০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩০, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

আসুন, কুরআনের পাঠক হই

-


আমরা কুরআনের তিলাওয়াত শুনি। কুরআনের আলোচনা শুনি। কিন্তু ক’জন আছি যারা কুরআন পড়ি বা কুরআন পড়তে জানি? নিঃসন্দেহে কুরআনের শ্রোতার চেয়ে পাঠক কম। কুরআন মাজিদ পড়তে জানা মানুষের সংখ্যা আরো কম। কুরআন মাজিদ পড়তে জানেন, পঠিত বিষয়ের অর্থ জানেন এমন মানুষের সংখ্যা তার চেয়েও কম। তাহলে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, যারা অর্থসহ কুরআন পড়তে জানেন তারা অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। তারা সর্বাধিক সম্মানিত। তাদের সম্মান স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন সর্বাগ্রে। তিনি বলেন-‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও যাদেরকে (কুরআনের) জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’ (সূরা মুজাদালা, আয়াত ১১)

কুরআন পড়া বুঝাতে দুটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে- এক. কিরাত, দুই. তিলাওয়াত। কিরাত মানে পড়া, পাঠ করা, আবৃত্তি করা। আর তিলাওয়াত শব্দের অর্থ আবৃত্তি করা, আলো গ্রহণ করা ও আলো দান করা, অনুসরণ করা, পিছে পিছে চলা, প্রকাশ করা, গোপন না করা, বর্ণনা করা। অতএব বলা যায় যে, যিনি কুরআন পাঠ বা তিলাওয়াতের মাধ্যমে নিজ অন্তরকে আলোকিত করেন এবং এই আলো বিতরণের মাধ্যমে অন্যের হৃদয়কেও আলোকিত করেন তিনি যথার্থ পাঠক বা কারী। আমাদের সমাজে যারা কুরআনের পাঠক আছেন তাদের চার ভাগে ভাগ করা যায়-

এক. সওয়াব অর্জনকারী পাঠক
কিছু মানুষ আছে যারা কুরআন পড়ে সওয়াব অর্জনের জন্য। অর্থ জানার কোনো প্রয়োজন আছে এটা তারা মনে করেন না। তারা জানেন কুরআন পড়লে যেহেতু প্রতি হরফে ১০টি করে নেকি পাওয়া যায়, সুতরাং অর্থ পড়ার কী দরকার? এ কারণে তারা খতমের পর খতম কুরআন পড়েন, অর্থের দিকে কোনো নজর দেন না। সন্তানকে কুরআনের হাফেজ বানানোর নিয়ত করেন কিন্তু আলেম বানানোর কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে নেই। আসলে তারা জানেন না যে, শুধু সওয়াব অর্জনের জন্য কিংবা হাফেজ বানানোর জন্য কুরআন নাজিল হয়নি। যদি শুধু সওয়াব অর্জনের জন্য কুরআন নাজিল হতো তাহলে তার জন্য ২৩ বছর ধরে নাজিল করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এক দিনেই সমস্ত কুরআন নাজিল করলে হতো। তা ছাড়া মন্ত্র পাঠের মতো কুরআন পাঠ করলে কোনো নবী-রাসূল বা কোনো মুসলমান কখনো কোনো প্রকার বিরোধিতার সম্মুখীন হতেন না।

দুই. বিপদ মুক্তিকামী পাঠক
আরো কিছু মানুষ আছেন যারা কুরআন পড়েন বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। এরা মনে করেন কুরআন পড়ে ফুঁ দিলে কিংবা কুরআনের আয়াত কাগজে লিখে তাবিজ বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখলেই মুশকিল আসান। অবশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের আয়াত পড়ে ঝাড়ফুঁক করার অনুমতি দিয়েছেন। তবে তাবিজ ঝুলাতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো, সে শিরক করল।’ ঝাড়ফুঁক করলে যে উপকার হয় তা আমি কিছু উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চাই। ধরুন আপনি বসে আছেন এমন সময় পিঠ চুলকানো শুরু করল। পিঠের এমন জায়গায় চুলকাচ্ছে যেখানে আপনার হাত পৌঁছাচ্ছে না। তখন কী করবেন? নিশ্চয়ই হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়ে চুলকাবেন। মনে করুন, হাতের কাছে একটা কলম পেয়ে গেলেন। সাথে সাথে কলমের পিছন পাশ দিয়ে চুলকিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর কান চুলকাতে লাগল। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না? হঠাৎ মনে হলো, তাই তো, কলমের ক্যাপ আছে তো! কলমের ক্যাপের চিকন অংশ দিয়ে কান চুলকিয়ে নিলেন। মনে মনে বললেন- যাক, একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। এবার খেয়াল করুন, যে কলম দিয়ে আপনি পিঠ চুলকালেন ওই কলম কিন্তু পিঠ চুলকানোর জন্য বানানো হয়নি। কলমের ক্যাপটিও কান চুলকানোর জন্য তৈরি করা হয়নি। আসলে কলম তৈরি করা হয়েছে লেখার জন্য আর কলমের ক্যাপ তৈরি করা হয়েছে কলমকে সংরক্ষণ করার জন্য। ঠিক তেমনি কুরআন মাজিদের আয়াত পড়ে ঝাড়ফুঁক করার মাধ্যমে বিকল্প কিছু উপকার পাওয়া যায় বটে কিন্তু কুরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্য এটা নয়।

তিন. স্বার্থবাদী বা সুবিধাবাদী পাঠক
সমাজে আরো কিছু পাঠক আছেন যারা কুরআন পড়তে জানেন এবং অর্থও জানেন। কিন্তু তারা তাদের স্বার্থের অনুকূলে যেসব আয়াত আছে সেগুলো পড়েন এবং মানেন। আর যে আয়াত তার স্বার্থের প্রতিকূলে সেগুলো পড়েন না, অন্য কেউ পড়লে তা সহ্যও করতে পারেন না। সুযোগ পেলে বিরোধিতাও করেন। এদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে উল্লেখ করেছেন- ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ মানবে আর কিছু অংশ অস্বীকার করবে? যারা এ কাজ করবে তার প্রতিদান হিসেবে দুনিয়ায় তাদের জন্য রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা আর কিয়ামতের দিন কঠিন আজাবের দিকে ধাবিত হবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত -৮৫)

চার. অর্থ জেনে মান্যকারী পাঠক
কুরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্য জেনে যারা কুরআন পাঠ করেন তারাই আসল পাঠক। কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি উম্মি বা মূর্খদের মধ্য থেকে রাসূল প্রেরণ করেছেন তিনি তাদেরকে তার আয়াত তিলাওয়াত করে শুনাবেন, তাদেরকে সংস্কারের মাধ্যমে পবিত্র করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেবেন।’ (সূরা জুময়া, আয়াত-২) মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘যাদের আমি কিতাব দিয়েছি তাদের মধ্যে যারা হক আদায় করে তা তিলাওয়াত করে তারাই এর প্রতি ঈমান রাখে। আর যারা এটা অস্বীকার করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১২১)
তাফসিরে ইবনে কাছিরে হক আদায় করে কুরআন তিলাওয়াত করা বলতে চারটি কাজকে বুঝানো হয়েছে। এক. কুরআন পড়তে জানা, দুই. পঠিত বিষয়ের অর্থ জানা, তিন. জানা বিষয়ে আমল করা এবং চার. জানা বিষয় অন্যের মাঝে প্রচার করা।

কুরআন না পড়ার পরিণতি
কুরআন শিক্ষা করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি সূরা নাজিল করেছি এবং তা ফরজ করেছি। (সূরা নূর : ১) কুরআন না শিখে এটাকে এড়িয়ে চলা কবিরা গুনাহ। মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘যে আমার আয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য দুনিয়ার জীবন হবে সঙ্কীর্ণ/সঙ্কটাপন্ন। আর আমি তাকে কিয়ামতে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে, হে আমার রব! আজ আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হবে এভাবেই তোমার কাছে (তোমার চোখের সামনে) আমার আয়াত এসেছিল। তুমি যেভাবে তা ভুলে গিয়েছিলে ঠিক সেভাবেই আজকেও ভুলে যাওয়া হবে। (সূরা তোয়াহা : ১২৪-১২৬)

কুরআন শেখা কি খুবই কঠিন?
না, কুরআন শেখা মোটেও কঠিন নয়। অত্যন্ত সহজ। পৃথিবীর সকল ভাষার মধ্যে কুরআনের ভাষা শেখা সবচেয়ে সহজ। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এর ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে- ‘আমি কুরআনকে শেখার জন্য সহজ করে দিয়েছি। শিক্ষা গ্রহণ করার মতো কেউ আছে কি?’ (সূরা কামার, আয়াত- ১৭, ২২, ৩২, ৪০) তা ছাড়া সূরা মারিয়াম আয়াত-৯৭, সূরা দুখান, আয়াত-৫৮ তেও কুরআন শেখা সহজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সহজ বলেই পৃথিবীব্যাপী লক্ষ কোটি কুরআনের হাফেজ পাওয়া যায়। কেউ যদি একটু মনোযোগ দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন তাহলে মাত্র সাত দিনে কুরআন পড়া শিখে ফেলতে পারেন। কারো যদি দুই বা তিন সপ্তাহ লাগে তাতে সমস্যা কী? জীবন থেকে তো কত শত দিন, সপ্তাহ, মাস আর বছর চলে গেল! যে সময় চলে গেছে তা থেকে শত চেষ্টা করেও কি একটা দিন ফিরিয়ে আনা যাবে? না। এক সেকেন্ডও ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। তাই আসুন, এখনই সময় কুরআন শেখার। শুরু করে দিন।
লেখক : সিনিয়র অফিসার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, জীবননগর শাখা, চুয়াডাঙ্গা


আরো সংবাদ



premium cement