স্ত্রীদের সাথে মহানবীর আচরণ
- মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
- ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
(গত দিনের পর)
স্ত্রীর অনুভূতির প্রতি সচেতনতা
স্ত্রীর অনুভূতির প্রতি সচেতন থাকা প্রত্যেক স্বামীর নৈতিক দায়িত্ব। যা সুন্নাত রাসূল হিসেবে পরিগণিত। প্রিয় নবী সা: এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি বুঝতেন কখন স্ত্রীর উপর সন্তুষ্ট আর কখন অসন্তুষ্ট। মহানবী সা: আয়েশা সিদ্দিকা রা: কে বললেন, আয়েশা, তুমি কখন আমার ওপর খুশি থাকো আর কখন রাগান্বিত হও, তা আমি বুঝতে পারি। আমি বললাম, আপনি কী করে তা বুঝতে পারেন? তখন তিনি বললেন, তুমি আমার উপর প্রসন্ন থাকলে বলো, না! মুহাম্মদের রবের কসম। আর যখন তুমি রেগে থাকো তখন বলো, না! ইবরাহিমের রবের কসম। শুনে আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল! কেবল আমি আপনার নামটাই মুখে আনি না।’ (বুখারি : ৫২২৮) এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য তা হলো- আনাস রা: বলেন, একদিন সাফ্যিয়া রা: জানতে পারলেন, হাফসা রা: তাঁকে ইহুদির মেয়ে বলেছেন। এই কথা শুনে সাফ্যিয়া রা: কাঁদতে লাগলেন। নবীজী এসে তাঁকে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় দেখলেন। আর বললেন, কী হয়েছে? তুমি কাঁদছ কেন? তিনি বলেন, হাফসা আমাকে বলেছেন যে, আমি নাকি ইহুদির মেয়ে। রাসূল সা: তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘তুমি একজন নবীর মেয়ে। একজন নবী তোমার চাচা। তুমি একজন নবীর স্ত্রী। সে কীভাবে তোমার উপর গৌরব বোধ করে?’ সুতরাং প্রত্যেক পুরুষেরই উচিত নিজ স্ত্রীর রাগ-অভিমানের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তার অনুভূতির প্রতি সচেতন থাকা, তাহলে সে মানসিক বিষণ্নতা বা সাময়িক দুঃখবোধ থেকে নিজেকে সহজেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
স্ত্রীদের প্রতি নবীজির সহমর্মিতা : সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই রা: থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল সা: একবার স্ত্রীদের নিয়ে হজের সফরে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে এক ব্যক্তি বাহন থেকে নেমে উটগুলোকে জোরে হাঁকিয়ে চললেন। উটগুলোও দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। এটি দেখে তখন রাসূল সা: বললেন, ‘মহিলাদের নিয়ে সাবধানে চলো।’ এভাবে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আকস্মিকভাবে সাফিয়্যা রা: এর উটটি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর এই উটটি দেখতে সবচেয়ে সুন্দর ছিল। উটটিকে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে সাফিয়্যা রা: কেঁদে উঠলেন। এই ঘটনা রাসূল সা:কে জানালে তিনি সাফিয়্যা রা: এর দিকে এগিয়ে এলেন এবং সাফিয়্যা রা:-এর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু নিজ হাতে মুছে দিলেন। এই তুচ্ছ বিষয়টিকেও রাসূল সা: মোটেই অবজ্ঞা করলেন না বরং তার প্রতি পূর্ণ সহমর্মিতা দেখালেন যা স্ত্রীর প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসার প্রকাশ। স্ত্রীর বিপদ-আপদে স্বামীকে এগিয়ে আসতে হয়। তার বিষণœ অন্তরকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিতে হয়। তখন সে ভাবে, তার পাশে তার স্বামীও রয়েছে। তখন সে নিজেকে অনেক বেশি হালকাভাবে। প্রশান্তির ¯্রােতধারা তার অন্তরে বয়ে যায়।
স্ত্রীদের দেয়া কষ্টে ধৈর্যধারণ : রাসূল সা: তাঁর কথা ও কাজে এমন সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যার অনুশীলন আমাদের পারিবারিক জীবনকে শান্তি ও সুখময় করে তুলবে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক হৃদ্যতাকে আরো বাড়িয়ে দেবে। ‘কোনো একবার আবু বকর রা: রাসূল সা: এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ঐ সময় তিনি আয়েশা রা: কে জোর গলায় রাসূল সা: এর সাথে কথা বলতে শুনলেন। অনুমতি পেয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। এরপর তিনি আয়েশা রা: কে ‘হে উম্মে রুমানের মেয়ে বলে সম্বোধন করলেন। আর তাঁকে ধরে বললেন, ‘তুমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলছো!’ ঠিক ঐ সময় নবীজি বাবা ও মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আবু বকরকে থামালেন। আবু বকর রা: বের হয়ে গেলে রাসূল সা: আয়েশা রা: কে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বললেন, ‘দেখলে কিভাবে তোমাকে ওই লোকের হাত থেকে বাঁচালাম?’ এর কিছুক্ষণ পর আবু বকর রা: আবারো প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ভেতরে এসে তাদের দুজনকেই হাসতে দেখলেন।
আর তাদের বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যুদ্ধের সময় আপনারা যেভাবে আমাকে দলে নিয়েছিলেন, সন্ধির সময়ও সেভাবে দলে নিন।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৯২৭) এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা স্মরণযোগ্য তা হলো- উমর রা: বলেন, একবার আমি কোনো একটা ব্যাপারে আমার স্ত্রীর সাথে গলা চড়িয়ে কথা বলি। তখন আমার স্ত্রীও ঠিক সেই একইভাবে আমার সাথে কথা বলল এবং আমার সাথে তর্ক করল। কিন্তু এটা আমার পছন্দ হলো না। তখন আমার স্ত্রী বলল, ‘আপনি আমার আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করছেন! আল্লাহর কসম, রাসূল সা: এর স্ত্রীরাও তাঁর সাথে রাগ করে কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ তো রাগ করে পুরো দিন রাসূল সা: এর সাথে কথা বলেন না। আমি তার কথায় আশ্চর্য হলাম। আমি হাফসার কাছে গেলাম। তাকে বললাম, হাফসা, তোমাদের মধ্যে কি কেউ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নবীজির সা: এর সাথে রাগ করে কথা বন্ধ রাখে? তিনি বললেন, হ্যাঁ...।’ স্ত্রীদের অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণে ধৈর্য ধরা, তাদের ছোটখাটো ত্রুটিগুলো ভুলে যাওয়া, স্বামীর অধিকার আদায়ে ভুল-ত্রুটি হলে তা ক্ষমা করা স্বামীর মহত্বের লক্ষণ। নারীদের সাথে সবসময় ইতিবাচক মনোভাব ও আচরণ বজায় রাখা একজন দায়িত্বশীল স্বামীর পরিচয়। তাদের উপর অযাচিত চাপ প্রয়োগ করা ঘৃণিত কাজ হিসেবে বিবেচিত। সেই কারণে রাসূল সা: নারীদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে কুরাইশদের আচরণ ছেড়ে আনসারদের আচরণ গ্রহণ করেন।
স্ত্রীর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ : বিশ^নবী সা: তাঁর হাজারও কর্মব্যস্ততার মাঝেও স্ত্রীদের প্রতি দায়িত্ব কখনো ভুলে যেতেন না। তাদের মানসিক প্রশান্তি লাভের দিকে তিনি সবসময় খেয়াল রাখতেন। এ প্রসঙ্গে আয়েশা রা: বলেন, ‘একবার আমি রাসূল সা: এর সাথে সফরে বের হলাম। তখনো আমি কিশোরী। শারীরিকভাবে হালকা ছিলাম। শরীরে তেমন মেদ জমেনি। রাসূল সা: সাহাবিদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। রাসূল সা: এর নির্দেশে তারা এগিয়ে গেল। এরপর রাসূল সা: আমাকে বললেন, চলো, দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমরা প্রতিযোগিতা শুরু করলাম। দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি তাঁকে হারিয়ে দিলাম। তিনি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলেন। (এর অনেক দিন পর) আমার শরীর মোটা হতে লাগল। দেহে মেদ জমল। ততদিনে আগের প্রতিযোগিতার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কোনো এক সফরে রাসূল সা: সাহাবিদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। রাসূল সা: এর আদেশে তারা এগিয়ে গেল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, চলো, দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমি এবারও প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করলাম। এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে দিয়ে বিজয়ী হলেন। হাসতে লাগলেন। বললেন, এই বিজয় সেই বিজয়ের বদলা।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৫৭৪৫; আবু দাউদ : ২৫৭৮ ও ইবনে মাজাহ : ১৯৭৯)
লেখক : প্রবন্ধকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা