নামাজে খুশু-খুজু অর্জনের উপায়
- মো: আবদুর রহমান
- ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
খুশু-খুজু বা বিনয় ও নম্রতা হচ্ছে নামাজের প্রাণ। নামাজের যাবতীয় ফজিলত, প্রভাব ও উপকারিতা এই খুশু-খুজুর সাথেই সম্পৃক্ত। খুশু-খুজুর সাথে নামাজ আদায় করলে নামাজ সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়। আর খুশু-খুজুবিহীন নামাজ প্রাণহীন-আত্মাহীন লাশের মতো। তাই নামাজে খুশু-খুজু অবলম্বন করা একজন মুমিন বান্দার জন্য একান্ত আবশ্যক।
নামাজে খুশু-খুজুর গুরুত্ব : ইসলামী শরিয়তে খুশুর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের জন্য খুশু তথা একাগ্রতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমানে এই ব্যস্ত যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ একাগ্রতাহীন নামাজ দায়সারা ও শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা ব্যতীত তেমন কিছুই বয়ে আনে না। আল্লাহর কাছে এমন নামাজের মূল্য নেই। এসব নামাজিকে আল্লাহ তায়ালা নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন এবং শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন।’ (সূরা মাউন : ৪-৫)
নিফাকি খুশু : একজন মানুষ যখন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে খুশু ধারণ করে অথচ তার অন্তর খুশু থেকে খালি থাকে, তখন সে নিফাকি খুশুর শিকারে পরিণত হয়। নিফাকি খুশু নিন্দনীয়। খুশুতে যেন নিফাকি চলে না আসে সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের উত্তরসূরিরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকতেন। হুজায়ফা রা: বলতেন, ‘তোমরা নিফাকি খুশু থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।’ তার কাছে জিজ্ঞেস করা হলো নিফাকি খুশু কী? উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটি হচ্ছে নামাজের বাইর থেকে দেখতে তোমাকে খুব বিনয়ী ও মনোযোগী মনে হবে কিন্তু তোমার অন্তরের অবস্থা থাকবে সম্পূর্ণ উল্টো।’
হজরত আবু দারদা রা: থেকেও এমন একটি হাদিস বর্ণিত আছে যে, খুশু-খুজুর নিফাক হলো এই- ‘বাহ্যিকভাবে দেহ শান্ত-নম্র এবং বুঝা যায় খুশু-খুজু আছে। কিন্তু বাস্তবে তার অন্তরে খুশু-খুজু নেই।’
হজরত কাতাদাহ রা: বলেন, ‘অন্তরের খুশু-খুজু হলো আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত করা এবং নামাজের সময় দৃষ্টিকে অবনত রাখা।’ (দুররুল মানসুর-৬/৮৪)
ফুজায়েল ইবনে আয়াদ রহ: বলেন, ‘অতীতকালে অন্তরে বিদ্যমান একাগ্রতার চেয়ে বেশি খুশু প্রদর্শন করা ঘৃণার চোখে দেখা হতো।’
হজরত উমর রা: একবার এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে মাথা খুব নিচু করে নামাজ আদায় করছে। তিনি বললেন, ‘হে মাথানতকারী, মাথা উঠাও। অন্তরে যে পরিমাণ খুশু-খুজু আছে তার বেশি প্রকাশ করো না।’
সুতরাং যে ব্যক্তি অন্তরের খুশু-খুজুর বেশি খুশু-খুজু প্রকাশ করবে সে-ই নিফাকি খুশু-খুজুতে লিপ্ত হলো।
প্রকৃত খুশু ও নিফাকি খুশুর মধ্যে পার্থক্য :
নিফাকি খুশু : ক. হৃদয় কামনা-বাসনায় ভরপুর থাকে; খ. শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনয়ী হলেও হৃদয়ে আল্লাহর সম্ভ্রম ও ভালোবাসা থাকে না মোটেও; গ. এ ধরনের খুশু রিয়ার পর্যায়ভুক্ত। কারণ, এই খুশু লোক দেখানোর জন্য; আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়।
প্রকৃত খুশু : ক. হৃদয়ে কেনো কামনা-বাসনা থাকে না; খ. আল্লাহর সামনে দাঁড়ালে নিজের ভুল-ভ্রান্তির কারণে হৃদয় লজ্জিত হয়। সম্পূর্ণ সত্তা আল্লাহর সম্ভ্রম ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়; গ. লজ্জা ও ভালোবাসায় হৃদয় আল্লাহতে লীন হয়ে যায়। ফলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও অন্তরের খুশুর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
খুশু সৃষ্টিতে সহায়ক বিষয় : শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ: বলেন, দু’টি জিনিস নামাজে খুশু সৃষ্টিতে সহায়তা করে। যথা- ১. ফরজ পালনের প্রবল আগ্রহ এবং ২. মনোযোগ নষ্টকারী বিষয়গুলো পরিহার করা।
১. ফরজ পালনের প্রবল আগ্রহ : এর উদ্দেশ্য হলো- নামাজি ব্যক্তি নামাজে যা বলছে এবং করছে তাতে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে কঠোরভাবে চেষ্টা করা। নামাজে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়া করার সময় এর অর্থ নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা। আর নামাজরত অবস্থায় আমি আল্লাহর সাথে এমনভাবে কথা বলছি যেন আমি আল্লাহকে দেখছি এ কথা মনে রাখা।
জিবরাইল আ: নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইহসান কী? তিনি বলেছিলেন, ‘এমনভাবে ইবাদত করবে, যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে নাও দেখতে পাও, তবে তিনি অবশ্যই তোমাকে দেখছেন।’ (বুখারি-৫০, মুসলিম-৮)
একজন বান্দা যত বেশি নামাজের মধুময় স্বাদ আস্বাদন করতে পারে, সে নামাজে ততই আসক্ত হবে। আর এটি ঈমানের মজবুতির সাথে সম্পর্কিত। ঈমানকে শক্তিশালী করারও অনেক উপায় আছে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ সা: বলতেন, ‘এই পৃথিবীতে নারী ও সুগন্ধিকে আমার কাছে প্রিয় করা হয়েছে। আর নামাজের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে।’ (সুনানে নাসায়ি-৩৯৩৯)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বেলাল রা:-কে বলতেন, ‘হে বেলাল! তুমি ইকামত দাও এবং নামাজের মাধ্যমে আমাদের প্রশান্তি এনে দাও।’ (আবু দাউদ-৪৯০২) তিনি এটি বলেননি যে, ‘এসো নামাজ পড়ে ফেলি অথবা শেষ করি।’
২. মনোযোগ নষ্টকারী বিষয় পরিহার করা : এর মানে হলো- যা কিছু আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে তা দূরে সরিয়ে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। আর নামাজে খুশু তথা একাগ্রতা বিনষ্টকারী বিষয় ও চিন্তাগুলোকে মন থেকে মুছে ফেলা। এ ব্যাপারে নামাজিদের মধ্যে ভিন্নতা আছে। কারণ একজন ব্যক্তির সন্দেহ, বাসনা, হৃদয়ের অবস্থা এবং অন্তর যা পছন্দ করে তার ওপর নির্ভরশীলতা, আর অন্তর যা অপছন্দ করে তা এড়ানোর প্রচেষ্টা; এসবের মাত্রা তার ভেতরে শয়তানের ওয়াসওয়াসার সাথে সম্পর্কিত। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৬০৬-৬০৭)
নামাজে খুশু-খুজু অর্জনের শক্তিশালী উপায় :
১. উত্তমরূপে অজু সম্পন্ন করা; ২. আজান শোনার সাথে সাথে মানসিকভাবে অন্তরকে নামাজের দিকে মনোযোগী করা; ৩. সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা; এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে বনি আদম, প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক পরিধান করো।’ (সূরা আরাফ-৩১) ৪. নিরিবিলি পরিবেশে ইখলাস ও ইহসানের সাথে নামাজ আদায় করা; ৫. নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি পরিহার করা; ৬. সব নামাজ এমনভাবে মনোযোগের সাথে পড়া উচিত যেন এ নামাজই জীবনের শেষ নামাজ; ৭. নামাজে এমনভাবে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে, যেন সামান্য মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ তায়ালার সত্তা হতে মন ছুটে অন্যদিকে চলে না যায়; ৮. নামাজির মনে বিনয় ও আল্লাহভীতি জাগ্রত রাখা; ৯. তিলাওয়াতের দিকে গভীর মনোযোগী হওয়া; ১০. নামাজে পঠিত কুরআনের আয়াত, তাসবিহ, দোয়া ও জিকিরসমূহের অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করার চেষ্টা করা; ১১. নামাজে ভিন্ন ভিন্ন সূরা, আয়াত, জিকির ও দোয়া পড়া; ১২. স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তিলাওয়াত করা; রাসূল সা: প্রতিটি সূরা ধীরস্থিরভাবে তারতিলের সাথে পড়তেন। (মুসলিম-৭৩৩) ১৩. রুকু ও সিজদার তাসবিহগুলো ধীরস্থিরভাবে পড়া উচিত; ১৪. নামাজের রুকনগুলো (রুকু, সিজদা, কিয়াম) শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে আদায় করা; নামাজে আল্লাহর রাসূল সা: অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে রুকনগুলো আদায় করতেন, যাতে প্রত্যেকটি অঙ্গ তার যথাযথ স্থানে অবস্থান করে। (সিফাতুস সালাহ-১৩৪, আল-ফাতহ : ২/৩০৮) তিনি বলেন, ‘এই নিয়মে নামাজ আদায় না করলে তোমাদের কারো নামাজ সঠিক হবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ-৮৫৮) ১৫. নামাজ আদায়ের সময়ে একেবারে প্রয়োজন ব্যতীত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া না করা; ১৬. নামাজের মধ্যে ডানে-বামে বা এদিক-ওদিক না তাকানো; ১৭. নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় সিজদার জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা; ১৮. নামাজিকে তার সামনে দিয়ে গমনকারীদের অসুবিধা থেকে বাঁচার জন্য সামনে কোনো বস্তু রাখা উচিত। এই বস্তুকে ‘সুতরা’ বলা হয়। তাই নামাজিকে তার সামনে সুতরা রেখে নামাজ আদায় করা উচিত; রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন খালি স্থানে নামাজ পড়তে দাঁড়াবে, তখন সামনে সুতরা নিয়ে নেবে এবং তার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে।’ (আবু দাউদ : ৬৯৫, ১/৪৪৬, সহিহ আল-জামে-৬৫১) ১৯. ভাবতে হবে আল্লাহ তায়ালা নামাজে আমাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন; ২০. নামাজে বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করা; রাসূল সা: বলেছেন, ‘তুমি তোমার নামাজে মৃত্যুর কথা স্মরণ করো। কারণ, মানুষ যখন তার নামাজে মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে, তখন তার নামাজ অবশ্যই সুন্দর হবে। আর তুমি সেই ব্যক্তির মতো নামাজ পড়, যে মনে করে- এটিই তার জীবনের শেষ নামাজ।’ (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ-১৪২১)
আবু আইয়ুব রা:-কে রাসূলুল্লাহ সা: উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘যখন নামাজে দাঁড়াবে, মৃত্যুমুখী ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে।’ (আহমদ-৫/৪১২, সহিহ আল জামেঈ-৭৪২) ২১. বেশি বেশি গোপন ইবাদতে মগ্ন হওয়া; ২২. সব গুনাহ থেকে তওবা করা ও গুনাহ পরিহার করা; ২৩. হারাম খাদ্য ও হারাম পোশাক-পরিচ্ছদ পরিহার করা; এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো, আর সৎ কাজ করো। তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে আমি পূর্ণ অবগত।’ (সূরা মুমিনুন-৫১) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘হে রাসূল! আপনি আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন।’ (সূরা মুদ্দাসসির-৪) ২৪. বিদয়াতমুক্ত আমল করা; ২৫. আল্লাহর কাছে খুশু-খুজুর জন্য সাহায্য চাওয়া; ২৬. কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে জীবনযাপন করা।
লেখক : সম্পাদক মাসিক সারস পূর্ব রূপসা, খুলনা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা