০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩০, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

বিজয় দিবস ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

-

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্য গৌরবময় একটি দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে স্বাধীন-স্বকীয় জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে। আমাদের বিজয়ের রয়েছে এক মর্মান্তিক কিন্তু গৌরবজনক ইতিহাস। এই বিজয়ের জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি। এই যুদ্ধ চলেছে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাস সমান রক্ত, পাহাড় সমান লাশ, হাজার হাজার পঙ্গুত্ববরণ, শত শত মা-বোনের ইজ্জত আর লাখ লাখ টাকার দেশীয় সম্পদের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই বিজয়ের দেখা। পেয়েছি আলাদা সংবিধান, লাল-সবুজের পতাকা, বাংলাদেশ নামের সীমানা ও মানচিত্র।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯০ হাজার সদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।

এখন কথা হলো, বিজয় উদযাপন সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? এদিন আমাদের কী করতে হবে? এর জবাবে বলতে হয়, মানবজীবনে এমন কোনো বিষয় নেই, যার বর্ণনা ইসলাম বা কুরআন-সুন্নাহয় নেই। বিজয় দিবস সম্পর্কে কুরআনের দুটি সূরা আমাদের সামনে হাজির। একটি সূরা ফাতাহ (বিজয়), আরেকটি সূরা আন-নাসর (মুক্তি ও সাহায্য)। সূরা নাসর-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।’
এ সূরায় বিজয় দিবসে মুসলমানদের পালনীয় তিনটি কর্মসূচির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

১. এই দিনে আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করা।
২. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।
৩. জিহাদ বা যুদ্ধ চলাকালীন যদি ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, সেজন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাওয়া।
বিজয় দিবসে এই তিনটিই আমাদের জাতীয় কর্মসূচি। আল্লাহ তায়ালার এই তিনটি নির্দেশনার মধ্যে অনেক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা পাক হানাদার বাহিনিকে পরাজিত করেছি। এ সময়ে অনেক জানমালের ক্ষতি হয়েছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজিত ও স্বাধীন মাতৃভূমি দান করেছেন। যে দেশে আমরা বাংলা ভাষায় সব কিছু করতে পারব। আমাদের কথা বলার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার ফিরে পাব। এ এক অপূর্ব পাওয়া।

বিজয় অর্জন আর স্বাধীন হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ কী হতে পারে? এ কারণেই আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, তোমরা বিজয় লাভ করেছ, এখন তোমাদের কাজ হচ্ছে, এ বিজয়ের জন্য আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে কিংবা তাসবিহ পাঠ করে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রক্তারক্তি হয়েছে, ভুলত্রুটি হয়েছে, অন্যের অধিকার নষ্ট হয়েছে, এর জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমাও চাইতে হবে। মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো, তার মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। এটাই রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শ। আল্লাহর রাসূল যখন মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনার দিকে পাড়ি জমাচ্ছিলেন, তখন তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু বয়ে যাচ্ছিল। তিনি মনে মনে বলেছিলেন, হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনো আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। (ইবনে কাসির ৩/৪০৪) হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: মদিনাকে অনেক ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে ফেরার সময় মদিনার সীমান্তে অবস্থিত উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে রাসূলুল্লাহ সা:-এর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তখন তিনি বলতেন, এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। (বুখারি শরিফ ২/৫৩৯, মুসলিম শরিফ ২/৯৯৩)

যে মক্কা নগরী থেকে প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা: বিতাড়িত হলেন, ১০ বছর পর হাজার হাজার সাহাবায়ে কেরামের বিশাল কাফেলা নিয়ে যখন তিনি বিজয়ী বেশে সেই মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তিনি যা করেছিলেন তা নিম্নের বর্ণনা থেকে জানা যায়-
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম আলজাওযি রহ: তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদে’ উল্লেখ করেন, আল্লাহর নবী সা: একটি উষ্ট্রীর উপর আরোহিত ছিলেন, তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী (অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সাথে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন)। প্রথম তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় বিজয়ের নামাজ। এরপর তিনি হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! ১৩ বছর ধরে আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবাদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিমরোলার চালিয়েছ, এর প্রতিবিধান আজ তোমাদের কী মনে হয়, তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব?

তারা বলল- হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের উদার ভাই, উদার সন্তান, আমাদের সাথে উদারতা, মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
আল্লাহর রাসূল সা: বললেন- হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সবার জন্য হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না। (সুনানে বায়হাকি ৯/১১৮)
রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর কথা অনুযায়ী কারো ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি, কোনো অপরাধীর বিচার করেননি বরং সবাইকে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলে তিনি অপরাধীদের সাথে যা খুশি তাই করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবাইকে ক্ষমা করে মুক্ত-স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, যাবতীয় ক্ষমতার মালিক কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী) আপনি বলুন, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান করেন, আবার যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা কেড়েও নেন, যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন, আবার যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন; সব রকমের কল্যাণ তো আপনার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান।’ (সূরা আলে ইমরান, ২৬)
বিশ্বনবী সা: মক্কা বিজয়ের দিন আরো একটি কাজ করেছিলেন, তিনি কাবাঘরে রক্ষিত মূর্তিগুলোকে ভেঙে চুরমার করে বের করে দিয়ে আল্লাহর ঘরকে পবিত্র ঘোষণা করেছিলেন। তাই বিজয়ের এই দিনে মুসলমানদের উচিত, মন-মগজ থেকে ইসলাম ও আল্লাহবিরোধিতা সরিয়ে ফেলে তাওহিদকে প্রতিষ্ঠা করা। নাস্তিক্যবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে একত্মবাদকে প্রতিষ্ঠা করা।

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে আমরাও আট রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে পারি। এদিন আরো যে কাজগুলো করা উচিত তা হলো, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদ/গাজীদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা সভার আয়োজন করা। তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া-মুনাজাতের আয়োজন করা। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পঙ্গুত্ববরণকারী এবং অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের ভাতা ও সনদ বাতিল করা। আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা। তিনি যেন মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারীদের গুনাহ মাফ করে তাদের জান্নাতবাসী করেন, শত্রুরাষ্ট্রের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেন। এ দেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি দান করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা চিরদিন অক্ষুন্ন রাখেন।

অপর দিকে বিজয় দিবসে বেগানা নারী-পুরুষ একসাথে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা, নাচ-গান করা, আতশবাজি ফুটিয়ে লাখ লাখ টাকা অপব্যয় করা ইসলাম সমর্থন করে না। এগুলোর দ্বারা দেশেরও কোনো উপকার হয় না এবং শহীদদেরও কিছু আসে যায় না।
তাই আসুন, শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশে ইসলামের আলোকে বিজয় দিবস উদযাপন করি, সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে অবস্থান করি এবং আমাদের লাল-সবুজের এই দেশকে আরো বেশি স্বনির্ভর করে তুলে এ দেশের বিজয় ও স্বাধীনতাকে চিরদিন অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করি।
লেখক : ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

 


আরো সংবাদ



premium cement
এস আলমের অবৈধ নিয়োগ দেয়া ৫৭৯ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার নিয়ে এসআইবিএলের ব্যাখ্যা ‘জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে’ জাতিকে আর কোনো ষড়যন্ত্রে বিপর্যস্ত হতে দেব না : আযম খান ২০২৪ সালে টাকার মূল্য কমেছে ১২.৭২ শতাংশ কুমিল্লায় বিবির বাজার সীমান্ত থেকে লাশ উদ্ধার পানিতে ডুবে মুসলিম বালকের মৃত্যুর ভিডিও ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত না হওয়ায় হত্যা দাবিতে প্রচার ২৫ বছরের জন্য এম এ আজিজ স্টেডিয়াম বাফুফের অবশেষে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাথরঘাটায় যুবদল নেতাকে হত্যার ঘটনায় ছাত্রশিবিরকে অভিযুক্ত করায় নিন্দা চট্টগ্রামে ডিসি পার্কে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী ফুল উৎসব শিক্ষকতাকে প্রথম শ্রেণীর পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে : সমন্বয়ক হাসনাত

সকল