মেরাজুন্নবী : গুরুত্ব-তাৎপর্য ও শিক্ষা
- মোহাম্মাদ মাকছুদ উল্লাহ
- ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মেরাজুন্নবী : হজরত মোহাম্মদ সা:-এর জীবনের এক চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে সঙ্ঘটিত হয়েছিল মেরাজের ঘটনা। তাঁর পরিচালিত শান্তি সংগ্রাম তথা ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের ক্ষেত্রে মেরাজের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর শিক্ষা সাফল্যের সিঁড়ি হিসেবে কাজ করেছে। অনাগত কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যারাই যেখানে শান্তির পক্ষে, ইসলামের পক্ষে কাজ করবে তাদের সবার জন্য মেরাজুন্নবীর গুরুত্ব-তাৎপর্য ও শিক্ষা অবিকল তেমনি থাকবে যেমনটি ছিল রাসূলে করিম সা: ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। মেরাজের বিষয়ে এত বেশিসংখ্যক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মুজতাহিদদের মতে, মেরাজের সত্যতাকে কেউ অস্বীকার করলে বা সন্দেহ পোষণ করলে তার ঈমান থাকবে না। মেরাজের বিভিন্ন পর্যায়ে উলামায়ে কেরামের মতানৈক্য রয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো মতানৈক্য নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমরা শুধু এর গুরুত্ব-তাৎপর্য ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। প্রথমেই আমরা পবিত্র কুরআনের যেসব আয়াতে মেরাজ প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে তা থেকে উদ্ধৃতি পেশ করছি।
পবিত্র কুরআনে মেরাজ সম্পর্কে একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘পবিত্র সত্তা তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে (হজরত মোহাম্মদ সা:-কে রাতের এক ক্ষুদ্র প্রহরে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন, যার চারপাশকে আমি বরকতময় কয়েছিলাম, তাঁকে আমার নিদর্শনাবলি দেখানোর জন্য।’ (সূরা আল-ইসরা ‘বানি ইরাইল’-১) আরো ইরশাদ হয়েছে- ‘তিনি যা দেখেছেন সে বিষয়ে কি তোমরা তাঁর সাথে বিতর্ক করবে? নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন। সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে। যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি যা দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ার তা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়নি এবং দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। তিনি তো তাঁর প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি দেখছিলেন।’ (সূরা আন-নাজম : ১২-১৮)
উদ্ধৃত আয়াতগুলোর তাফসির প্রসঙ্গে না গিয়ে আমরা এখানে প্রথমে মহানবী সা:-এর নবুওয়াত লাভের পর থেকে মেরাজপূর্ব জীবনাবস্থা তারপরে মেরাজের সারসংক্ষেপ এরপর মেরাজ-পরবর্তী অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করব। মহানবী সা: নবুওয়াত লাভের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০টি বছর বিনা বিতর্কে সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত ছিলেন। তখনো পর্যন্ত তাঁর কোনো শত্রু এমনকি নিন্দুকও ছিল না। নবুওয়াত লাভের পর প্রথম যেদিন তিনি তাঁর স্বগোত্রের লোকদের শান্তির পথে আহ্বান করেছিলেন, সেদিন থেকে সমাজে তাঁর শত্রু জন্ম নিতে শুরু করে। শত্রুতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তাঁকে রাস্তা-ঘাটে অপমান-অপদস্থ করা, গালি-গালাজ করা, তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখা, পাথর ছুড়ে তাঁর শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করা, তাঁর সিজদাবনত মস্তকের ওপর উটের নাড়ি-ভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়া আরো কত ধরনের নির্যাতন যে তাঁর উপর চালানো হয়েছে তার বিবরণ সংক্ষিত নিবন্ধে সম্ভব নয়।
যারা তাঁর সত্য দ্বীনে বিশ^াস করেছিল, তাঁদের ওপরও চালানো হয়েছে অবর্ণনীয় পাশবিক নির্যাতন। হজরত আম্মার, হজরত সুমাইয়া ও হজরত আব্দুল্লাহ একই পরিবারের তিনজন নিষ্পাপ মানুষ নিষ্ঠুর কাফিরদের নির্যাতনে পরিবারের অন্যদের সামনে ছটফট করতে করতে শাহাদতবরণ করেছেন। মুসলিম কাফেলার সদস্যদের ওপর পরিচালিত নির্যাতন এতই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে, তারা পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎও করতে পারতেন না। রাতের আঁধারে বা নির্জন দুপুরে অতি সঙ্গোপনে পাহাড়ের পাদদেশে ‘দারে আরকামে’ তারা কদাচিৎ মিলিত হতেন। এমন অবস্থায় আত্মীয়তার সূত্র ধরে দাবি নিয়ে মহানবী সা: ছুটে গিয়েছিলেন তায়েফে, যদি তারা ইসলাম কবুল করে! কিন্তু তায়েফবাসী মহানবীর ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল এবং শুআবে আবি তালিবের আড়াই বছরের বন্দীজীবন ইতিহাসের পাতায় সর্বকালীন জালিমদের নিকৃষ্ট স্মারক হয়ে থাকবে। মহানবী সা:-এর জীবন যন্ত্রণা যখন চরমে, যখন তিনি দ্বীনি মিশনের কাজে সারা দিন ঘুরে, নির্যাতিত হয়ে ব্যথাতুর শরীর নিয়ে ঘরে ফিরতেন তখন মহামতি হজরত খাদিজা সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে, সেবা-সুশ্রুষা করে তাঁকে সারিয়ে তুলতেন। মহানবীর দুর্দিনের আশ্রয় আব্দুল মুত্তালিব, আবু তালিব সব শেষে বিবি খাদিজাকেও মহান আল্লাহ তুলে নিলেন পৃথিবী থেকে।
নবুওয়াতের দশমবর্ষে পবিত্র রমজানে হজরত খাদিজাতুল কুবরা রা:-এর ইন্তেকালের পর মহানবী সা: সম্পূর্ণরূপে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। এমনি সময়ে একদিন পৃথিবীর এই শ্রেষ্ঠ মানুষটি অসহায়ত্বের এক চরম পর্যায়ে যখন রাতে কাবাচত্বরে ঘুমিয়েছিলেন, তখন রাতের এক অজানা প্রহরে তাঁকে ঐশী দূত হজরত জিবরাইল এসে ডেকে তোলেন। মহান রবের আজ্ঞা জানিয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি সেরে নিয়ে শুরু করেন মহান মেরাজের সফর যাত্রা। মেরাজের প্রথম মঞ্জিল-বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে যাত্রাবিরতি করেন তাঁরা। সেখানে পূর্ববর্তী সব নবীর উপস্থিতিতে মহানবী ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। পূর্ববর্তী নবীদের সাথে হজরত জিবরাইল মহানবীকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর শুরু হয় ঊর্ধ্বজগতের যাত্রা। এক-এক আসমানে দ্বাররক্ষীদের সওয়াল-জওয়াবের পর প্রবেশ, প্রতি আসমানে পূর্ববর্তী এক বা একাধিক নবীর সাথে সাক্ষাৎ, তাঁদের সাথে আলাপ সেরে পরবর্তী আসমান পানে যাত্রা। এভাবে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে মহান মওলার আরশে পৌঁছা এবং চরম ও পরম কাক্সিক্ষত সাক্ষাৎকার সেরে, জান্নাত-জাহান্নাম, মাকামে মাহমুদ, হাউজে কাউসার পরিদর্শন করে আবার মক্কাধামে ফিরে আসা, এটিই হলো মহানবী সা:-এর মেরাজের সার সংক্ষেপ।
মেরাজের পূর্ববর্তী রাসূলে কারিম সা:-এর জীবন ও মিশন পর্যবেক্ষণ করলে সেখানে শুধুই ব্যর্থতাই দেখতে পাওয়া যায়। মেরাজ-পরবর্তী জীবনের দিকে তাকালে হজরত উমারের ইসলাম গ্রহণ, আকাবাতে মদিনাবাসীর সাথে সফল চুক্তি এরপর হিজরত, তারপর বদর, উহুদ, খন্দকসহ মোট ৮০টি সামরিক অভিযান পরিচালিত হয় মহানবীর জীবদ্দশায় এবং অধিকাংশ অভিযানে মুসলমানরা বিজয় অর্জন করে। অবশেষে ৬৩০ সালে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয় এবং মহানবীর মিশন চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে। মেরাজই ছিল মহানবীর মিশনজয়ের মূল প্রেরণা। সুতরাং আমাদের জীবন ও জগতে মহান আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত কর্মসূচির সাফল্য অর্জন করতে মেরাজের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো খুঁজে বের করা খুবই জরুরি। আমাদের অনুসন্ধানে মেরাজের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
১. মহান আল্লাহর সাক্ষাৎটাই সব থেকে বড় প্রেরণা আর নামাজ মুমিনের জন্য মেরাজ। সুতরাং নামাজের প্রতি বিষেভাবে যত্নবান হতে হবে।
২. শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে জীবনকে ওয়াকফ করে দিতে হবে।
৩. নিয়মিত কুরআন-হাদিস ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসাইলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে হবে।
৪. জান্নাতের পুরস্কার ও জাহান্নামের শাস্তি সম্বন্ধে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
৫. মাঝে মধ্যে নেতৃত্ব পর্যায়ে সম্মেলন করে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ও মতবিনিময় করতে হবে।
৬. পরামর্শের ভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ হতে হবে।
৭. সময়, প্রেক্ষাপট ও সমাজের অবস্থা বিবেচনা করে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।
৮. পূর্ববর্তী যুগে আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে এবং সে সময়কার সাফল্য বা ব্যর্থতার কারণ অবগত হতে হবে।
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা