে শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। যদিও ইসলামী শাসক আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করবেন, তবে তিনি জনগণের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। এর ফলে শাসক জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং জনগণের মধ্যে স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। ‘তাদের কাজকর্ম পরামর্শের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়’ (সূরা শূরা : ৩৮)।
৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা
ইসলামী রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের মানুষের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। ইসলামে সব ধর্মের প্রতি সহনশীলতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে : ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই’ (সূরা বাকারা : ২৫৬)। এটি বোঝায় যে, মুসলিম রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষিত থাকবে এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে বাধা দেয়া হবে না।
৬. শাসকের ন্যায্যতা ও দায়িত্ব
ইসলামে শাসককে আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং তাকে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে হবে। শাসককে অবশ্যই ন্যায় এবং সততার সাথে কাজ করতে হবে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকতে হবে। ইসলামী শাসকরা তাদের সিদ্ধান্তে সদাচরণ করবেন এবং ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকে তাদের কর্তব্য পালনে তাদের কাছে কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না।
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করব’ (সূরা নূর : ৫৫)।
৭. অর্থনৈতিক নীতি : বৈষম্যহীনতা ও সহানুভূতি
ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিও শরিয়াহ দ্বারা পরিচালিত হবে, যা সমাজে বৈষম্যহীনতা ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করবে। ইসলাম মানুষের অধিকার ও সম্পদ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন এবং সমাজে গরিব, দুঃখী ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের সহায়তা করতে নির্দেশ দিয়েছে।
জাকাত (আল্লাহর পথে দান) হলো এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা ধনীর সম্পদ থেকে গরিবদের সহায়তা করার জন্য আদায় করা হয়। সুদ (রিবা) নিষিদ্ধ, যাতে অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য রোধ করা হয়।
৮. মানবাধিকার সুরক্ষা
ইসলাম মানবাধিকারের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক মানুষের জীবন, সম্পদ, সম্মান এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে। ইসলামে নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
শেষ কথা হলো- ইসলামে রাষ্ট্র গঠন একটি আল্লাহর বিধান অনুসারে পরিচালিত ব্যবস্থা, যেখানে শরিয়াহ, ন্যায়, কল্যাণ, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো আল্লাহর বিধান অনুসারে একটি ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। ইসলাম যে রাষ্ট্র গঠনের মডেল দেয় তা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য পরামর্শ, অংশগ্রহণ এবং ইসলামী মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে।
লেখক : শিক্ষার্থী, মারকাজুদ দিরাসাহ আল-ইসলামিয়াহ, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement