কুরআন-হাদিসের আলোকে ইহকাল-পরকাল
- মোহাম্মাদ মাকছুদ উল্লাহ
- ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
পরকাল অনন্ত-অসীম আর ইহকাল ক্ষণস্থায়ী : আমাদের ইহকালীন জীবনটা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। পক্ষান্তরে পরকালীন জীবন অনন্ত-অসীম। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। পরকালীন জীবনের তুলনায় ইহকালীন জীবনের সময়ের পরিধি পরিমাপ করা এমনকি অনুমান করাও সম্ভব নয়। কারণ নিঃশেষিত কোনো বস্তুকে অসীমের সাথে তুলনা করা যায় না। অসীমের বিপরীতে সীমিতের অস্তিত্ব কিছুই নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও। অথচ পরকালের জীবনটাই উত্তম এবং স্থায়ী’। (সূরা আল-আ’লা : ১৬-১৭) অরো এরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলে দিন, পার্থিব ভোগ সামগ্রী খুবই সামান্য। পক্ষান্তরে পরকাল খোদাভীরুদের জন্য উত্তম। আর তোমাদের ওপর সুতা পরিমাণও অবিচার করা হবে না’। (সূরা আন-নিসা : ৭৭) মহানবী সা: একটি উপমার মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালের পার্থক্য উপস্থাপন করেছেন। হজরত মুসতাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি, আল্লহর কসম! পরকালের তুলনায় ইহকালের দৃষ্টান্ত হলো, যেমন তোমাদের কেউ তার একটা আঙুল সমুদ্রের মাঝে ডুবিয়ে দিয়ে তুলে আনল। তারপর সে লক্ষ্য করে দেখুক, তার সে আঙুলটা কতটুকু পানি নিয়ে এলো? (জামে আত-তিরমিজি : ২৩২৩) পার্থিব সময়ের হিসেবে মানুষের গড় আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর। যা হাদিসের বিবরণ থেকে জানা যায়। হজরত আবু হুরায়রা রা: নবী করিম সা: থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আমার উম্মতের আয়ু ষাট থেকে সত্তর বছরের মধ্যে হবে। (জামে আত-তিরমিজি : ২৩৩১) হজরত আবু হুরায়রা বর্ণিত, অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আমার উম্মতের বয়সসীমা ষাট থেকে সত্তর বছরের মধ্যে। আর এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম হবে, যারা ওই বয়সসীমা অতিক্রম করে যাবে। (আস-সুনানুল কুবরা : ৬৫২২, সহিহ ইবনে হিব্বান : ২৯৮০)
পৃথিবীটা নিকৃষ্ট-পরকাল উত্তম : পৃথিবীতে চাকচিক্যময়, চিত্তাকর্ষক বস্তুসামগ্রীর ইয়ত্তা নেই। পার্থিব সম্পদ সম্ভার তুলনায় একটা অপরটা থেকে ভালো বা মন্দ, সুন্দর বা অসুন্দর, বেশি দামি বা কম দামি হতে পারে। কিন্তু পরকালের বিপরীতে সমগ্র পৃথিবীটাই নিকৃষ্ট। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা জেনে রেখো, পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা, জাঁকজমক, পারস্পরিক গৌরব-অহঙ্কার এবং সন্তান ও সম্পদের প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর দৃষ্টান্ত বৃষ্টির মতো, যার দ্বারা উৎপন্ন শস্য কৃষককে চমৎকৃত করে। এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন তো প্রতারণার ক্ষণস্থায়ী সামগ্রী ছাড়া অন্য কিছু নয়’। (সূরা আল-হাদিদ : ২০) আরো এরশাদ হয়েছে, ‘আর এই পৃথিবীর জীবনটা খেল-তামাশা ছাড়া অন্য কিছু নয়। পক্ষান্তরে পরকালের জীবনই আসল জীবন। যদি তারা তা জানত’। (সূরা আল-আনকাবূত : ৬৪) উদ্ধৃত আয়াতগুলোতে পার্থিব জীবন ও সম্পদের নিকৃষ্টতা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: এক হাদিসে বিষয়টা আরো স্পষ্ট করেছেন। হজরত সাহাল ইবনে সাদ রা: থেকে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যদি সমগ্র পৃথিবীর মূল্য মহান আল্লাহর কাছে একটা মশার ডানার সমানও হতো, তাহলে আল্লাহ কোনো কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করতে দিতেন না। (জামে আত-তিরমিজি : ২৩২০, মেশকাতুল মাসাবিহ : ৫১৭৭) হজরত জাবের রা: একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, একবার রাসূলুল্লাহ সা: একটা কানকাটা মৃত বকরির বাচ্চার কাছ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছে যে, এক দিরহামের বিনিময়ে এটা গ্রহণ করতে রাজি আছে? সাহাবায়ে কেরাম রা: উত্তরে বললেন, কোনো কিছুর বিনিময়েই আমরা এটা গ্রহণ করতে রাজি নই। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের কাছে এটা যত নিকৃষ্ট আল্লাহর কাছে সমগ্র পৃথিবীটা তার চেয়েও নিকৃষ্ট। (সহিহ মুসলিম : ৫১৫৭)
পৃথিবীর মোহ পরকালীন জীবনকে ধ্বংস করে ফেলে : পার্থিব জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রত্যেকটা কাজ পরকালীন জীবনের পাথেয় সংগ্রহের জন্য, সুখের সামান তৈরির জন্যে পরিচালিত হবে এটাই মুমিনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে, পরকালকে ভুলে ইহকালের জীবন ও সম্ভোগের প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লে পরকালীন জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যায়। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! কী হলো তোমাদের যে, তোমাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় অভিযানে বেরিয়ে পড়ো, তখন তোমরা পৃথিবীর প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ো? তোমরা কি পরকালীন জীবনের পরিবর্তে পার্থিব জীবন নিয়ে পরিতুষ্ট হয়ে পড়েছ? অথচ পার্থিব ভোগের সামগ্রী পরকালের তুলনায় খুবই সমান্য।’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৩৮) হজরত আমর ইবনে আওফ রা: থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের ওপর দারিদ্র্যের আশঙ্কা করি না। কিন্তু এটা ভয় করি যে, তোমাদের ওপর দুনিয়াকে বিস্তৃত করে দেয়া হবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর তা বিস্তৃত করে দেয়া হয়েছিল। আর তোমরা তা আয়ত্ত করার জন্য তেমনি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়বে যেমন প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা যেভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তোমরাও সেভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। (সহিহ আল-বোখারি : ৬১৭৭, সহিহ মুসলিম : ২৯৭১) অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, দুইটা ক্ষুধার্ত বাঘকে বকরির পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে অত ক্ষতি করতে পারে না যত বেশি ক্ষতি করে পার্থিব সম্পদ ও সম্মানের প্রতি মানুষের মোহ তার দ্বীনের। (জামে আত-তিরমিজি : ২৩৭৬, মেশকাতুল মাসাবিহ : ৫২৮১)
পৃথিবীর প্রতি অনাসক্তি আল্লাহর নৈকট্য এনে দেয় : হজরত ইবনে মাসউদ রা: থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: তেলাওয়াত করলেন, ‘আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান, তার অন্তরকে ইসলামের জন্য খুলে দেন।’ এরপর রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, হেদায়াতের নূর যখন অন্তরে প্রবেশ করে তখন সেটা উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো-হে আল্লাহর রাসূল! ওই অবস্থা বুঝার কি কোনো নিদর্শন আছে? তিনি বললেন হ্যাঁ, প্রতারণার ঘর অর্থাৎ দুনিয়া থেকে পৃথক হয়ে চিরস্থায়ী ঘর আখেরাতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং মৃত্যু আসার আগে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা (মেশকাতুল মাসাবিহ : ৫১৭৯, মুসনাদে আহমাদ : ১৯৬৮৭) অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যখন তোমরা কোনো বান্দাকে দেখবে যে, সে পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত ও স্বল্পভাষী, তখন তোমরা তার সাহচর্য অবলম্বন করবে। কেননা তাকে হেকমাত দান করা হয়েছে। (মেশকাতুল মাসাবিহ : ৫২২৯)
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা