২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উম্মাহর রাজনৈতিক জীবনাদর্শ

-

ইসলাম-পূর্ব আরব দেশের গোত্রভিত্তিক সমাজ ভেদাভেদ, কলহ, যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ও নৈরাজ্যে ছিল ভরা। মহানবীর সা: আবির্ভাবে সেখানে বিস্ময়কর রাজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়। বিভক্ত সমাজ রাজনৈতিক ঠিকানা খুঁজে পায়। যা বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি এটাকে সব দ্বীনের ওপর বিজয়ী করতে পারেন। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা আল-ফাতহ, আয়াত-২৮) কর্ডোভা থেকে কাশগড় শাসনকারী মুসলিম উম্মাহ ‘এক জাতি, এক ভূমি’ এই আদর্শ লালন করত। মুসলিম উম্মাহ কুরআন ও হাদিসকে জ্ঞান ও বুদ্ধির অনুগামী না করে; বরং জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কুরআন ও হাদিসের অনুগামী করেছিলেন। কিন্তু আধুনিক বিশ্বসভ্যতার রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহনশীলতা ও সম্প্রীতি নেই; বরং প্রতিহিংসা তাদের রাজনীতির মূলনীতি।
মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক লক্ষ্য : আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী সব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। আর আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনের আইন প্রণয়ন করা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম রাজনৈতিক লক্ষ্য। এ ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি, নারী অধিকারসহ সব ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসের বিধান বাস্তবায়ন করা। আজকে অযোগ্য নেতৃত্বের ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার, মাদক, সন্ত্রাস, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, সুদ, ইভটিজিং, বিশৃঙ্খলা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ চলছে। এর বিরুদ্ধে সৎ, যোগ্য, আল্লাহভীরু নেতৃত্ব গড়ে তুলে, সমাজে সাম্য ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর ফলে যার মধ্যে দুনিয়াতে কল্যাণ ও আখিরাতে মুক্তির পথ সহজ হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা এ দুনিয়ায় ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আর আল্লাহর জমিন প্রশস্ত, কেবল ধৈর্যশীলদেরই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই।’ (সূরা জুমার, আয়াত-১০)
মুসলিম উম্মাহর নেতা নির্বাচন : মহানবী সা: নেতা নির্বাচনে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। পদের লোভহীন, যোগ্য ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নেতা মনোনীত করতেন। কেননা, নেতার সুচিন্তিত পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের ওপর জনগণের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য অনেকাংশে নির্ভর করে। হজরত আলী রা: বলেন, ‘মানুষের নেতৃত্বদানের অধিকারী হবে সে ব্যক্তি, যে তাদের সবার তুলনায় অধিক দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও অধিক শক্তিশালী হবে।’ (আল-ইসলাম-২/১৪৮) মহানবী সা: মদিনায় মজলিসে শূরা গঠন করেন। সেখানে সবার পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা তৈরি করেন। জনকল্যাণমূলক সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য মহানবী সা: রাষ্ট্রকে জাকাত ও সাদাকাহ বিভাগ, হিসাবরক্ষণ বিভাগ, সমর বিভাগ, যোগসূত্র স্থাপন বিভাগ, চিঠিপত্র বিভাগ, রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যক্তিগত বিভাগে বিভক্ত করেন। মহানবী সা:-এর বিস্ময়কর নেতৃত্বে মদিনার প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষানীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। তাই মুসলিম উম্মাহর উচিত, মহানবী সা:-এর অনুপম আদর্শ মেনে নেতা নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য : মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে উসমানীয় খিলাফতের পতন পর্যন্ত ৬২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্ব শাসন করেছে। ঠিক একইভাবে পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক প্রত্যেকটি মতাদর্শের আলাদা রাজনৈতিক জীবনাদর্শ রয়েছে। তন্মধ্যে ইসলামী রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থা সবচেয়ে সেরা। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা সাধারণ প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা নয়। ‘পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যসব রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির মাধ্যমে মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে স্বীয় প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, মেধা, অভিজ্ঞতা ও তীক্ষèবুদ্ধি বলে মদিনার মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে হজরত মুহাম্মদ সা: যে রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেন, তা পৃথিবীর রাষ্ট্র দর্শনের ইতিহাসে অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এবং থাকবে।’ (ড. আবদুল বাছির, মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তার রূপরেখা) মানবিকতা ও সততা, পবিত্র উদ্দেশ্য, নৈতিক ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতা, খোদাভীরু নেতৃত্বের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য।
মানবিকতা ও সততা : রাজনীতির মাধ্যমে সমাজে আধিপত্য বিস্তার, অর্থবিত্ত আর মর্যাদা লাভের আশায়, মানুষ অন্যায় ও অনৈতিক পথ অবলম্বন করে। প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখা আর নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে সবসময় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় চরম মানবিক বিপর্যয় ঘটায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবিচার, নির্যাতন, সাইবার প্রতারণা, চাঁদাবাজি, গুম, খুনের সংস্কৃতিতে সততা আর শুদ্ধাচার এখন নির্বাসনে। কিন্তু মহানবী সা: মুসলিম উম্মাহকে শিখিয়েছেন মানবিক ও সততার রাজনীতি। আধিপত্য বিস্তার, অর্থবিত্ত অর্জন মাধ্যম রাজনীতি নয়; বরং রাজনীতি হবে সমাজে সুশাসন, শান্তি প্রতিষ্ঠার সূতিকাগার। অন্যায় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার মতো রাজনীতি আর ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রদর্শন রাজনীতি তিনি কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেন। ঘোরতর শত্রুর ক্ষেত্রেও উদার মানবিকতার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। ইসলামের সুমহান আদর্শ মেনে নিলে আগের দোষ-ত্রুটি আল্লাহর জন্য ক্ষমা করে দিতেন। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আহ্বানের জন্য মহানবী সা:-কে প্রেরণ করেন। মহানবী সা:-এর মহানুভবতা, উদারতা, কোমলতা, বিনয়, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা, পরোপকারিতা, মানবীয় অতুলনীয় আচরণে মানুষ মুগ্ধ হয়। প্রভাতের সূর্যের আলোর মতো জাহিলিয়াতে সীমাহীন অনিয়ম, শিশুহত্যা, মদ, জুয়া, সুদ, দাসত্ব প্রথা, নারী নির্যাতন, অন্যায় দূরীভূত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে নবী! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার দিকে আহ্বানকারী ও আলোকদীপ্ত প্রদীপ হিসেবে।’ (সূরা আহজাব. আয়াত : ৪৫-৪৬)
পবিত্র উদ্দেশ্য : মহানবী সা:-এর জীবনের প্রথম ভাগ মানুষের মনন-মানস গঠনের প্রস্তুতি পর্ব। সেখানে তিনি ঈমান ও আল্লাহর আনুগত্য শিক্ষা দেন। দ্বিতীয় ভাগ তিনি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন ও সম্প্রসারণে মনোযোগ দেন। মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা নয়। যদি তাই হতো তবে মহানবী সা: মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতেন না; বরং মক্কায় নেতৃত্ব গ্রহণ করে আরাম কেদারায় বসে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তিনি কাফেরদের লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে সংগ্রামের জীবন বেছে নেন। রাষ্ট্রনায়ক হয়েও খুব সাধারণ জীবন অতিবাহিত করতেন। খাবারদাবারে ছিল পরিমিতিবোধ। পোশাক ছিল সাধাসিধে। কারণ মহানবী সা:-এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সব দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে।’ (সূরা তাওবা, আয়াত-৩৩)
নৈতিক ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতা : মহানবী সা:-এর রাজনৈতিক জীবনে চারিত্রিক ও নৈতিক শক্তি সমুজ্জ্বল ছিল। নিখুঁত চরিত্র ও নৈতিক শক্তির কারণে অল্প সময়ে আরববাসীর মনে তিনি স্থান করে নেন। রাসূল সা: বলেন, ‘মানুষের সাথে সহজ আচরণ করো এবং কঠিন আচরণ করো না; সুসংবাদ দাও, বিমুখ করো না।’ (বুখারি-৬৯) আর স্বার্থান্বেষী নেতাদের সিংহাসনে কুঠারাঘাত করেন। স্যার উইলিয়াম মুর বলেছেন, ‘সব শ্রেণীর ঐতিহাসিক একবাক্যে হজরত মুহাম্মদের যৌবনকালীন স্বভাবের শিষ্টতা ও আচার ব্যবহারের পবিত্রতার কথা স্বীকার করেছেন। এ রকম গুণাবলি সে সময় মক্কাবাসীর মাঝে বিরল ছিল। এই সরল প্রকৃতির যুবকের সুন্দর চরিত্র, সদাচরণ স্বদেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করে এবং তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী উপাধি পান।’ মহানবী সা:-এর মতো নৈতিক ও চারিত্রিক নিষ্কলুষ নেতৃত্ব তৈরি করতে পারলে, আজকের সমাজেও অপব্যয় বন্ধ, শ্রমিক অধিকার, বেকার সমস্যা, ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ, ওজনে কারচুপি, মজুদদারি, অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্মসাৎ, ব্যভিচার ও সমকামিতা রোধ করা সম্ভব।
ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় বিধান পালনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মহানবী সা:-এর চারিত্রিক মাধুর্য, নৈতিক মূল্যবোধ আর কর্মগুণে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি শুধু ধর্মীয় নেতা নন একই সাথে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও অনুকরণীয় আদর্শের প্রতীক হয়ে আছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭) আজকের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মহানবী সা:-এর আদর্শ অনুসরণ না করার কারণে বিশ্বে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে। কখনো স্নায়ুযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, বাণিজ্যযুদ্ধ, প্রযুক্তিযুদ্ধ, মিডিয়াযুদ্ধ, কেমিক্যালযুদ্ধ, স্বধর্মীয় যুদ্ধে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের মতো প্রকম্পিত হচ্ছে মানব জাতি। মানবতা আজ ভূলুণ্ঠিত, শান্তি মরীচিকা। মুসলিম উম্মাহর উচিত মানবকল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা। লোভ-লালসার বশবর্তী না হয়ে আল্লাহর আনুগত্য করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement