মিথ্যা সত্য ও সুন্দরকে কলুষিত করে
- জাফর আহমাদ
- ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০৫
মিথ্যা একটি সুস্পষ্ট জুলুম। যেই ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যা সত্য, সেটিই হক এবং সেটিই তার প্রকৃতি। মিথ্যা হককে খর্ব করে। মিথ্যার কারণে সত্য তার সুন্দর প্রকৃতি অনুযায়ী প্রস্ফুটিত হতে পারে না। সত্যের আলো থেকে সবাই বঞ্চিত হয়। যেমন আল্লাহ এক ও একক। তিনি লা-শারিক, তাঁর কোনো শরিক নেই। ‘তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’। এটি আল্লাহর ইজ্জত। এটি একটি সত্য ও স্বাভাবিক কথা এবং এটি প্রকৃতিরও দাবি। এটি আল্লাহর হক। এ হক থেকে বঞ্চিত করা জুলুম। যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোনো শক্তিকে শরিক করে তারা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। আর যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর সাথে শরিক করে, সে মূলত এক মস্তবড় জালেম। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘নিশ্চয় শিরক একটা বড় জুলুম।’ (সূরা লোকমান) এমনিভাবে কুফুরিও একটি মিথ্যা। কুফরি মানে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করা। যেমন : আরবিতে কৃষককে ভাবার্থে কাফের বলা হয়, কারণ কৃষক জমিতে বীজ বপনের পর মই-এর মাধ্যমে বীজকে মাটি চাপা দেয় বা মাটিতে লুকায়। কাফের ব্যক্তিও আল্লাহকে অস্বীকারের মাধ্যমে একটি সত্যকে মিথ্যার মাধ্যমে আড়াল করে থাকে। তাই কুফুরিও একটি মিথ্যা। যারা কুফুরি ও শিরক করে তারা মিথ্যা ছাড়া কুফরি বা শিরক করতে পারে না।
মিথ্যা একটি শক্তিশালী আণবিক বা জীবাণু বোমার চেয়েও মারাত্মক। একটি আনবিক বোমা একটা নির্দিষ্ট সময় এবং একটা নির্দিষ্ট আওতাধীন সব কিছুকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু মিথ্যা আরো অধিক কার্যকর ও আরো অধিক বিধ্বংসী। এটি এমন এক নীরব ঘাতক, যা দীর্ঘ সময় ধরে অধিকতর ব্যাপক স্থানজুড়ে সার্বিক ধ্বংসলীলা চালিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এটি আরো অসংখ্য নিত্যনতুন উপসর্গের জন্ম দেয়। যার দরুন মিথ্যার একান্তই কোনো ক্ষতি বা অপকারের কথা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে না। এমনকি মিথ্যুক নিজেও জানে না এর পরিধি কতটুকু। মিথ্যুক একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু মিথ্যাটি মিথ্যুকের কার্য বাস্তবায়ন ছাড়াও অসংখ্য নতুন নতুন অঘটন ঘটিয়েছে, যেগুলোর আশা মিথ্যুক নিজেও কখনো করেনি। স্রেফ একটি মিথ্যাকে কেন্দ্র করেই কত সুখের ঘর ভেঙে গেছে, কত মানুষ জুলুমের শিকার হয়েছে, কত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ মিথ্যার আগুনে ধ্বংস হয়েছে, কত অধিকার বিনষ্ট হয়েছে তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে? কত শত লোক নিহত হয়েছে। কত মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছে, কত শিশু ইয়াতিম হয়েছে, তার হিসাব কে দেবে ? এখানেও মিথ্যা সঠিক পরিসংখ্যানকে আড়াল করে রেখেছে।
মিথ্যা সত্য-সুন্দরকে কলুষিত ও বিকৃত করে। ন্যায়-ইনসাফকে উল্টে দেয়। নৈতিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়। চারিত্রিক সৌন্দর্যকে করে কলুষিত। মানবতা ও মনুষত্ব বিপন্ন হয়। নিয়ম ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শিত হয়। গণতন্ত্রের সদর দরজাকে বন্ধ করে দিয়ে মানুষের অধিকারকে হরণ করা হয়। সর্বত্র চালু হয় জুলুমতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র। সর্বক্ষেত্রে ভাঙন আর ভাঙনের রাজত্ব চালু হয়। প্রত্যেকটির জিনিসের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে বিগড়ে দেয়। সুকুমার বৃত্তিগুলো অঙ্কুরেই ধ্বংস হয়ে যায়। দুরাচার-দুর্বৃত্ত সমাজ ও সভ্যতাকে গ্রাস করে। দেশের সম্মানিত মানুষগুলো অসম্মানিত হয়। ভালো কাজের অবমূল্যায়ন হয়।
মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ এবং সুস্পষ্ট জুলুম। রাসূল সা: বলেছেন : ‘আমি কি তোমাদের সর্ববৃহৎ কবিরা গুনাহ সম্পর্কে বলব না? তাঁরা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা ও মা-বাপের নাফরমানি করা। তারপর তিনি ঠেস দিয়ে বসে বলেন, ওহো! মিথ্যা কথা। তিনি বারবার তা বলতে লাগলেন আর আমরা ইচ্ছা করেছিলাম যদি তিনি চুপ হতেন।’ (বুখারি-মুসলিম) অথচ এ মিথ্যাই আজ মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। সমাজের নিম্নস্তর থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব মিথ্যা রোগে আক্রান্ত। মৌখিক মিথ্যায় মন ভরে না, তা ছাড়া এটি কষ্টকর বিধায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে মিডিয়া স্থাপন করে মিথ্যাকে আরো ব্যাপকাকারে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যুগ যুগ ধরে যে মিডিয়া ছিল নীতি ও নৈতিকতার সূতিকাগার, সেখানে এখন অধিকতর মিথ্যুক ও হলুদ সাংবাদিকতায় যারা পটু তাদেরই নিয়োগ দেয়া হয়। এসব মিডিয়ার মাধ্যমে সবারই জানা একটি জ্যান্ত মিথ্যাকে বারবার প্রচারের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করে। রাজনৈতিক ময়দান! সে তো এক তিক্ত জগৎ। এটিও উচ্চ পর্যায়ের নীতি ও নৈতিকতার জগৎ ছিল। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর আদর্শহীন ও চরিত্রহীন তথা মিথ্যুকরা আজ সদলবলে এ স্থান দখল করে নিয়েছে। আল্লাহর ভয় বিন্দুমাত্র যাদের ভেতর নেই তারাই সমাজের নেতৃত্ব দেয়। আর এরাই রাজনীতির পবিত্র স্থানকে কলুষিত করেছে। এদের কারণেই আজ রাজনীতির প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। ভদ্র, সুশীল, সভ্য, সত্যবাদী ও সুশিক্ষিত ব্যক্তিরা এ মাঠ ছেড়ে দিয়েছে। তাদের স্থান এখন অশিক্ষিত, শঠ ও মিথ্যুকরা দখল করে নিয়েছে।
এ অবস্থার কারণ হিসেবে কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে থাকাকেই উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যারা আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনের ওপর ঈমান আনে না তারাই মিথ্যা-প্রতারণা করে এবং তারাই মিথ্যাবাদী।’ (সূরা নাহল : ১০৫) মনে রাখা প্রয়োজন, যারা মিথ্যা চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, আল্লাহ তাদের কখনো হেদায়াতের আলো দান করেন না। আজীবন মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যে ব্যক্তি অপচয়কারী ও মিথ্যুক, আল্লাহ তাকে হেদায়াত দান করেন না।’ (আল-মোমেন : ২৮) মৃত্যুর পর আবার কঠিন আজাবের স্বাদ ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘কেয়ামতের দিন আপনি তাদের চেহেরা কালো দেখতে পাবেন, যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করেছে।’ (সূরা যুমার : ৬০) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : ‘তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন করো। সত্যবাদিতা নেকির দিকে পথপ্রদর্শন করে এবং নেকি বেহেশতের দিকে পথ দেখায়। ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে এবং সত্যের ওপর ঠিকে থাকার চেষ্টা করতে করতে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। তোমরা মিথ্যা থেকে বাঁচো। মিথ্যা গুনাহের পথ দেখায় এবং গুনাহ দোজখে নিয়ে যায়। বান্দাহ মিথ্যা বলতে এবং মিথ্যার ওপর টিকে থাকার চেষ্টা করতে থাকলে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিখিত হয়।’ (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি) রাসূল সা: দীর্ঘ এক হাদিসের একস্থানে বলেছেন : ‘এক রাতে স্বপ্নে আমি দু’ব্যক্তিকে দেখলাম। তারা আমার কাছে এসেছে। (তারা ফেরেশতা) তারা আমাকে বলল, আপনি যে লোকটির গাল চিরে দেয়া হচ্ছে দেখেছেন, সে মিথ্যাবাদী। তারপর সে আবার মিথ্যা বলবে এবং সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়বে। তারপর আবার তার চোয়াল চিরে দেয়া হবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।’ (বুখারি)
মিথ্যাবাদী একজন পরিপূর্ণ মোনাফিকও বটে। কারণ মিথ্যুক তার উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য কপটতারই আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। আবু হোরায়রা রা: হতে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন : ‘মোনাফেকের লক্ষণ তিনটি। সে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, সে যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে আমানত রাখলে, তা খেয়ানত করে।’ (বুখারি) মুসলিম শরিফে আরো একটু বেশি বর্ণিত আছে যে, ‘যদিও সে নামাজ, রোজা করে এবং নিজেকে মুসলমান মনে করে।’ আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা:-এর কাছে মিথ্যার চেয়ে অন্য কোনো দোষ বেশী ঘৃণিত ছিল না।’ (মুসনাদে আহমাদ) আবু হোরায়রা রা: হতে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন : ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না। তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। সে তিন ব্যক্তি হলো : বৃদ্ধ যেনাকারী, মিথ্যুক রাজা ও অহঙ্কারী ফকির-মিসকিন।’ (মুসলিম) হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : ‘আল্লাহর কাছে মিথ্যা জিহ্বা সবচেয়ে বড় গুনাহ এবং সর্বাধিক নিকৃষ্ট অপমান হচ্ছে কেয়ামতের দিনের অপমান।’ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : ‘মিথ্যা স¤পূর্ণরূপে ত্যাগ না করা পর্যন্ত কেউ পূর্ণ মুমেন হতে পারবে না। এমনকি হাসি-ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা বলা উচিত নয়।’ (মুসনাদে আহমাদ) আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি : ‘মিথ্যা শপথের বচন দিয়ে পণ্যসামগ্রী বিক্রি হয়ে যায় বটে কিন্তু এতে বরকত বা কল্যাণ ধ্বংস হয়ে যায়।’ (বুখারি)
কোনো শাসক যদি মিথ্যারোগে আক্রান্ত হয়, তবে তার শাসিত রাজ্যটি মিথ্যার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। চারদিকে চলে মিথ্যার বেসাতি। ফাসাদ বা বিপর্যয়ে দেশটি রসাতলে নিমজ্জিত হয়। পৃথিবীর দেশে দেশে যেখানেই এ ধরনের মিথ্যাবাদী শাসককে আমরা দেখেছি সেখানে মানবতা, মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেছি। জুলুমতন্ত্র সমাজ ও সভ্যতাকে বিষিয়ে তোলে। মানুষ তখন আল্লাহর কাছে এ জালিম ও মিথ্যুক শাসক থেকে পরিত্রাণের ফরিয়াদ জানায়।
মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই মুসলমান কখনো মিথ্যাকে আশ্রয় দিতে পারে না। কাফের ও মুশরিকের জীবনব্যবস্থা মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার দৃষ্টিতে মিথ্যা বলা অবৈধ নয়। কারণ তার বিশ্বাসই মিথ্যা। সুতরাং সে যত পারে মিথ্যা বলে বেড়াক। কিন্তু প্রতিটি মুসলমানকে সর্বক্ষেত্রে মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং সত্যের মৌখিক ও বাস্তব সাক্ষ্যদাতা হিসাবে দুনিয়াবাসীর সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে।
লেখক : প্রবন্ধকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা