০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩০, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

স্ত্রীদের সাথে মহানবীর আচরণ

-


নবী চরিত্রে মানুষের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। যা অনুসরণ করলে মানুষের পার্থিব জীবন যেমন কল্যাণ ও বরকতময় হবে তেমনি আখিরাতে। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে, তাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহ সা:-এর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সূরা আল-আহজাব : ২১) সুতরাং রাসূল সা:-এর উত্তম আদর্শে ওই ব্যক্তি অবশ্যই আদর্শবান হবে, যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী করে এবং সে যেন বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে। বর্তমান সমাজের অধিকাংশ মুসলমান এই দু’টি গুণ থেকে দূরে সরে গেছে। দুনিয়াবি ফেতনা-ফাসাদের বস্তু নিয়ে অতিশয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের অন্তরে রাসূল সা:-এর আদর্শের কোনো স্থান নেই। নবীপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। ফলে ইসলামের সৌন্দর্য তারা উপভোগ করতে পারছে না।

এই নিবন্ধে আমরা নবী চরিত্রের একটি দিক ‘স্বামী হিসেবে রাসূলুল্লাহ সা: কেমন ছিলেন’ এ বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে মহানবী সা:-এর জীবনসংশ্লিষ্ট অসংখ্য আদর্শ শিক্ষণীয় ঘটনা রয়েছে মানুষের জন্য। যার সব ঘটনা এই নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে তুলে আনা সম্ভব নয়। তার পরও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতীব প্রয়োজনীয় কতগুলো বিষয়, যা আমাদের পারিবারিক জীবনের শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতে গুরুত্ব অবদান রাখবে সেগুলো আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

স্ত্রীদের সাথে আচার-ব্যবহারে রাসূল সা: ছিলেন মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে ইতিবাচক আচরণের মাধ্যমে, কিভাবে তাঁর প্রভাব সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যগুলো দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করে তুলতে পারে তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাসূল সা:। পবিত্র আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভদ্রভাবে জীবনযাপন করো:..।’ (সূরা নিসা, ৪:১৯)। স্ত্রীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে রাসূল সা: হলেন সর্বোত্তম মানুষ। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চেয়ে উত্তম...।’ (সুনানু তিরমিজি : ৩৮৯৫) স্ত্রীদের তিনি সুমধুর আচরণে আগলে রাখতেন। স্ত্রীদের সাথে সুন্দর আচার-ব্যবহার ছিল তাঁর পারিবারিক জীবনের অন্যতম ভূষণ।
স্ত্রীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অসংলগ্ন ও অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণগুলোতে তিনি ধৈর্যধারণ করতেন। তাদের ছোট-খাটো ভুলগুলোকেও তিনি এড়িয়ে যেতেন। দাম্পত্য জীবনের প্রকৃত সুখ বলতে যা আমরা বুঝি তার সবই ছিল রাসূল সা:-এর পরিবারে।

স্ত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটানো
স্ত্রীদের সাথে একান্ত সময় কাটানো খুবই উপভোগ্য বিষয়। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় বহুমুখী কর্মব্যস্ততার অজুহাতে অনেক পুরুষ দায়সারাভাবে স্ত্রীদের নামমাত্র সময় দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার এটিকে প্রয়োজনীয় বলে মনেও করেন না। ফলে তাদের মধ্যে নানা ধরনের পারিবারিক কলহ লেগেই থাকে। রাসূল সা: এর স্ত্রীরা কখনো স্বামী থেকে দূরে থাকতেন না। প্রতিদিন তারা স্বামীর দেখা পেতেন। এ প্রসঙ্গে উম্মুল মুমিনিন মা আয়েশা রা: বলেন, ‘এমন দিন খুব কমই যেত, যেদিন তিনি আমাদের সবার কাছে আসতেন না। সব স্ত্রীর সাথেই তিনি অন্তরঙ্গ হতেন। তবে সহবাস করতেন না। এরপর যার কাছে রাত যাপনের পালা হতো, তিনি সেখানে রাত যাপন করতেন....।’ (আবু দাউদ : ২১৩৫) স্বামীকে অবশ্যই একটা সময় নির্দিষ্ট করতে হবে স্ত্রীকে দেয়ার জন্য। ফজরের সালাতের পর রাসূল সা: নামাজের স্থানেই বসে থাকতেন। তাকে ঘিরে সাহাবিরাও বসতেন। সূর্য ওঠা পর্যন্ত ওখানেই বসে থাকতেন তারা। এরপর রাসূল সা: একে একে সব ক’জন স্ত্রীর কাছে যেতেন। তাদের সালাম করতেন। তাদের জন্য দোয়া করতেন। এরপর যেদিন যার পালা হতো তার কাছেই চলে যেতেন। অন্য এক হাদিসে আয়েশা রা: বলেন, ‘আসরের পর রাসূল সা: স্ত্রীদের কাছে আসতেন। সবার সাথে দেখা করতেন। এরপর একজনের সাথে একান্তে সময় কাটাতেন।’ (বুখারি : ৫২১৬)

বিশ্বস্ত, অধিকার সচেতন ও স্ত্রীদের প্রতি কৃতজ্ঞ
স্ত্রীদের প্রতি রাসূল সা:-এর আচরণ ছিল মায়া-মহব্বতে পূর্ণ। স্ত্রীর জীবদ্দশায় যেমন তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন তেমনি তার মৃত্যুর পরে তার প্রতি মনের ভালোবাসা বজায় রাখতেন। এমনকি তার স্ত্রীর বান্ধবী ও প্রিয়জনদের সাথেও সসুম্পর্ক বজায় রাখতেন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে তিনি কোনো সঙ্কোচবোধ করতেন না। খাদিজা রা: সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার অন্তরে তার ভালোবাসা ঢেলে দেয়া হয়েছে।’ (মুসলিম : ২৪৩৫) হজরত খাদিজা রা:-এর আলোচনা এলেই রাসূল সা: তাঁর প্রশংসা করতেন। তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এমনকি কখনো তিনি তাঁর প্রশংসা করতে বিতৃষ্ণাবোধ করতেন না। খাদিজা রা:-এর মৃত্যুর পর তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে স্মরণে রাখতে মোটেই ভুলে যাননি। বরং তাঁকে গুণবতী, জ্ঞানী ইত্যাদি প্রশংসাসূচক শব্দমালায় তার তারিফ ও কল্যাণ কামনা করতেন। খাদিজা রা:-এর কথা মনে পড়ে এমন কোনো বস্তু দেখলে বা এমন কোনো আওয়াজ শুনলে রাসূলুল্লাহ সা: আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। চেহারায় এক ধরনের নির্মল হাসির রেখা ফুটে উঠত। যিনি তাঁর বৈবাহিক জীবনের ৩৮ বছরের ২৫ বছর কাটিয়েছেন খাদিজা রা:এর সাথে। আয়েশা রা:-কে তিনি অত্যন্ত মহব্বত করতেন। তাঁর এই অনুরাগের কথা তিনি গোপন রাখতেন না। আমর বিন আস রা: একবার রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? রাসূল সা: উত্তর দিলেন, ‘আয়েশা।’ আমর রা: এরপর জানতে চাইলেন, পুরুষদের মধ্যে কে? রাসূল উত্তর দিলেন, ‘আয়েশার বাবা।’ (সহিহ বুখারি : ৩৬৬২)

পানপাত্রের একই স্থানে মুখ লাগিয়ে পানি পান করা
পানপাত্রের যে অংশে মুখ লাগিয়ে আয়েশা রা: পানি পান করতেন ঠিই সেই একই অংশে মুখ লাগিয়ে বিশ^নবী সা: পানি পান করতেন। তাঁর পান করা অবশিষ্ট পানিও তিনি পান করতেন। যদিও তিনি ওই সময় ঋতুবর্তী অবস্থায় ছিলেন। শুধু তাই নয়, আয়েশা সিদ্দিকা রা: তাঁকে গোশতযুক্ত হাড় খেয়ে দিতেন। বিশ^নবী সা: ঠিক সেই একই জায়গায় মুখ লাগিয়ে গোশত খেতেন যেখানে মুখ লাগিয়ে আয়েশা সিদ্দিকী রা: খেয়েছেন।

স্ত্রীর রানের ওপর মাথা রেখে ঘুমানো
আয়েশা রা: বলেন, ‘আমি হায়েজ অবস্থায় থাকলেও নবীজি সা: আমার কোলে ঠেস দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন।’ (বুখারি: ৩৬৭২)। একবার এক সফরে আয়েশা রা: এর হার হারিয়ে গেল। ফলে কাফেলাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থামতে হলো, যেখানে পানি ছিল না। তখন আবু বকর রা: মেয়েকে তিরস্কার করে বললেন, তোমার কারণে পুরো কাফেলা কষ্টে পড়ে গেল। এই সময় তাঁকে তিরস্কারস্বরূপ আবু বকর রা: আঙুল দিয়ে কোমরে ধাক্কা দিতে লাগলেন। আয়েশা রা: বলেন, তখন আমার উরুর ওপর রাসূল সা: মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন। রাসূল সা: আমার কোলে ঘুমিয়ে থাকার কারণে আমি একটুও নড়িনি।’ (বুখারি : ৪৬০৭)।

স্ত্রীকে সুন্দর নামে ডাকা
রাসূল সা: আয়েশা রা: কে হুমায়রা নামেও ডাকতেন। এ প্রসঙ্গে আয়েশা রা: বলেন, ‘কিছু হাবশি বালক মসজিদে খেলাধুলা করছিল। রাসূল সা: আমাকে ডেকে বললেন, হুমায়রা, তুমি কি তাদের খেলাধুলা দেখতে চাও?...’ (আস-সুনানুল কুবরা: ৮৯৫১) এমনকি তিনি আয়েশা সিদ্দিকা রা: কে উম্মে আব্দুল্লাহ উপনামেও ডাকতেন। যদিও তার কখনো সন্তান হয়নি। আদর-সোহাগ ও ভালোবাসা প্রকাশে রাসূল সা: স্ত্রীকে এভাবে সম্বোধন করতেন। আর স্ত্রীদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর নামগুলো নির্বাচন করতেন।

কোনো স্ত্রী সাক্ষাতে এলে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন
সাফিয়া রা: বলেন, ‘একবার রাসূল সা: ইতিকাফরত ছিলেন। আমি রাতে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য এলাম। দু’জনে কথাবার্তা বললাম। এরপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে তিনিও আমাকে দিয়ে আসার জন্য উঠে দাঁড়ালেন...।’ (মুসলিম : ২১৭৫) স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ দেখাতে আল্লাহর রাসূল সা: ইতিকাফের মতো জরুরি বিষয়ে থাকার পরও নিজ স্ত্রীকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। এমন একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় না যেখানে দেখা যায়, রাসূল কোনো স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন বা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে আয়েশা রা: বলেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ ছাড়া রাসূল সা: কোনো কিছুকে নিজ হাতে প্রহার করেননি। তিনি কোনো স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন আর না কোনো খাদিমের।’ (মুসলিম : ২৩২৮) মহানবী সা: বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর বান্দীদের প্রহার করো না।’ এ কথা শোনার পর উমর রা: রাসূল সা: কাছে এসে বললেন, ‘মহিলারা যদি স্বামীর অবাধ্য হয়।’ এই কথার জবাবে রাসূল সা: মহিলাদের মৃদু প্রহারের অনুমতি দেন। এরপর রাসূল সা:-এর স্ত্রীদের কাছে মহিলারা এসে নিজ নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল। তখন রাসূল সা: বললেন, ‘মুহাম্মদের পরিবারের কাছে অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। ওই সব স্বামী ভালো মানুষ নয়।’ (ইবনে মাজাহ : ১৯৮৫) রাসূল সা: বলেন, ‘মুমিন স্বামী তার স্ত্রীকে ঘৃণা করতে পারে না। কারণ, একজন মুমিনের চারিত্রিক কোনো দিক যদি অপছন্দনীয় হয়, অন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাকে সন্তুষ্ট করবেই।’ (মুসলিম : ২৬৭২)

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement