সুদ বা রিবার কুফল
- ড. ইকবাল কবীর মোহন
- ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বাস্তবিকপক্ষে সুদ বা রিবা একটি বড় সামাজিক ব্যাধি। সমাজে সুদের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক। রিবা সমাজে চরম বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সুদের অশুভ পরিণাম নিয়ে যুগে যুগে সচেতন লোকেরা বিচলিত ছিলেন। সুদ মানবিক অনাচার সৃষ্টি করে এবং সমাজকে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। তাই সুদের কুফল সম্পর্কে অধিকাংশ ধর্ম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। নানা মতবাদ এবং বিশিষ্ট দার্শনিকরা সুদকে শোষণের হাতিয়ার বলে ঘোষণা করেছে। সুদের সর্বগ্রাসী অকল্যাণ সম্পর্কে তারা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। সর্বশেষ ও কল্যাণের দ্বীন ইসলামে সুদকে হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুদ হারাম হওয়ার কারণগুলো :
সুদের ধর্মীয় কুফল : ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ। যেমনটি অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও মতবাদেও তা অবৈধ বলা হয়েছে। সবধরনের সুদকে কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর পেছনে ধর্মীয় কারণ রয়েছে। সুদের ধর্মীয় কুফলগুলো হলো :
১. সুদ হারাম : আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন, হারাম করেছেন সুদ।’-(সূরা আল-বাকারাহ : ২৭৫)। ‘হে মুমিনরা! তোমরা সুদ খেয়ো না চক্রবৃদ্ধি হারে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে সফলকাম হতে পারো।’(সূরা আলে-ইমরান : ১৩০)।
২. আখিরাতে ভয়ঙ্কর পরিণতি : আল্লাহ তায়ালা সুদের লেনদেনের জন্য আখিরাতে কঠিন আজাবের কথা ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন : ‘যারা সুদ খায় তারা দাঁড়াবে ওই ব্যক্তির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। এ অবস্থা তাদের এ জন্য যে তারা বলে, ‘বেচাকেনা তো সুদেরই মতো। অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। যার কাছে তার পালনকর্তার তরফ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে নিবৃত্ত হয়েছে, তবে আগে যা হয়ে গেছে তা তার, আর তার ব্যাপার আল্লাহর কাছে সোপর্দ। কিন্তু যারা পুনরায় সুদ নেবে, তারাই দোজখবাসী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সূরা বাকারাহ : ১৭৫)।
৩. আল্লাহর বিপক্ষে যুদ্ধের শামিল : যারা সুদের লেনদেন করে তাদের অবস্থা হলো, তারা আল্লাহর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। আল-কুরআনে তাই বলা হয়েছে : ‘তারপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না করো, তা হলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে তৈরি হয়ে যাও; কিন্তু তোমরা যদি তাওবাহ করো, তবে তোমাদের জন্য তোমাদের মূলধন রয়ে যাবে। তোমরা কাউকে অত্যাচার করবে না, না কেউ তোমাদের অত্যাচার করবে।’ (সূরা বাকারাহ : ২৭৯)।
৪. সুদ ভয়াবহ পাপ : সুদের লেনদেন করার পাপ হচ্ছে সর্বাধিক জঘন্য, কুৎসিত এবং বীভৎস ধরনের। এ ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেছেন : ‘সুদের গুনাহের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্নটি হচ্ছে ব্যক্তি কর্তৃক তার মাকে বিয়ে করার সমতুল্য।’ (মুসতাদরাকে হাকিম)।
৫. সুদ ব্যভিচারের শামিল : ‘জেনেশুনে সুদের এক দিরহাম গ্রহণ করা ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চাইতেও মারাত্মক পাপ।’ (বায়হাকি)।
সুদের নৈতিক ও সামাজিক কুফল : ইসলামে সুদ হারাম হওয়ার পেছনে ধর্মীয় কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি নৈতিক ও সামাজিকভাবেও সুদ ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। সুদের নৈতিক ও সামাজিক কুফলগুলো হলো :
১. সুদ লোভ, স্বার্থপরতা, কৃপণতার জন্ম দেয় : সুদ ব্যক্তির নৈতিকতা ও ঈমানকে ধ্বংস করে। সুদখোর মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করতে পারে না। সুদি কারবারে নিয়োজিত লোকেরা সবসময় অধিক লাভের পেছনে ছোটে। ফলে তাদের মধ্যে নীতি ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে। সুদখোর ব্যক্তি অধিক লাভের প্রত্যাশায় অতি হীন ও কদর্য খাতেও তার অর্থ বিনিয়োগ করে। সুদখোর ব্যক্তি হয় কৃপণ, লোভী, সঙ্কীর্ণমনা, অর্থপূজারি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাবিদদের কয়েকটি উক্তি তুলে ধরা হলো :
ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী : ঋণ সুদখোর সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থলিপ্সা, লোভ, স্বার্থপরতা ও সহানুভূতিহীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। (ইসলাম অ্যান্ড থিওরি অব ইন্টারেস্ট)
অর্থনীতিবিদ আফজালুর রহমান : সুদ মানুষের মধ্যে কৃপণতা, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, অর্থগৃধুœতা, সম্পদের মোহ ইত্যাদি ঘৃণ্য অভ্যাস গড়ে তোলে। সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও শ্রেণিসংগ্রামের জন্ম দেয় এবং পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মতো মহৎ গুণাবলির বিকাশ ও উৎকর্ষ বাধাগ্রস্ত করে। (ইসলাম অ্যান্ড থিওরি অব ইন্টারেস্ট)
২. ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরি করে : সুদি কারবারে জড়িত লোকেরা অন্যায়ভাবে মানুষের, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ধনসম্পদ কুক্ষিগত করে। ঋণগ্রহীতা অনেকসময় ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেও ঋণদাতার কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি পায় না। অনেকসময় ঋণগ্রহীতা তার সর্বস্ব বিক্রি করে মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে মহাজন বা সুদি কারবারে নিয়োজিত লোকদের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়। সুদখোরের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে জন্ম নেয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
৩. সুদ ঋণের ভারে জর্জরিত করে : সুদি সমাজে ঋণ পাওয়ার জন্য সুদ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মানুষ সুদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে যায়। এই সমাজে মানুষ বিপদ-আপদ এবং দুর্বিপাকে পড়লেও সহানুভূতির কোনোই অবলম্বন থাকে না। বরং মানুষ মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস যথার্থই বলেছেন : ঋণগ্রহীতা কখনো উৎপাদনকারী হিসেবে ঋণ গ্রহণ করার সুযোগ পায় না, তারা যখনই ঋণ নেয়, তখন ব্যক্তিগত অভাব পূরণের সামগ্রী সংগ্রহের জন্য ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়।’ (দি ক্যাপিটাল)
৪. সুদ কর্মক্ষমতা হ্রাস করে : মুফতি তাকি উসমানি বলেন, সুদ মানুষকে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এতে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রচেষ্টার লক্ষ্যকে ঘুরিয়ে দেয়। যার জন্য প্রকৃত পণ্যসামগ্রী ও সেবা প্রদানের পরিবর্তে অর্থ দিয়ে লাভ করার লক্ষ্যেই যাবতীয় প্রচেষ্টা পরিচালিত হয়।’ (সুদ নিষিদ্ধ : পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়)
সুদের অর্থনৈতিক কুফল :
সুদ অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদের ঋণাত্মক প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক সুদের কুফল প্রমাণ করেছেন।
১. মূলধন গঠনের প্রতিবন্ধক : সুদ বিনিয়োগ সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতার কারণ। জে. এম. কিনসের মতে : ‘সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ হ্রাস পায়। এতে উৎপাদন ও আয় হ্রাস পায় এবং সঞ্চয়ও কমে যায়।’ জে. এম. কিনস আরো বলেছেন : ‘আর্থিক সুদের হার প্রকৃত পুঁজি গঠনে বাধা সৃষ্টি করে।’ (হিস্ট্রি অব ইকোনমিক ডকট্রিনস)। এ প্রসঙ্গে ড. এম. উমর চাপড়া বলেন : ‘সুদের হার কম হলে সঞ্চয়কারীদের অংশ কমে যায় এবং উদ্যোগক্তরা বেশি লাভ পায়। এ উভয় অবস্থাই পুঁজি গঠনের পক্ষে অনুপযোগী।’(টুওয়ার্ডস জাস্ট মনিটরি সিস্টেম)
২. বিনিয়োগ কমিয়ে দেয় : সুদের হারের সাথে বিনিয়োগের বিপরীতধর্মী সম্পর্ক রয়েছে। সুদের হার বাড়া ও কমার সাথে বিনিয়োগ প্রভাবিত হয়। এ প্রসঙ্গে জে. এম. কিনস বলেন : ‘সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ কমে যায় এবং সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।’ তাই জে. এম. কিনস পরিপূর্ণ বিনিয়োগের জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছেন। (হিস্টরি অব ইকোনমিক ডকট্রিনস)।
৩. অনুৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে : সুদ বিনিয়োগকে অনুৎপাদনশীল ফটকা খাতে প্রবাহিত করে। সুদনির্ভর অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ কম হওয়ার বড় কারণ হলো সুদ পুঁজিকে অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দেয়। সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে সঞ্চয় জমা রাখে, আর ব্যাংক তা বিনিয়োগ করে। তবে ব্যাংক সবসময় ঝুঁকিমুক্ত খাতে এবং নিশ্চিত সুদ পাওয়ার আশায় সেই সঞ্চয় উৎপাদনশীল শিল্প, বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের চেয়ে বরং সরকারি সিকিউরিটিজ, বিনিময় বিল এবং ফটকামূলক কারবারে খাটায়। এতে উৎপাদনশীল খাতে পুঁজির প্রবাহ কম হয়। তাই আফজালুর রহমান সত্যিকার অর্থেই বলেছেন : ‘সুদি অর্থনীতিতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত হয়, সুদমুক্ত অর্থনীতিতে সেই সাকুল্য অর্থ উৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত হবে এবং উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেবে। এতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে।’ (ইকনোমিক ডকট্রিনস অব ইসলাম)
৪. কল্যাণকর খাতে বিনিয়োগ হ্রাস করে : সুদের হার এমন এক বিষয় যা ব্যবসায়ীকে সবসময় সুদের হারের ঊধ্বে মুনাফা অর্জন করার জন্য সচেষ্ট থাকতে বাধ্য করে। সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসায়ী বা উৎপাদনকারী এমন মুনাফা অর্জন করতে চেষ্টা করে যেন সুদ পরিশোধ করার পর তার যথেষ্ট মুনাফা থাকে। তবে সব ব্যবসায় বা উৎপাদনশীল খাতে মুনাফা কিন্তু এক নয়। কোনো কোনো ব্যবসায় মুনাফা বেশি। আবার কোনো কোনো ব্যবসায় বা উৎপাদনশীল পণ্যে মুনাফা ততটা আহামরি কিছু নয়। বস্তুত সাধারণ বিলাসসামগ্রী এবং অকল্যাণকর পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবসায় মুনাফার হার বেশি হয়। তাই ব্যবসায়ীরা এসব খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে উৎসাহবোধ করে। জে. এম কিনস যথার্থই বলেছেন : সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং কল্যাণকর দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার ক্ষেত্রে মুনাফার হার কম। (হিস্ট্রি অব ইকোনমিক ডকট্রিনস)
৫. অলসতা ও কর্মবিমুখতা তৈরি হয় : সুদ এক অলস কর্মবিমুখ মানবগোষ্ঠী তৈরি করে। তারা কোনো শ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণ ছাড়াই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। ফলে সাধারণ মানুষ বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের আগ্রহ, উদ্যম ও সুযোগ হারিয়ে ফেলে। সুদখোররা পুুঁজি খাটিয়ে উৎপাদনের ঝামেলা থেকে দূরে থাকে এবং এতে করে তারা অলস, অকর্ম ও কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। সুদি অর্থনীতিতে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে বিনা পরিশ্রমে ও বিনা ঝুঁকিতে নিশ্চিত সুদ পাওয়া যায়। ফলে সঞ্চয়কারীরা অলস, অকর্মণ্য এবং কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। তারা ব্যবসাবাণিজ্য বা উৎপাদনকাজে আগ্রহ দেখায় না। এ ব্যাপারে জে. এম কিনস বলেছেন : সুদ ব্যবসাকে ধ্বংস করে। মুনাফার চেয়ে সুদ বেশি সুবিধাজনক। ব্যবসায়ীরা সুদ পাওয়ার নিশ্চয়তার লোভে ব্যবসা পরিহার করে সুদে অর্থ খাটায়। (হিস্ট্রি অব ইকোনমিক ডকট্রিনস) (চলবে)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা