২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তাওয়াক্কুল ঈমানের পরিপূর্ণতা আনে

-

তাওয়াক্কুল অর্থ হচ্ছে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। আল্লাহর পথনির্দেশনার ওপর ব্যক্তির পূর্ণ আস্থা থাকা। সে মনে করবে আল্লাহ প্রকৃত সত্য সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত। তিনি নৈতিক চরিত্রের যে নীতিমালা, হালাল ও হারামের যে সীমারেখা এবং পৃথিবীতে জীবনযাপনের জন্য যেসব নিয়মকানুন ও বিধিবিধান দিয়েছেন তাই সত্য ও সঠিক এবং সেসব মেনে চলার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত। দ্বিতীয়ত, মানুষের নির্ভরতা তার নিজের শক্তি, যোগ্যতা, মাধ্যম ও উপায় উপকরণ ব্যবস্থাপনা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের সাহায্য সহযোগিতার ওপর হবে না। তাকে এ কথা পুরোপুরি মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়া ও আখিরাতের প্রতিটি ব্যাপারে তার সাফল্য প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে আল্লাহর তাওফিক ও সাহায্যের ওপর। আর আল্লাহর তাওফিক ও সাহায্যের উপযুক্ত কেবল মুমিন তখনই হতে পারে যখন সে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে লক্ষ্য বানিয়ে এবং তার নির্ধারিত সীমারেখা মেনে কাজ করবে। তৃতীয়ত, ঈমান ও নেককাজের পথ অবলম্বনকারী এবং বাতিলের পরিবর্তে ন্যায় ও সত্যের জন্য তৎপর। আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে সে সেই সব লাভ, উপকার ও আনন্দকে পদাঘাত করবে যেই সব বাতিলের পথ অনুসরণ করলে সহজেই লাভ করা যায়; বরং তাওয়াক্কুলকারী ন্যায় ও সত্যের ওপর দৃঢ় থাকার কারণে ক্ষতি, দুঃখ, কষ্ট ও বঞ্চনা তার ভাগ্যে নেমে আসবে জেনেও ধৈর্যের সাথে তা সহ্য করবে।
ঈমানের সাথে তাওয়াক্কুলের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। একটি ছাড়া অন্যটি পূর্ণতা পায় না। তাওয়াক্কুল ছাড়া যে ঈমান, তা সাদামাটা স্বীকৃতি ও ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এই ধরনের ঈমানদার থেকে ইসলামের গৌরবময় ফলাফল অর্জিত হতে পারে না। প্রকৃত ঈমানদার সার্বক্ষণিক আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হবে। কারণ তাওয়াক্কুল গভীর ঈমান থেকেই সৃষ্টি হয়। এই ঈমান তাকে এ প্রেরণা জোগায় যে, তোমার সব অবস্থা মহান আল্লাহ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন। মুহূর্তের জন্যও তিনি তোমাকে তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে দূরে রাখেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যা-ই তোমাদের দেয়া হয়েছে তা কেবল দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের উপকরণ মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা যেমন উত্তম তেমনি চিরস্থায়ী, তা সেসব লোকের জন্য যারা ঈমান এনেছে এবং তাঁর ওপর নির্ভর করে।’ (সূরা শূরা-৩৬) এখানে আল্লাহর প্রতি ভরসাকে ঈমানের অনিবার্য দাবি এবং আখিরাতের সফলতার জন্য একটি জরুরি বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
তাওয়াক্কুল কিভাবে করতে হয় তা শিক্ষা লাভের জন্য আমরা একজন মহিয়সী নারী, হজরত ইবরাহিম আ:-এর প্রিয়তমা স্ত্রী, হজরত ইসমাইল আ:-এর স্নেহময়ী মা, আল্লাহর একজন বিশেষ বান্দী হজরত হাজেরা আ:-এর কাছে যেতে পারি। আল্লাহর প্রতি অগাধ তাওয়াক্কুল বা নির্ভরশীলতা ও ধৈর্যশীলতাকে তিনি এতটাই ভালোবাসেন যে, সারা পৃথিবীর মুসলমানদের জন্য সাফা-মারওয়ার সাঈকে হজের একটি গুরুত্বপূর্ণ হুকুমে পরিণত করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা বাকারা-১৫৮) একজন নিঃসঙ্গ নারী জনমানবহীন এ মরুভূমিতে কিভাবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা করেছিলেন, কিভাবে তিনি নিজেকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিয়েছিলেন, কিভাবে তিনি শুষ্ক ধূলিধূসর মরুভূমি ও পাথরসমৃদ্ধ দুটো পাহাড়ে ছোটাছুটি করে আল্লাহর রহমত তালাশ করেছিলেন, হজরত ইবরাহিম আ: তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইল আ: ও প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরাকে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে এ নির্জন স্থানে রেখে যান। তবে এটিও মনে করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই যে, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল না। এটিও তাঁর প্রতি কতগুলো পরীক্ষার একটি। তিনি তাঁর সন্তান ও স্ত্রীকে কতটুকু ভালোবাসতেন তা তাঁর দোয়া থেকে আমরা বুঝতে পারি। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের দৃষ্টি সীমার বাইরে পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে মহান রবের কাছে আবেদন করলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি তৃণলতাহীন উপত্যকায় নিজের বংশধরের একটি অংশকে আপনার ঘরের কাছে অভিবাসিত করলাম। এ জন্য যে, তাঁরা যেন নামাজ কায়েম করে। তুমি মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলমূল দিয়ে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করে দাও। যাতে তারা তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’ (সূরা ইবরাহিম-৩৭)
অভিবাসিত মা হাজেরা তাঁর শিশুকে বুকে জড়িয়ে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে এ অভিবাসনকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিয়েছিলেন। যখন তাদের পানি ও খাদ্য শেষ হয়ে গেল, তখন মা ও শিশু ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে গেলেন। শিশু ইসমাইলকে উপত্যকায় রেখে মা পানির জন্য সাফায় দৌড়ালেন, চার দিকে দৃষ্টি মেলে পানির সন্ধান পেলেন না। দৌড়ালেন মারওয়ায় সেখানেও পানির সন্ধান মেলেনি। এভাবে সাফা-মারওয়া ও মারওয়া-সাফা দুই পাহাড়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার দৌড়ানোর পর প্রিয় সন্তানের অবস্থা অবলোকন করার জন্য শিশুর কাছে এলেন। এসে দেখেন শিশুর অনতিদূরে মাটি ফুঁড়ে আল্লাহর রহমতের বারিধারা প্রবলবেগে উতলে উঠছে। মা হাজেরা পানির উৎসের চারদিকে বাঁধ দিলেন এবং মশক পুরে শিশুকে পান করান এবং নিজেও পান করেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর ধৈর্য ও নির্ভরশীলতার ফলস্বরূপ তাঁর দুঃখ, চিন্তা, কষ্ট ও দুর্ভাবনা দূর করে দিলেন। এখানে হজরত ইবরাহিম আ:-এর ধৈর্য এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুলও প্রকাশ পেয়েছে। স্ত্রী-সন্তানকে তৃণলতাহীন ধূসর ও নির্জন মরুভূমিতে রেখে যান মূলত আল্লাহর ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল রেখেই। তিনি জানতেন তাঁর প্রভু এদের বিনাশ করবেন না। তাঁর এ নির্ভরশীলতা প্রকাশ পেয়েছে মহান প্রতিপালকের কাছে করা তাঁর দোয়া থেকে। দোয়াটিতে তিনি বলেছেন, ‘তুমি মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলমূল দিয়ে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করে দাও। যাতে তারা তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’
মা হাজেরার নির্ভরশীলতাকে আল্লাহ এতটাই পছন্দ করলেন যে, এই নির্ভরশীলতা অনাগত মুমিন-মুসলমান যাতে নিজেদের মধ্যে অনুশীলন করতে পারে সে জন্য এই দুটো পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়িকে আল্লাহ মুমিনদের জন্য কর্তব্য হিসেবে ধার্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই যে ব্যক্তি বায়তুল্লায় হজ বা উমরাহ করে তার জন্য এই দু’পাহাড়ের মাঝখানে সাঈ করায় কোনো গুনাহ নেই। আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে কোনো সৎ কাজ করে আল্লাহ তা জানেন এবং তার যথার্থ মর্যাদা ও মূল্য দান করবেন।’ (সূরা বাকারা-১৫৮)
তাই এখানে প্রদক্ষিণকারী সম্মানিত মেহমানদের গভীর দৃষ্টি ফেলতে হবে যে, আমরা কিসের জন্য এবং কি কারণে দৌড়াচ্ছি, সাফা থেকে মারওয়া-মারওয়া থেকে সাফা কেন এই কসরত? মূলত এখান থেকে যে শিক্ষাটুকু আমাদের নিতে হবে, তা হলো আমরা আল্লাহর রহমতের জন্য দৌড়াচ্ছি। যারা একান্তই আল্লাহর ওপর ভরসা করেন, তাদের জন্য এ দৌড়টুকু আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতাকে আরো বৃদ্ধি ও সুদৃঢ় করে দেবে। এ পুণ্যময় স্মৃতি মন্থনকারী হৃদয় একমাত্র আল্লাহর জন্য উন্মুখ থাকবে, তার ভরসাস্থল হবে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। তার যা কিছু প্রয়োজন, তা আল্লাহকেই বলবে। সম্মানিত আল্লাহর মেহমানরা যেন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রদক্ষিণ করেন এবং মহান আল্লাহর কাছে নিজেদের অভাব, প্রয়োজন এবং অসহায়তার কথা পেশ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহ্বানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত, এ কথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে।’ (সূরা বাকারা-১৮৬)
যদিও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে আমাদের বাস্তব চক্ষু দিয়ে দেখতে পাই না এবং ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভবও করতে পারি না, তথাপি তাঁকে দূরে মনে করা ঠিক নয়। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বান্দার অতি কাছেই অবস্থান করেন। প্রত্যেক মানুষ ইচ্ছা করলে সব সময় তার কাছে আর্জি পেশ করতে পারে। এতে তিনি সব কিছু শুনেন। কারণ তিনি সামিউম বাছির বা শ্রবণকারী ও মহাদ্রষ্টা। এমন কি মনে মনে যা আবেদন করা হয় তাও তিনি শুনতে পান। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন’। (সূরা আল ইমরান-১১৯) শুধু শুনতে পান না; বরং সে সম্পর্কে তিনি সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। মানুষ অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে যে সমস্ত অলীক, কাল্পনিক ও অক্ষম সত্তাকে উপাস্য ও প্রভু গণ্য করে তাদের কাছে দৌড়ে যায়, অথচ তারা তার কোনো আবেদন নিবেদন শুনতে পায় না এবং আবেদনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও তাদের নেই। আল্লাহ গভীর ও প্রখর দৃষ্টি সম্পন্ন। তিনি তার বান্দাদের কার্যাবলি, সংকল্প, ইচ্ছা-ভালোভাবেই জানেন। কারণ তিনি বাছিরুম বিল ইবাদ। তিনি লাতিফ বা সূক্ষ্মদর্শী। সুতরাং তাওয়াক্কুল একমাত্র তাঁর ওপরই করতে হবে এবং যা কিছু প্রয়োজন তাঁকেই বলতে হবে।
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement